ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র হিসেবে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব-উল আলম হানিফ প্রতিনিয়ত বিরোধী দলের বিরুদ্ধে নানা হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন। বিরোধী দলের নেতাদের কঠোরভাবে দমনের হুমকির পাশাপাশি তাদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। কার পরিণতি কেমন হবে তা-ও জানিয়ে দিচ্ছেন। দেশের সঙ্ঘাতময় রাজনীতিতে তাদের এসব বক্তব্য নিঃসন্দেহে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আরো ুব্ধ করে তুলছে। অপর দিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভাবতে পারেন, কিভাবে বিরোধী দলকে ভয় দেখিয়ে শায়েস্তা করতে হয় তাতে এই দুই নেতা যথেষ্ট যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারছেন। সম্প্রতি আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে তাদের পরিণতি হবে ফখরুলের মতো, তা তিনি যত বড় শীর্ষ নেতাই হোন। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করলে সরকার আগামীতে হার্ডলাইনে যাবে। আইন প্রতিমন্ত্রীর মতে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব একজন সন্ত্রাসী ব্যক্তি।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের ময়লা পরিবহনের কাজে নিয়োজিত একটি গাড়ি ভাঙচুরের মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এরপরও আইন প্রতিমন্ত্রীর মত হচ্ছে, সরকার এখনো হার্ডলাইনে যায়নি। বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেফতার, গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে টর্চার করা কিংবা গুম করে ফেলার পরও যদি তা হার্ডলাইন না হয়; সামনে সরকার যে আরো কতটা হার্ড হতে পারে তা ভাবতেও ভয় হচ্ছে। তার এই বক্তব্যের পর সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের রাস্তায় পিটিয়ে মারার মতো হার্ডলাইন হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সরকার বিরোধী দলের সব নেতাকর্মীকে এখন সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করছে। এর মধ্যে প্রধান বিরোধী দলের মহাসচিবও বাদ যাচ্ছেন না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মতো একজন সন্ত্রাসীর রাজনৈতিক অতীত আমাদের দেখা দরকার। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে লেখাপড়া করেছেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন। সরকারি চাকরিও করেছেন। ছিলেন ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম অফিসার। হয়তো রাজনীতির নেশার কারণে সরকারি চাকরি ছেড়ে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ঠাকুরগাঁও পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কৃষি ও বিমান প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এখন হয়ে গেছেন সন্ত্রাসী।
অপর দিকে আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের এমন রাজনৈতিক অতীত আমরা দেখছি না। আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তার যে পরিচয় দেয়া আছে, সেখানেও তার রাজনৈতিক অতীতের কোনো বর্ণনা নেই। বলা হয়েছে, বিএ পাস করে তিনি আইন বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের দেরাদুনে বিএলএফের প্রথম ব্যাচের সদস্য হিসেবে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যোগাযোগ থাকার অভিযোগও সংবাদপত্রে এসেছে।
আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটর বা পিপি। একটি হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে সে সময় তিনি প্রথম আলোচনায় আসেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দেশে অনেক চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি ছিল ডিবি অফিসে পুলিশের সোর্স ও গাড়িচালক জালাল হত্যা। ১৯৯৯ সালের ২৫ মার্চ ৩৬, মিন্টো রোডের ডিবি পুলিশের কার্যালয়ের দোতলার ছাদের পানির ট্যাঙ্কি থেকে পুলিশের সোর্স জালালের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে হত্যা মামলা হয়, কিন্তু এই মামলা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকে এ সংক্রান্ত খবর ২০০১ সালের ১১ ও ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়।
এতে পুলিশ ও তৎকালীন পিপির যোগসাজশে জালাল হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত ও বিঘিœত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা প্রসঙ্গে পুলিশ আদালতকে জানিয়েছিল, নিহত জালালের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ। কিন্তু পত্রিকার প্রতিবেদকেরা জালালের বাসায় গিয়ে তার স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন। পরিবারের সদস্যদের উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, আসামিপক্ষ ৮-১০ লাখ টাকার বিনিময়ে আদালতে শেখানো সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছিল, পিপি কামরুল ইসলাম না ডাকা পর্যন্ত জালালের পরিবারের সদস্যদের দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, জালালের পরিবার নিখোঁজ নয়, তাদের অন্ধকারে রেখে মামলার স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম ব্যাহত করা হচ্ছে।
এ রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচারপতি আলী আসগর খান ও বিচারপতি এস কে সিনহার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাদের স্বতঃপ্রবৃত্ত (সুয়োমোটো) মামলার রায়ে জালাল হত্যা মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করে এক সপ্তাহের মধ্যে একজন উপযুক্ত অতিরিক্ত পিপি বা সহকারী পিপিকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার জন্য সলিসিটরকে নির্দেশ দেন। পিপি কামরুল ইসলাম যথাযথ ও সততার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেননি বলে হাইকোর্ট মন্তব্য করেন।
পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কামরুল ইসলাম সাফল্য দেখানো দূরে থাক, তার বিরুদ্ধে মামলা ধামাচাপা দেয়ার গুরুতর অভিযোগ এবং উচ্চ আদালত থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এর পরও তাকে অবশ্যই একজন পরম ভাগ্যবান ব্যক্তি বলতে হবে যে, তিনি শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের আইন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। আইনসংক্রান্ত রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব তার কাঁধে পড়েছে। বিচার বিভাগের ওপর তার এখন অপরিসীম ক্ষমতা। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া স্কাইপ সংলাপেও বিচার বিভাগের ওপর তার প্রভাব বিস্তারের কথা এসেছে।
পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কামরুল ইসলাম দুর্নাম কুড়ালেও আইন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি একজন সফল ব্যক্তি। মওদুদ আহমদ, টি এইচ খান, আবদুর রাজ্জাকের মতো আইনজীবীকে তিনি প্রায়ই পাগলের সাথে তুলনা করেন; এমনকি ছাগল বলেও গালি দেন। এমন যোগ্যতর ব্যক্তি মির্জা ফখরুল ইসলামকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সন্ত্রাসের অভিযোগে ফখরুল ইসলাম যখন কারাগারে তখন আইন প্রতিমন্ত্রীর মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় দেশের একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ কুমার বিশ্বাস কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আইনিপ্রক্রিয়ায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। অপর দিকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, ৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। সীমান্তবর্তী জেলার ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়ে থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথ করে দেয়া হয়েছে। পার্থক্য হচ্ছে, জালাল হত্যা মামলার ধামাচাপা দেয়ার ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার লেনদেনের অভিযোগ ছিল। আর বিকাশের ক্ষেত্রে ৫০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। শুধু টাকা নয়, বিকাশরা আগামী দিনে রাজনৈতিক এজেন্ডাও বাস্তবায়ন করবে। রাজনীতির মাঠেও তাদেরকে দেখা যাবে। এর মহড়া হিসেবে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের দিন বিকাশের শিষ্যদের রাজপথে দেখা গেছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ জামিন পেলেও মির্জা ফখরুল নিম্নœআদালত থেকে জামিন পাননি। তাকে আরো দু’টি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন প্রবল আশঙ্কা, বিরোধীদলীয় নেতাকেও হয়তো এখন কারাগারে পাঠানো হবে। কারণ হানিফ-কামরুলরা এখন বিরোধীদলীয় নেতাকে কারাগারে পাঠানোর হুমকি দিচ্ছেন। তাকে নাকে খত দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কথা বলছেন। জিয়াউর রহমানের পর এবার তাকেও পাকিস্তানের চর আখ্যা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই নেতারাই এখন সরকারের নীতিনির্ধারক। এ কারণে তাদের এই হুমকি উড়িয়ে দেয়া যায় না।
দেশে এখন এক দিকে সন্ত্রাসীরা দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অন্য দিকে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে জেলে পোরা হয়েছে। বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে হাত ভেঙে ফেলা, চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়া, পায়ের নখ উপড়ে ফেলার মতো অভিযোগ এসেছে। সরকারের খুদকুঁড়ো খাওয়া গণমাধ্যমের একটি অংশ নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনকেও সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে তুলে ধরার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনকি নিরপেক্ষতার মুখোশ পরা সুশীল গণমাধ্যমেরও আমরা একই চেহারা দেখছি। অথচ এক সময়ের বাম সতীর্থ মির্জা ফখরুলকেও যখন সন্ত্রাসী বানানো হয় তখন এই গণমাধ্যমও নিশ্চুপ।
বাংলাদেশ এখন এক অদ্ভুত সময় অতিক্রম করছে। সন্ত্রাসী হয়ে যাচ্ছে ভালো মানুষ। সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিরা হয়ে যাচ্ছেন অপরাধী। যার আসামি হওয়ার কথা তিনি হয়ে যাচ্ছেন রাজসাক্ষী। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও এখন ভাবনাচিন্তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক রাজনৈতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা তারা দেখাতে পারছেন না। বিরোধী দলকে গালিগালাজের মাধ্যমে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইছেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে আত্মসমর্পণ করার কথা বলছেন। তার সাথে সুর মিলিয়ে হানিফ বলেছেন, তাকে নাকে খত দেয়ানো হবে। কৃষিমন্ত্রী জামায়াত নেতাদের সম্পর্কে বলেছেনÑ তারা অস্ত্রের ব্যবসায় করে, নারীর দেহ ব্যবসায় করে, তাদের কাছে গরুর মাংস আর নারীর মাংস সমান কথা। হায় মতিয়া চৌধুরী! এই জামায়াত নেতাদের সাথে একসাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেক বৈঠক হয়েছে। তখন তার রাজনৈতিক বয়স কিছুটা কম ছিল এই আর কি। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এখন শুধু এ ধরনের লাগামহীন বক্তব্য দিচ্ছেন। তাদের এসব বক্তব্যের প্রতিফলনও ঘটছে। মতিয়া চৌধুরীদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে কামরুল ইসলাম ও মাহবুব-উল আলম হানিফ আর দীপু মনিরা এখন ক্ষমতাসীন দলের কাণ্ডারি। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ভাগ্য শুধু তারা নিয়ন্ত্রণ করছেন না, দেশের ভাগ্যও নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের যোগ্য শাসনে আওয়ামী টাইমমেশিনে চড়ে বাংলাদেশ চলছে উল্টোপথে। ফিরে যাচ্ছে ’৭২-৭৫ সময়ে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন