বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২

মাথা খালেদা জিয়ার ব্যথায় মরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী



শা হ আ হ ম দ রে জা

ক্ষমতাসীনদের ভালো লাগার কথা নয়, কিন্তু এই সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে। জামায়াত প্রশংসিতও হচ্ছে। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, একদিকে প্রায় আড়াই বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে, অন্যদিকে জামায়াতও গড়ে তুলেছে শক্তিশালী প্রতিরোধ আন্দোলন। সরকারের পাশাপাশি তার সেবাদাসদের বিরামহীন প্রচারণা সত্ত্বেও এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর গভীর গণভিত্তি রয়েছে। জামায়াতের জনসমর্থনও যে ব্যাপক তার সর্বশেষ প্রমাণ তো ৪ ডিসেম্বরের হরতালেই পাওয়া গেছে। কোনো রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া মাত্র কয়েক ঘণ্টার ঘোষণাতেই জামায়াতের আহ্বানে সারাদেশে পালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত ও সর্বাত্মক হরতাল। প্রস্তুতির কথাটা বলা হচ্ছে এজন্য যে, হরতাল জামায়াতের পরিকল্পনায় ছিল না। হরতালের ডাক দিতে হয়েছিল সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ৩ ডিসেম্বর সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন করেছিল জামায়াত। কিন্তু অনুমতি দেয়া তো হয়ই-নি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উল্টো নির্লজ্জ মিথ্যাচারও করেছেন। পুলিশের কর্তাব্যক্তিরাও যার যার মতো করে বানোয়াট বক্তব্য রেখেছেন। সেইসঙ্গে র্যাব ও পুলিশ নিয়েছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি। তারা এমনকি বায়তুল মোকাররমে নামাজের জন্য যাওয়া মুসল্লিদেরও গ্রেফতার করেছে, পুলিশদের দিয়ে দেহ তল্লাশির নামে অসম্মানিত করেছে। এসব কারণেই ইচ্ছা না থাকলেও জামায়াতকে হরতালের ডাক দিতে হয়েছিল। আগেরদিন বিকালে ডাকা সে হরতালেই স্থবির হয়ে পড়েছিল সারাদেশ। শুধু তা-ই নয়, হরতাল কাকে বলে সেটাও দেখিয়ে দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের গুণ্ডা-ক্যাডাররাও সশস্ত্র হামলা ও জোর তত্পরতা চালিয়ে দেখেছে। কিন্তু জনগণকে হরতালের বা জামায়াতের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায়নি। বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোট নৈতিক সমর্থন ঘোষণা করায় জামায়াত বরং বুঝিয়ে দিয়েছে, হরতাল কাকে বলে। জনগণের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও হরতালের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও অনাস্থাই প্রকাশ করেছে। এর পরপর এসেছে ৯ ডিসেম্বরের সর্বাত্মক অবরোধ এবং ১১ ডিসেম্বরের সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর আধাবেলা হরতালের ডাক দিয়েছিল ১৮ দলীয় জোট। এ হরতাল পালনের মধ্য দিয়েও জনগণ নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে ১৮ দলীয় জোটের দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে।
হরতাল-অবরোধ কিংবা সরকারের দমন-নির্যাতন অবশ্য আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। এখানে বরং দেখা দরকার, ব্যর্থতা ও অপকর্মের বিশাল পাহাড়ের চাপে পড়ে ক্ষমতাসীনরা কাণ্ডজ্ঞান কতটা হারিয়ে ফেলেছেন এবং নিতান্ত মূর্খের মতো কীভাবে তারা নিজেদের রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছেন। লক্ষ্য করলে পাঠকরাও দেখতে পাবেন, বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের ক্রমাগত আন্দোলন এবং দ্রুত বেড়ে চলা জনসমর্থন দেখে ক্ষমতাসীনরা এতটাই ভীত হয়ে পড়েছেন যে, তারা এমনকি নিজেদের দলীয় বা সাংগঠনিক সীমা সম্পর্কেও সচেতন থাকতে পারছেন না। এ ব্যাপারে উদাহরণ দেয়ার জন্যও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই প্রথমে উল্লেখ করতে হবে। গত ১ ডিসেম্বর মৌলভীবাজারের সমাবেশে তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে একটি উপদেশ দিয়েছেন। বলেছেন, জনগণের ‘মনের আওয়াজ’ শুনুন এবং জামায়াত-শিবিরের ‘সঙ্গ’ ছাড়ুন। কারণও জানিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর মতে জামায়াতের ‘সঙ্গ’ ত্যাগ করলেই নাকি জনগণের মনে বেগম জিয়ার জন্য ‘একটু’ হলেও ‘জায়গা’ হতে পারে! বেগম জিয়া যদি জামায়াতের ‘সঙ্গ’ ত্যাগ না করেন তাহলে তার দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার করা হবে বলেও হুশিয়ার করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থাত্ জামায়াত এতটাই ‘খারাপ’ যে, তাদের ‘সঙ্গ’ত্যাগের বিনিময়ে বেগম জিয়ার কথিত এবং এ পর্যন্ত অপ্রমাণিত দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচারও পরিত্যাগ করতে রাজি আছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী! প্রসঙ্গক্রমে নিজেদের মহা আবিষ্কারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুল হয়নি শেখ হাসিনার। বহুবার বলা একই ঢেঁকুর তুলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়া নাকি কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতেই বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন!
সরকারের বানোয়াট সাফল্যের হাস্যকর দীর্ঘ ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি আরও অনেক কথাই শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা চলছে তার উপদেশটিকে নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলের করণীয় সম্পর্কে উপদেশ ‘খয়রাত’ করার কোনো অধিকার শেখ হাসিনার থাকতে পারে কি না। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য কষেই জবাব দিয়েছিলেন। একদিন পর ৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে তিনি ‘নিজের চরকায় তেল দেয়ার’ পাল্টা উপদেশ দিয়ে বলেছেন, বিএনপি কী করবে না করবে, কার সঙ্গে থাকবে বা থাকবে না এবং কখন কীভাবে আন্দোলন করবে—এসব বিষয়ে শেখ হাসিনার বলার কিছুই থাকতে পারে না। তিনি যেহেতু আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সেহেতু তার উচিত আওয়ামী লীগের ভালোমন্দ নিয়ে মাথা ঘামানো। বিএনপির জন্য বেগম খালেদা জিয়াই যথেষ্ট। এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগও যে জামায়াতে ইসলামীকে ‘সঙ্গে’ রেখেছিল সে কথাও বিশেষ ইঙ্গিত সহকারেই উল্লেখ করেছেন মির্জা আলমগীর। তিনি সেইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বিএনপির এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিজয়ের মাসে আওয়ামী লীগ আন্দোলন তো করেছেই, এমনকি হরতালও করেছে। তাছাড়া ডিসেম্বর শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মাস নয়, আন্দোলন-সংগ্রামের মাসও। ১৯৯০ সালের এই ডিসেম্বরেই বর্তমান আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় প্রধান শরিক স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পতন ঘটানো হয়েছিল। গণতন্ত্রের জন্য প্রায় দশকব্যাপী পরিচালিত সে আন্দোলনেও জামায়াতে ইসলামী ‘সঙ্গে’ই ছিল—বিএনপির ‘সঙ্গে’ যেমন ছিল, তেমনি ছিল আওয়ামী লীগের ‘সঙ্গে’ও। তাছাড়া ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে বেগম রোকেয়ার জন্মদিন ৯ ডিসেম্বর থেকে লাগাতার ৭২ ঘণ্টার হরতাল করেছিল আওয়ামী লীগ। করেছিলও যথারীতি জামায়াতকে ‘সঙ্গে’ নিয়েই। সুতরাং এবারের ডিসেম্বরে জামায়াতকে ‘সঙ্গে’ নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে কোনো দোষ বা অন্যায়ই করেননি বেগম খালেদা জিয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বাস্তবে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের সফল এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বিএনপির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘দরদ’ উথলে ওঠার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। বিএনপির ‘শুভ’ চান বলেও তিনি জামায়াতের ‘সঙ্গ’ ত্যাগ করার উপদেশ খয়রাত করেননি। প্রধানমন্ত্রীর এতটা ‘উদার’ হয়ে ওঠার পেছনে আসল ‘মতলব’ অন্য রকম। সেটা জামায়াতের জনপ্রিয়তা এবং ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতকেন্দ্রিক হিসাব-নিকাশ। এর কারণ জানা যাবে কিছুটা পিছিয়ে গেলে। আগেও বিভিন্ন উপলক্ষে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগি-বৈঠার হত্যা-তাণ্ডব থেকে জেনারেল মইন উ ও ফখরুদ্দীনদের ক্ষমতা দখল এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনা পর্যন্ত সবকিছুর পেছনেই ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনা। এর পেছনের কারণ ও উদ্দেশ্যও কম তাত্পর্যপূর্ণ ছিল না। ২০০৭ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের প্রাক্কালে পরিচালিত দেশি-বিদেশি সব জরিপেই দেখা গিয়েছিল, ভরাডুবি ঘটবে আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার দরকার ছিল একটি সেবাদাস সরকার।
এ ব্যাপারে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোটকে সম্মত করানো যায়নি বলেই উদ্দিন সাহেবদের ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। লক্ষ্য ছিল বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ও ইসলামী শক্তিকে দুর্বল করা। সম্ভব হলে নির্মূল করে ফেলা। এ লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত নির্দেশনা অনুসারে হুদা-সাখাওয়াত-ছহুল হোসাইনদের নির্বাচন কমিশন বেছে বেছে এমন ১৩৩টি আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করেছিল যে আসনগুলোতে বিএনপি ও জামায়াত বেশি ভোট পেয়ে এসেছে। আসনগুলোকে খণ্ডিত করে অন্য এমন কিছু এলাকার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে বিএনপি ও জামায়াত আর সহজে জিততে না পারে। এখানেই ছিল ‘ডিজিটাল খেল’-এর প্রথম পর্যায়। দেশের প্রধান দুটি দল যাতে আপত্তি জানাতে ও প্রতিবাদ করতে না পারে সে জন্য উদ্দিন সাহেবরা একদিকে বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন অন্যদিকে নানা অসঙ্গত প্রশ্ন তুলে জামায়াতকে রেখেছিলেন ব্যতিব্যস্ত। বেগম খালেদা জিয়ার পাশাপাশি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার ও হয়রানি করার পেছনেও ছিল একই উদ্দেশ্য—তারা যাতে দল দুটিকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে না পারেন। জেনারেল মইন উ’দের সামনে রেখে সে উদ্দেশ্য অনেকাংশেই সফল হয়েছিল। ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ বিদেশিদের পাশাপাশি জেনারেল মইন উ’দের সঙ্গেও হাত মিলিয়েছিলেন। নির্লজ্জ ‘ডিজিটাল’ চৌর্যবৃত্তির পথে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি।
এদিকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো গেলেও জামায়াতে ইসলামীসহ এদেশের ইসলামী ও দেশপ্রেমিক দলগুলোকে নির্মূল দূরে থাকুক, দুর্বল করে ফেলাও সম্ভব হয়নি। একই কারণে রোডম্যাপের অন্তরালে সক্রিয় শক্তিগুলোর, বিশেষ করে ভারতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনে জামায়াতের সাফল্যে ভারতের মাথাব্যথা বরং অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কারণ, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি আসনে গড়ে ৮৬ হাজার ৫৪৬টি করে ৩৮ আসনে জামায়াত পেয়েছিল ৩২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৮২ ভোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ৩৬১। সে হিসাবে ২০০৮ সালে জামায়াতের ভোট বেড়েছে নয় লাখ তিন হাজার ৪২১টি—শতকরা হিসাবে ১৪ ভাগ। এর সঙ্গে বাকি ২৬১ আসনে ১০ হাজার করে ধরেও হিসাবে দেখা গেছে, জামায়াতের ভোটার রয়েছেন অন্তত ৫৮ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮২ জন। তাছাড়া জামানত না হারানোসহ সামগ্রিক অর্জনের ক্ষেত্রেও জামায়াত যথেষ্ট সম্মানজনক অবস্থানে ছিল। আওয়ামী লীগের চারজনসহ ১৫৫৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ৯৩২ জনের অর্থাত্ ৬০ শতাংশেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। কিন্তু জামায়াতের একজন ছাড়া কারও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়নি। যার বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তিনিও ৩২ হাজার ৫২৭ ভোট পেয়েছিলেন।
অর্থাত্ রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে জামায়াতে ইসলামীর শক্তি ও জনসমর্থন উল্টো বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল বলেই মাথা খারাপ হয়েছিল ভারতের, সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগের তো বটেই। সে কারণে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই ভারতের পরামর্শে সরকার জামায়াতকে ফাঁসানোর এবং পাকড়াও করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে থেকেছে। কিন্তু কিছুদিন পর্যন্ত যুত্সই কোনো অজুহাত খুঁজে পায়নি। শেষ পর্যন্ত কথিত যুদ্ধাপরাধকেই অজুহাত বানিয়েছে সরকার। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ২০১০ সালের জুন মাসে এসে জামায়াত বেগম খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দেয়ার পর আর দেরি করেননি ক্ষমতাসীনরা। জামায়াতের প্রধান নেতাদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। তালা লাগানো হয়েছে দলটির সব অফিসে। জামায়াতকে এমনকি মিছিল-সমাবেশও করতে দেয়া হচ্ছে না। নেতা-কর্মীদের পুলিশ দিয়ে পেটানো হচ্ছে। কিন্তু এত করেও কিছুতেই জামায়াতকে ‘বাগে আনা’ যাচ্ছে না। বিএনপির সঙ্গেও জামায়াতের সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে ব্যর্থ হয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। ওদিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। সংবিধানকে ইচ্ছামতো কাটাছেঁড়া করলেও বিএনপি ও জামায়াতের আন্দোলনের কারণে নির্বাচনের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না তারা। এজন্যই কৌশল হিসেবে বিএনপির মধ্যে জামায়াত সম্পর্কে মন্দ ধারণা তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সে কৌশলের অংশ হিসেবেই বেগম খালেদা জিয়াকে জামায়াতের ‘সঙ্গ’ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি এবং বেগম জিয়ার জন্য ‘দরদ’ একেবারে উথলে উঠেছে শেখ হাসিনার। এককালের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী’ ও ‘বিপ্লবী’ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের চুনোপুঁটিরা পর্যন্ত আজকাল বিএনপির দরদে নৃত্য করতে শুরু করেছেন। বলে চলেছেন, জামায়াতের ‘সঙ্গ’ না ছাড়লে বিএনপির ভোট নাকি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে! অতি চমত্কার বিশ্লেষণই বটে! এ যেন ‘যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়া-পড়শির ঘুম নেই’-এর মতো অবস্থা! মাথা বিএনপির কিন্তু ব্যথায় মরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনরা। ব্যাপারটাকে হাস্যকর না বলে উপায় থাকে না। কারণ প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বলে বিএনপির ভোট যদি সত্যিই ‘শূন্যের কোঠায়’ নেমে আসে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় বেগম জিয়া যদি জনগণের মনে ‘একটু’ হলেও ‘জায়গা’ না পান তাহলে তো আওয়ামী লীগেরই খুশিতে ডগমগিয়ে ওঠার কথা! অথচ দেখুন, সে বিএনপির জন্যই ক্ষমতাসীনদের ঘুম একেবারে হারাম হয়ে গেছে!
ক্ষমতাসীনরা তাই বলে কেবলই উপদেশ খয়রাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছেন না, তারা একইসঙ্গে জামায়াতকে শায়েস্তা করার কর্মকাণ্ডও চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৩ ডিসেম্বর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর গ্রেফতার হয়েছেন জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম। তাকে রিম্যান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। এ পর্যন্ত গিয়েও থেমে পড়েননি ক্ষমতাসীনরা। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলিম নারীদের গায়েও হাত দিয়েছেন তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে নারী হলেও ১৭ ডিসেম্বর পুলিশ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার ২০ নেত্রী ও কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। তাদের ‘অপরাধ’, তারা নাকি ‘গোপন’ বৈঠকে সরকারের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ করছিলেন! কথিত ‘গোপন’ বৈঠক যেখানে হচ্ছিল সেখানে নাকি বিপুল পরিমাণ ‘জঙ্গি’ ও ‘জেহাদি’ বই-পুস্তক পাওয়া গেছে! প্রমাণ হিসেবে টিভিতে কিছু বই-পুস্তকের প্রচ্ছদও দেখানো হয়েছে। অথচ পবিত্র আল-কোরআন এবং সাহাবা (রা.)-দের জীবনীসহ যে বই-পুস্তকগুলো দেখানো হয়েছে সে ধরনের বই-পুস্তক বাংলাদেশের প্রায় সব মুসলিম পরিবারেই কম-বেশি রয়েছে। সুতরাং কোনো মুসলিম নেত্রীর বাসায় বা ইসলামী ছাত্রী সংস্থার অফিসে এসব বই-পুস্তক থাকার মধ্যে দোষের কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু সে বিষয়টিকেই এমনভাবে প্রচার করিয়েছে সরকার, যা দেখে ও শুনে মনে হতে পারে যেন ছাত্রী সংস্থার ওই নেত্রী ও কর্মীরা একটা ঘরের মধ্যে বসে জেহাদ ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ট্রেনিং নিচ্ছিলেন! যেন সত্যি তারা কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ করছিলেন! এভাবেই শেখ হাসিনার সরকার ধর্মপরায়ণ ২০ নারীকে অসম্মানিত করেছে, যাদের মধ্যে সন্তানসম্ভবাও রয়েছেন। তাদের রাতের বেলায় থানা হাজতেও ঢুকিয়েছে সরকার। বলা বাহুল্য, এ ধরনের ফ্যাসিস্ট এবং সরাসরি ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
পর্যবেক্ষকরা একইসঙ্গে মির্জা আলমগীরের পাল্টা জবাব ও পরামর্শকে বেশি গুরুত্বপুর্ণ মনে করছেন। বেগম খালেদা জিয়ার ‘শুভ’ কামনা করার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের আসলেও উচিত নিজের চরকায় তেল দেয়া, যাতে আগামী নির্বাচনে মান বাঁচানোর মতো আসন তারা পেতে পারেন। তাছাড়া হিসাব-নিকাশই যখন করছেন তখন এটাও ভেবে দেখা দরকার, জামায়াত চাইলে নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অবস্থা কতটা শোচনীয় হয়ে উঠতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত ভেবে দেখেননি, জামায়াতকে যারা ভোট দেন তারা ‘মরে গেলেও’ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবেন না। সুতরাং বিএনপির সঙ্গে সত্যিই যদি জামায়াতের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় তাহলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তত জামায়াতের ভোটারদের মনে ‘একটু জায়গা’ পাবেন না। এজন্যও প্রধানমন্ত্রীর উচিত বেগম খালেদা জিয়ার জন্য মায়াকান্নার ভণিতা ছেড়ে নিজের চরকায় তেল দেয়া।
লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক
shahahmadreza@yahoo.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads