বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড় কথা বলতে ভালোবাসেন। নিশ্চয়ই নিজের কণ্ঠস্বর তার কাছে সুমধুর মনে হয়। দলীয় স্তাবকদের স্তাবকতা শুনতে শুনতে এখন তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, বাকি বিশ্বও তার কণ্ঠস্বর সমানেই ভালোবাসে। বিশ্ববাসীকে জ্ঞান দান তার এখতিয়ার বলে মনে করেন তিনি। একশ্রেণীর মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে যে শেখ হাসিনার একটি ‘শান্তির মডেল‘ জাতিসঙ্ঘ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে বলতে গেলে একটা সঙ্ঘাতময় অবস্থা চলছে এখন। হত্যা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ছিনতাই, গুম ও খুন এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। এর কোনোটাই জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশগুলোর অজানা নয়। কাউকে বেমানান শাড়ি পরে সাজগোজ করতে দেখলে কোনো কোনো রসিক বিদ্রƒপ করে বলেন, এ শাড়িটা কোন দোকানে পাওয়া যায়। শেখ হাসিনাকে নিয়ে কোনো কোনো সদস্য দেশ সে রকমই রসিকতা করে থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনের আগে আকাশের চাঁদ ও নক্ষত্রসমুদয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশবাসীকে। দশ টাকা কেজির চাল, সস্তা খাদ্যমূল্য, অঢেল বিদ্যুৎ, প্রতি পরিবারের অন্তত একজনকে চাকরি, বাড়ি ও গাড়ি, কৃষকদের বিনামূল্যে সার, পদ্মার ওপর সেতু এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইত্যাদি কত কী প্রতিশ্রুতি! মোট কথা যেখানে লোকে যা শুনতে চেয়েছে সেখানে সেটাই দেবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন দলটির নেত্রী। আমরা দেখেছি, যুদ্ধাপরাধের ‘বিচার’ ছাড়া অন্য সব প্রতিশ্রুতি পালনেই ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
সার্বিক খাদ্যমূল্য পূর্ববর্তী বিএনপি সরকারের চেয়ে অন্তত তিনগুণ। কোনো কৃষক বিনামূল্যে সার পাননি। পরিবারপ্রতি একজনকে সরকারি চাকরি দেয়া আকাশকুসুম কল্পনাই রয়ে গেছে, বাড়ি ও গাড়ি তো দূরের কথা। এ সরকারের ব্যর্থ ও অবন্ধুসুলভ নীতির কারণে মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কেরও গুরুতর অবনতি হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের চাকরির বাজার বাংলাদেশীদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। কয়েক লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে রাষ্ট্রকোষের মোটা অঙ্কের অর্থ আওয়ামী লীগ নেতাদের ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের পকেটে চলে গেছে। সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের বিল মাসে-দুই মাসে একবার করে বেড়ে যাচ্ছে।
পদ্মা সেতু এ সরকার দিয়ে হবে না
গত বছর থেকে আমরা বলে আসছি, পদ্মা সেতু এ সরকারের আমলে হবে না। হবে কী করে? সেতু নির্মাণের কাজ শুরু না হতেই আগাম ৩৫ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি হয়ে গেল। দিনদুপুরে পুকুরচুরির এই দুর্নীতি এতই স্বচ্ছ যে ধরে ফেলতে বিশ্বব্যাংকের এতটুকু অসুবিধা হয়নি। এরা বলছে, এই দুর্নীতির বিচার এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়া না হলে এরা সেতুর অর্থায়ন করবে না। এ দুর্নীতিতে কারা কারা জড়িত, সে তালিকাও বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালেই দিয়েছে সরকারকে। সরকার কী করেছে? গোড়ায় আদৌ দুর্নীতি হয়েছে, তা স্বীকার করেছেন। ‘চোরের সাক্ষী মাতুব্বর’ দুর্নীতি দমন কমিশনও সরকারের সাফাই গেয়েছে। বলেছে, কোনো দুর্নীতির প্রমাণ তারা পায়নি। কেউ আশ্চর্য হয়নি তাতে। অর্থমন্ত্রী গত পরশুও বললেন দুর্নীতি হয়নি। সবাই জানে দুদক আসলে সরকারের অপকর্মগুলোকে বৈধতা দেয়ার রাবার স্ট্যাম্প ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক নাছোড়বান্দা! দুদকের সাফাইতে তারা কান দেয়নি। ব্যাংকের হাই-পাওয়ার তদন্ত কমিশন গত কিছুকালের মধ্যে দু’বার এসেছে বাংলাদেশে, চোখে আঙুল দিয়ে দুদককে দেখিয়ে দিয়েছে কোথায় কোথায় হয়েছে দুর্নীতি। দুদক চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের চোখের এক কোণ ঈষৎ খুলেছে। তিনি বলেছেন দুর্নীতি হয়নি, তবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। গোলাম রহমান বিজ্ঞ লোক। তার জানা থাকার কথা, খুনের ষড়যন্ত্রও গুরুতর অপরাধ। বহু ধানাইপানাই করে এখন তিনি বলেছেন, বিচার অবশ্যই হবে তবে অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক দুই মন্ত্রী হাসান-হোসেন ও চিফ হুইপের ভাইয়ের বিচার হবে না।
আপনারা বিস্মিত হচ্ছেন? আমি কিন্তু হইনি। ধরুন আমার কয়েকজন কর্মচারী আমার হুকুমে চুরি, খুন কিংবা অন্য কোনো দুষ্কর্ম করেছে। আমি কি তাদের আদালতে পাঠাব আমার জারিজুরি ফাঁস করে দিতে? এ অবস্থায় দুদক করবে কী? আমরা কি জানি না যে দুদক সরকারের শীর্ষ ব্যক্তির রাবার স্ট্যাম্প, শীর্ষ ব্যক্তির হুকুম ছাড়া একটা চুলের নাড়াচাড়া করার সাহসও তার নেই? বিশ্বব্যাংক এখন কী করবে? আধাখেঁচড়া বিচারে সন্তুষ্ট হয়ে এরা ১২০ কোটি ডলার দিয়ে দেবে? মোটেই না। এরা জানে শেখ হাসিনার সরকারের এখন শেষ অবস্থা, তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। তার চাইতে একটা সত্যিকারের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত বিলম্ব করাই এরা ভালো মনে করবে। সরকারও পদ্মা সেতু নির্মাণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বিশ্বব্যাংক বলে দিয়েছে, সেতু নির্মাণকাজের সরাসরি তদারক করবে তাদের কমিশন। টাকা চুরির সুযোগ যেখানে থাকছে না, সেখানে সেতু নির্মাণে এ সরকারের আগ্রহ থাকতে পারে না।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস
১৯৯৬ সালে বিএনপির একটা মিছিল যাচ্ছিল মালিবাগ দিয়ে। আওয়ামীলীগ সরকারের সংসদ সদস্য ডা: এইচ বি ইকবাল তার ক্যাডারদের নিয়ে মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরা বিএনপি সমর্থকদের ওপর রিভলবারের গুলি চালায়। মিছিলের চারজন কর্মী মারা যায়। এ ঘটনার যেসব ছবি সব পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলে ছাপা হয়, তাতে ডা: ইকবাল এবং রিভলবার হাতে ক্যাডারদের স্পষ্ট শনাক্ত করা যায়। খুনিদের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তুলে নেয়া হয়। এ সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাসহ যে সাত হাজার মামলা তুলে নিয়েছিল তার মধ্যে আরো ছিল ফেনীর জয়নাল হাজারী, ঢাকার মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও তার পুত্র এবং নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান প্রমুখের বিরুদ্ধে খুন, সন্ত্রাস ইত্যাদি মামলা।
লক্ষ্মীপুরের আবু তাহেরের পুত্র জেলা বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে ছিনতাই করে। কয়েক দিন পর তার বস্তাভর্তি টুকরো টুকরো লাশ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। আবু তাহেরের পুত্রকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল, কিন্তু বর্তমান সরকার খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরো ২০ জনের সাথে তাকেও মুক্তি দেয়। শুনেছি, এরা এখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাজে নিয়োজিত আছে। মাত্র সেদিন ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাসকে গোপনে কাশিমপুর কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ঢাকা ও বাংলাদেশের মানুষ স্বভাবতই উদ্বিগ্ন। বর্তমান সরকার এখন সন্ত্রাসের গডফাদারের ভূমিকায় নেমেছে।
ছাত্রলীগ ও যুবলীগ আজ কী করছে, সেটা ঘরে ঘরে জানা কথা। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি ঠেকাতে তাদের নিয়োগ করেছিলেন। এই মন্ত্রীর পরিচয়? তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ছিলেন? পরবর্তীকালে তিনি খালেদা জিয়ার নির্বাচিত ও সাংবিধানিক সরকারকে উৎখাত করতে ‘জনতার মঞ্চ’ করেছিলেন, সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার উসকানি দিয়েছেন এবং আরো পরে দুর্নীতির অভিযেগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্যই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মারধর, প্রয়োজনে প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়ে ছাত্রলীগকে রাস্তায় নামিয়েছিলেন। এরা মারধর করেছে, খুনও করেছে। তাদের দুর্ভাগ্য। পরে জানা গেল, নিহত ব্যক্তি শিবিরের কর্মী নয়, জনৈক হিন্দু দর্জি ছিলেন। পত্রিকার পাতায় ও টেলিভিশনের পর্দায় খুনের দৃশ্যের ছবি প্রকাশিত হয়। ছবি থেকে অনেকেই খুনিদের শনাক্ত করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিয়ে পদত্যাগে বাধ্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এবং তার ডেপুটি হানিফ বক্তৃতা-বিবৃতির খই ফোটালেন, দাবি করলেন যে খুনিরা ছাত্রলীগের কেউ নয়।
নিহত ব্যক্তির পরিবার এবং হিন্দু সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানালে সরকার ও মন্ত্রীদের বক্তব্য ডিগবাজি খায়। কয়েকজনের বিরুদ্ধে এখন মামলা রুজু করা হয়েছে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবির খুনিদের সাথে তাদের তেমন কোনো মিল নেই। এ সরকারের ‘বিচারের’ এই হচ্ছে নমুনা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়েও হয়েছে বহু অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা ও প্রশ্নবোধক ব্যাপার-স্যাপার। এ বিচার যে ন্যায়কে সমুন্নত রাখার চেয়ে প্রতিশোধ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাই প্রাধান্য পেয়েছে সেটা আর লুকানোার পর্যায়ে নেই। প্রথম কথা হলো, সবচেয়ে জঘন্য ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে মুক্তি দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে। একচল্লিশ বছর পরও স্বদেশে স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী কেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের অপরাধীদের (এবং সম্পূর্ণ অসম্পর্কিত ব্যক্তিদের) বিচারের জেদ ধরলেন, সেটা অনেকেরই বোধগম্য হয়নি। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধাপরাধী বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠন পদ্ধতি এবং বিচারক্রমের প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে বহু আইনবিশেষজ্ঞ সংশয় প্রকাশ করেছেন। যে সংশয় দুর করা সরকারেরই দায়িত্ব ছিল।
সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপারস্যাপার দেখা গেছে সাপ্তাহিক ইকোনমিস্ট এবং বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত ব্রাসেলসে বসবাসকারী জনৈক বন্ধুর সাথে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের কথোপকথনে। বিচার কেমন চলছে এবং কেমনভাবে চললে সুবিধা হবে, সাক্ষীদের কাকে কখন জেরা করা সুবিধাজনক হবে, বিচারে বাইরের কার সাহায্য পাওয়া যেতে পারে ইত্যাদি ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করেছেন দুই মহাদেশে দুই বন্ধু। পরিষ্কার হয়ে গেছে যে শুনানি ও সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ শেষ হওয়ার আগেই সরকার নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে রায় দেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালের ওপর চাপ দিচ্ছিল। সরকারের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে আগাম রায় লিখনকে ‘আউটসোর্সিং’ করার কথাও বিবেচনা করছিলেন তারা। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে তিনি বন্ধুকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেনÑ গভর্নমেন্টের মাথা গেছে খারাপ হইয়া, কেবল রায় চায়।
চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু এত দিন বিচারপ্রক্রিয়া যে সঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি সে সম্বন্ধে কারো সন্দেহ নেই। নিরপেক্ষ আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন চেয়ারম্যানের অধীনে নতুন করে বিচার শুরু হওয়া উচিত। কিন্তু সরকার বিলম্ব সইতে রাজি নয়। তাদের রক্তে প্রতিশোধের নেশা চড়ে গেছে, আরো কিছু লোককে তারা কঠোর শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু তার চাইতেও বড় কথা এবং সব বিরোধীদলকে খতম করা না গেলে এ সরকারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
(লন্ডন, ১৮.১২.১২)
serajurrahman@btinternet.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন