বিজয় শব্দটি শুনতে কার না ভালো লাগে? আর সেটি যদি হয় দেশ জয়ের, তাহলে তো কথাই নেই। ইতিহাস বারবার ফিরে আসে কিন্তু ইতিহাস থেকে কেউ শিা নেয় না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিজয়। আর তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর আমরা বিজয় দিবস পালন করে আসছি।
এ মাসের বিজয়ের আনন্দ সাধারণ মানুষ মনেপ্রাণে উপভোগ করতে পারছে বলে মনে হয় না। বিজয়ের মাসে আমরা কী দেখছি? দেখার কথা ছিল সুখীসমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেখানে দেখলাম, বিশ্বজিতের রক্তে রাঙানো বাংলাদেশ। এই সরকার মতায় আসার পরপরই সরকারের ‘সোনার ছেলে’রা এতই বেপরোয়া হয়ে যায়, যার ফলে প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেন। ছাত্রলীগকে আর সামলাতে পারলেন না। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তারা করেনি। চার বছরের শাসনামলের দিকে আমরা যদি তাকাই, তাহলে কী দেখতে পাই? হত্যা, খুন, ধর্ষণ, আর গুমের মতো জঘন্যতম ঘটনা।
মন্ত্রীরা সফলতার ঢোল বাজিয়ে সরকারকে যতই সাধুবাদ দিয়ে যাক না কেন, তা শুধু মিডিয়ায় শোভা পায়। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোউন্নয়নের সূচক হতে পারে না। সরকার গণতন্ত্রের কথা বলে যেভাবে বিরোধী দলকে মামলা আর হামলা দিয়ে দমন করছে তার খেসারত একদিন দিতে হতে পারে।
অতীত কাউকে মা করে না। একটা গল্প ছিল এ রকমÑ হিন্দুদের এক রাজা ছিলেন। তিনি খুবই দয়ালু, ধর্মপরায়ণ ছিলেন। তার সাতটি সন্তান ছিল। একদিন ঈশ্বর তার সাতটি
সন্তানকে মেরে ফেললেন। তিনি ঈশ্বরকে প্রশ্ন করলেন, আমি তো কোনো দিন কোনো অন্যায় করিনি, তুমি কেন আমাকে এ রকম শাস্তি দিলে। ঈশ্বর বললেন, দেখো, তুমি যখন ছোট ছিলে তখন একদিন আমার সাতটি প্রজাপতিকে তুমি হত্যা করেছিলে। হিন্দু রাজা উত্তর দিলেন, ঈশ্বর আমি তো এটা খেলার ছলে করে ফেলছিলাম। তিনিও বললেন, আমিও তাই করেছি। যে কেউ অপরাধ করবে তার যেমন শাস্তি আছে আর ভালো কাজ করলে তার একটা পুরস্কারও আছে।
গত ২০ ডিসেম্বর লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা পড়লাম। তিনি বিশ্বজিতের লাল শার্ট নামে যে লেখাটি লিখেছেন তার অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো :
‘আমি কাপুরুষের মতো টেলিভিশন থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম, কিন্তু খবরের কাগজ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারিনি। খবরের কাগজের ছবিগুলো না দেখে দ্রুত পৃষ্ঠাগুলো উল্টে ফেলার চেষ্টা করলেও ছবিগুলো আমার মাথায় গেঁথে গেছে, চার পাশ ঘিরে যখন ছাত্রলীগের কর্মীরা তাকে হত্যা করছে, সেই মুহূর্তেও বিশ্বজিতের চোখের দৃষ্টি আমাদের সবাইকে বাকি জীবন তাড়া করে বেড়াবে, সেই দৃষ্টিতে আতঙ্ক বা যন্ত্রণা ছিল না, এক ধরনের অসহায় ব্যাকুলতা ছিল, চার পাশে অসংখ্য মানুষ দৃশ্যটি দেখছে, কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না, সেটি নিয়ে হয়তো জগৎ সংসারের প্রতি একটা তীব্র অভিমান ছিল।
কোনো কোনো ছবিতে বিশ্বজিতের শার্টটি ছিল হালকা সাদা রঙের, আবার কোনো কোনো ছবিতে সেটি ছিল উজ্জ্বল লাল রঙের, সেটি নিয়েও আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিল। ঘটনার সপ্তাহখানেক পর একটু সাহস সঞ্চয় করে আমি যখন খবরের কাগজগুলো পড়েছি, ছবিগুলো নতুন করে দেখেছি, তখন আমি বুঝতে পেরেছি বিশ্বজিৎ লাল শার্ট পরেনি, রক্তে ভিজে তার শার্ট লাল হয়েছিল। দেশের সব মানুষের মতো আমার মনেও অনেক প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে, খবরের কাগজ, টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান আর সাংবাদিকেরা শুধু ছবি তুলেই তাদের দায়িত্ব পালন না করে বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি কেন? এত কাছে পুলিশ থাকার পরও তারা এগিয়ে গেল না কেন? যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তখন হিপোক্রেটিক শপথ নেয়া চিকিৎসকেরা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল না কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই।
আবার কিছু কিছু ভয়ঙ্কর প্রশ্নের উত্তর আমি অনুমান করতে পারি। যেমন ছাত্রলীগের যে কর্মীরা বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল, তারা দেখেছে চার পাশ থেকে ক্যামেরায় তাদের ছবি তোলা হচ্ছে, তার পরও তারা কেন ক্যামেরার সামনে এই পৈশাচিক উন্মত্ততায় বিশ্বজিৎকে হত্যা করেছে? কিংবা প্রশ্নটি আরো ভয়ঙ্করভাবে করা যায়, চার পাশে ক্যামেরা ছিল বলেই কি তারা এত উন্মত্ত হয়েছিল, যেন সবাইকে দেখানো যায় তাদের সর্বগ্রাসী মতা, কত ভয়ঙ্কর?
সরকার বিশ্বজিৎকে নিয়ে যে নাটক করছে, তা আমরা সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করিনি। নাটকের শেষে সন্ত্রাসীদেরকে ধরতে হলো। জানি না তারা আবার কবে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশের মতো ছাড়া পেয়ে যায়। দুনিয়ার আদালতে বিশ্বজিতের খুনিরা পার পেলেও পরকালের আদালতে পার পাবে না।
হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। সরকার অতীতকে ভুলে গিয়েছে বিধায় বিরোধী দলের যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। আজ যারা মতায় আছেন, যখন তারা বিরোধী দলে ছিলেন, ১৭৩ দিন হরতাল দিয়েছিলেন। আজ যারা বিরোধী দলে তারা যদি আবার মতায় এসে হরতালের বিরুদ্ধে লাঠিপেঠা করেন, মিটিং-মিছিল করতে না দেন, তখন বর্তমান সরকার প্রধান কী বলবেন? বিজয়ের মাসে যে কয়টি হরতাল হয়েছে তার মধ্যে ‘ইতিহাস’ হয়ে থাকবে বামপন্থীদের হরতালটি। ভাবতে অবাক লাগে, সরকার কী করে গণবিচ্ছিন্নদের হরতালকে সমর্থন দিলো। আইনে একটি কথা চালু আছে, আইন সবার ক্ষেত্রে সমান। কিন্তু সরকারের দ্বিমুখী আচরণ দেখে মনে হলো, তা নয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিরোধী দলকে বললেন বামপন্থীদের হরতাল থেকে শিা নেয়ার জন্য। আমরা মন্ত্রীকে বলতে চাই, আপনার দল যখন বিরোধী দলে, তখন শাহবাগে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করা হলো। আমরা অন্যকে শিা নিতে বলতে খুবই ওস্তাদ কিন্তু নিজে শিা নিই না। বামপন্থীদের হরতালের দিন মিডিয়ার বদৌলতে গোটা জাতি দেখেছে যে, পুলিশ কিভাবে রাজপথের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল, সরকার বিআরটিসি গাড়িগুলো বন্ধ করে দিয়েছিল। বিরোধী দলের হরতালের দিন ঝুঁকি নিয়ে হলেও গাড়িগুলো চলত, সেদিনের হরতালে সে গাড়িগুলো রাস্তায় নামতেই দেয়া হয়নি। এ থেকেই কি প্রতীয়মান হয় না যে, সরকার হরতাল শত ভাগ সমর্থন করে চরম নীতিহীনতার পরিচয় দিয়েছে?
যে পুলিশের হরতালের নাম শুনলেই গায়ে ‘আগুন লেগে যায়’, তাদের সামনে শাহবাগের মোড়ে বামপন্থীরা গান গেয়ে হরতাল পালন করল, গাড়ি ভাঙচুর করল অথচ তারা নীরব দর্শক ছিল। এটি জাতির জন্য এক অশনি সঙ্কেত। দুই দিন পরে ইসলামি সমমনা ১২ দল যখন হরতাল দিলো তখন পুলিশ তাদের করল লাঠিপেঠা। সে দৃশ্য বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে সত্যিই ভাবিয়ে তুলবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে সরকার যা করছে স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে অবশেষে তা জাতির সামনে ফাঁস হয়ে গেল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংলাপ আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, নোবেল পুরস্কার যদি দেয়া যেত তাহলে আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দেয়া উচিত। কারণ সাংবাদিকতায় তিনি খুব সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন।
বিচারপতির স্কাইপ সংলাপ আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সরকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। তিনি পত্রিকা কার্যালয়ে বন্দীর মতোই অবরুদ্ধ হয়ে আছেন। এ থেকে কি বলা যায় না যে, সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেও খর্ব করার চেষ্টা করছে। গত ২০ ডিসেম্বর আমার দেশ পত্রিকায় মন্তব্য প্রতিবেদনে মাহমুদুর রহমান এক অবরুদ্ধ চান্স সম্পাদকের জবানবন্দীতে মিডিয়াতে টকশোর সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন তা প্রণিধানযোগ্য। সরকারের লেজুড় টকশো হোস্ট এবং ‘দলবাজ’ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক অবলীলাক্রমে দাবি করছেন, ইকোনমিস্টে স্কাইপ সংলাপবিষয়ক সংবাদ নাকি ছাপাই হয়নি। কেবল আমার দেশ সংলাপ প্রকাশ করে মহাঅপরাধ করে ফেলেছে। মিথ্যাচারেরও সীমা থাকা দরকার। ইকোনমিস্টে কেবল সংবাদই ছাপা হয়নি, সে সংখ্যাটি ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্র সরকারের এজেন্সি তার সব কপি বাজেয়াপ্ত করেছে।
সেসব মহাপণ্ডিত অভিমত দিচ্ছেন যে, আমার দেশ কথোপকথন ছাপলেও সংশ্লিষ্ট বিচারপতির মতামত নিয়ে ছাপা উচিত ছিল। ইকোনমিস্ট সেই কাজটি করতে চাওয়াতেই তো বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম রুল দিয়ে এর কণ্ঠরোধের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। আমার দেশ তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলে কি আর রে ছিল?
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ময়লার গাড়ি পোড়ানোর ভুয়া মামলায় গ্রেফতার করা হলো। অন্য দিকে কারাবন্দী নন, কিন্তু অন্যদের মতো মুক্ত স্বাধীনও নন জাতীয়তাবাদী দলের দফতর সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। অবরুদ্ধ হয়ে আছেন দলের প্রধান কার্যালয়ে। গত ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের অবরোধের দিন থেকেই আটকা পড়ে আছেন তিনি। ১৩টি দিন পার হয়ে গেছে রিজভীর অবরুদ্ধ দিনযাপনের। অর্ধাহারে বা রুটি-বিস্কুট খেয়ে দিন কাটছে তার। নেই ঘুমোনো বা গোসলের ব্যবস্থা। এভাবেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন বরেণ্য এই সাবেক ছাত্রনেতা।
আমরা সরকারকে বলব, বিরোধী দলের সব রাজবন্দীকে মুক্তি আর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে আগামী দিনে জাতিকে সুন্দর নির্বাচন উপহার দিন। দেশকে রা করুন সঙ্ঘাতের হাত থেকে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন