‘যখন জাগবে তখনই সকাল'। এমন কথা মানুষের ভাল লাগে, আর সকালটাতো সবারই পছন্দের বিষয়। কিন্তু আমাদের সকালটা কখন হবে, আমরা কি এখনো জাগিনি? একটি সুন্দর সকালের জন্যতো মানুষ জাগতে চায়। মানুষের মধ্যেতো জাগার আকাঙ্ক্ষা আছে, কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রয়োজন হয় নেতৃত্বের। রাজনীতিবিদরাই সেই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে আমরা রাজনীতিবিদদের প্রত্যয় দেখেছি, স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনেও আমরা দেখেছি রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার। জনগণের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নেতৃত্বের সাহসী পদক্ষেপের জন্যই আজ আমরা স্বাধীন জনপদে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে এখন এসব কী হচ্ছে?
আমাদের কাছে এখনো তারাই উজ্জ্বল নেতা, যারা শুধু কথায় নয় আচরণেও দেখিয়ে গেছেন- ব্যক্তির চাইতে দল বড় এবং দলের চাইতে দেশ বড়। কিন্তু এখন কথা ও কাজের গরমিলের রাজনীতিতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে- দেশের চাইতে দল বড় এবং দলের চাইতে ব্যক্তি বড়। এমন লক্ষ্যচ্যুতির কারণেই দেশে একের পর এক ঘটে চলেছে দুঃখজনক নানা ঘটনা। ঘটনা-দুর্ঘটনাতো পৃথিবীতে ঘটেই যাচ্ছে। তবে কেউ তা মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং কেউ তা পারছে না। জাতি হিসেবে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে সমর্থ না হলে জনগণের দুঃখ বাড়ে। তেমন এক দুঃখের বৃত্তেই যেন আমরা আটকা পড়ে আছি।
দেশে নানা দল থাকবে, মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক দলে-দলে প্রতিযোগিতা থাকবে, বিতর্ক থাকবে, সমালোচনা থাকবে এসব বিষয়ও গণতন্ত্রসম্মত। তবে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো পরমত-সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সম্মানবোধ। আমাদের রাজনীতিতে এখন গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যবোধ অনুপস্থিত। ফলে স্বাস্থ্যকর বিতর্কের বদলে এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিদ্বেষ ও সহিংসতা। প্রতিদ্বনদ্বী দল বা জোটের মধ্যে আলোচনা নেই, সংলাপ নেই। তবে আছে গালাগাল, চরিত্রহনন আর ব্লেমগেমের উত্তাপ। তাই আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনমনে বিরাজ করছে নানা শঙ্কা।
‘সংকটের বিহবলতায় হয়োনা ম্রিয়মান'- গানের এমন বাণী আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। এই অনুপ্রেরণাকে অবলম্বন করতে পারতেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয হলো, তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের সংকটের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার পরিবর্তে দলবাজিতে আমাদের রাজনীতিকরা এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন যে, ন্যায় ও শান্তির বার্তা এখন অনুপস্থিত। নিজেদের সবকিছু ভাল এবং প্রতিপক্ষের সবকিছু মন্দ- এটাই যেন এখন রাজনীতির দর্শন হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থায় যে কোন দেশের সরকারের দায়িত্ব বেড়ে যায়। সরকার সুশাসন ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এমন আচরণ আমরা দেশে লক্ষ্য করছি না। বরং সহিষ্ণুতার বদলে সরকার এখন প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের কাজেই যেন বেশি উৎসাহী। কৌশলে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া এবং বিরোধী দলকে নানা দোষে দোষী সাব্যস্ত করার চাতুর্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন সরকারের মন্ত্রী বাহাদুররা। আমরা জানি যে, সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্বজিৎকে হত্যার ঘটনায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে এখানে সরকারের ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা পালনের কথা। দোষ কার না হয়? ভুল সরকারও করতে পারে, করতে পারে বিরোধী দলও। ভুলকে অস্বীকার করে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টায় কোন প্রগতি নেই, বরং আছে দুর্গতি। আমাদের সরকার যেন সেই দুর্গতির পথেই এখন চলতে চাইছে। নইলে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করা হবে কেন? গত সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে দেশী ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলা, তাজরিন গার্মেন্টে অগ্নিকান্ড অথবা হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা-এর কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলোর উদ্দেশ্য সরকারকে হেয় করে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারকে দুর্নীতিবাজ বানাতে বিদেশী সংস্থার চাপ ও কৌশল আছে। সরকারের তরফ থেকে দুদককে কোন চাপ প্রয়োগ করা হয় না। তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। যখন তারা সঠিকভাবে কাজ করছে তখন কোন কোন বিদেশী সংস্থা দুদককে চাপ প্রয়োগ করে। এগুলো কেন? সরকারকে যদি জনগণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করা যায়, তাদের বাঁচানো যায়।
আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন কতটা সঠিকভাবে কাজ করছে তা দেশের জনগণ কম-বেশি জানে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে দুদকের প্রথম দিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত ভূমিকা পর্যালোচনা করলে উপলব্ধি করা যাবে, দুদক কতটা সঠিক পথে কাজ করছে। তবে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ ও বিশ্বজিৎকে হত্যার ঘটনাকে যুদ্ধাপাধীদের বিচার ঠেকানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করার বিষয়টি বিস্ময়কর বলে বিবেচনা করছেন পর্যবেক্ষক মহল। কারণ পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ করছে যে বিশ্ব ব্যাংক, তাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর কোনো গরজ থাকবে কেন? আর বিশ্বজিৎকে কারা হত্যা করেছে তা তো এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট। তারা তো সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত। তারাই বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে যাবে কেন? এসব বক্তব্য থেকে উপলব্ধি করা যায়, সরকার সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে চাইছে না। সরকারের দায়িত্ব যেখানে সুশাসনের মাধ্যমে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, সেখানে সরকার ব্যস্ত থাকছে ব্লেমগেমে। এমন উদাহরণ তো দিন বদলের উদাহরণ হতে পারে না। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনা যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর ষড়যন্ত্র নয় তা প্রথম আলোর ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যায় মুদ্রিত প্রতিবেদন থেকেও উপলব্ধি করা যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অবশেষে দুই সাবেক মন্ত্রীকে বাদ দিয়েই পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের মামলা করলো দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ১০ জনের নাম থাকলেও মামলা করা হয়েছে ৭ জনের বিরুদ্ধে। বাদ পড়েছেন বর্তমান সরকার দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ৩ জন। এরা হলেন সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এবং সরকারি দলের হুইপ লিটন চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী। আর মামলা করা হয়েছে সরকারি ৩ কর্মকর্তা এবং কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের ৪ জনের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে ৩ জনই বিদেশী নাগরিক। কয়েকদিন ধরেই মামলায় সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর নাম না থাকা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। সরকারের চাপে দুদক তার নাম বাদ দিচ্ছে বলেও আলোচনা ছিল। শেষ পর্যন্ত বাদ দেয়া হল রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের। মামলা এভাবে এগুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কতটা এগিয়ে আসবে তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন পর্যবেক্ষক মহল। বিশ্বজিৎ দাস হত্যা ঘটনা প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়, হত্যার ঘটনা শুরুতেই ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। জড়িত নয়, এমন ৮ জনকে গ্রেফতার করে মামলার আসামী করতে চেয়েছিলেন পুলিশের এক ডিসি। কিন্তু গণমাধ্যমে ছবিসহ সবার পরিচিতি প্রকাশ পাওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পুলিশ চাপের মুখে ছাত্রলীগের ৬ কর্মীকে গ্রেফতারে বাধ্য হলেও ‘নিরীহ' ৪ ব্যক্তি এখনও এ মামলায় গ্রেফতার আছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর প্রথমে ঐ ডিসির মুখ থেকে শুনেই বিশ্বজিৎ দাস হত্যায় ৮ জন গ্রেফতার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছিলেন।
জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি হননি। পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ মন্তব্য নিয়ে পুলিশ প্রশাসনকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। ৮ জন গ্রেফতারের কথা বলার পর তিনি আবার ১১ জনের কথা বলেছিলেন, সে হিসাব এখনও মেলেনি আর যে ৮ জনকে গ্রেফতারের কথা বলা হয়েছিল তাদের কোন নাম বা ছবি গণমাধ্যমে আসেনি। এদের কেউ ছাত্রও নয়। বরং প্রথমে পুলিশ তাদের সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির অভিযোগে গ্রেফতার করে। দু'দিন পরে এদের ৪ জনকে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামী করা হয়। মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় অন্য ৪ জনকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বিশ্বজিৎ হত্যার দু'দিন পর ১১ ডিসেম্বর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তেমন আটজনকে গ্রেফতার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। এই যদি হয় বাস্তব চিত্র তাহলে দেশে সুশাসন ও ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে? সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো না বলে কোনো দেশের সরকার যদি ক্ষমতার রাজনীতিতে অন্ধ হয়ে দেশ পরিচালনা করতে চান তাহলে রাজনৈতিক অঙ্গনে সুবাতাস বইবে কেমন করে? দেশের সমৃদ্ধি ও জনগণের জীবনমান উন্নয়নের বদলে যদি ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় তাহলে কাঙ্ক্ষিত দিনবদল হবে কেমন করে? এমন অবস্থায় তো সরকার পরমত-সহিষ্ণু হয় না। সরকারের নেতিবাচক আচরণে বিরোধীদলের নেতিবাচক আচরণও যেন অনিবার্য হয়ে ওঠে। অনাকাঙ্ক্ষিত এমন পরিবেশেই এখন বাংলাদেশের জনগণের বসবাস। তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, এই অমানিশা শেষে কখন হবে সকাল? হয়তো তাদের কানে ভেসে আসছে সেই অমৃত বাণী, ‘যখন জাগবে তখনই সকাল'।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন