বুধবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১২

বিশ্বজিতের আকুতি ও নৈরাজ্যের রাজনীতি


বাংলাদেশে রাজনৈতিক হঠকারিতা নতুন নয়। পৈশাচিকতা ও তাণ্ডব সৃষ্টির উপমাও মেলে। কিছু বর্বরতার ইতিহাসও আছে। নৃশংসতা কাকে বলে তার সাথেও আমরা পরিচিত। খুন করে লাশের ওপর নৃত্য করার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। ভিন্ন মতকে অসহ্য জ্ঞান করে কতটা হিংস্র হতে পারি তার নজিরও আমরা কম সৃষ্টি করিনি। বিশ্বজিৎ যেন স্মরণ করিয়ে দিলো এ মানচিত্রে ক্ষমতার পক্ষপুটে থাকা অমানুষগুলো এখনো দানবীয় দাপট দেখাতে পারে।

বিশ্বজিৎ দাস যখন চোখে অন্ধকার দেখছিল, তখন চিৎকার করে বলছিল, আমি হিন্দু, বিএনপি করি না, আপনাদের পায়ে পড়ি আমাকে মেরে ফেলবেন না। তার এই আকুতি ও করজোড়ে মিনতি খুনিদের নিবৃত করেনি, তার পরও তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারতে থাকল পাষণ্ডরা। রক্তাক্ত শরীর নিয়ে যখন বিশ্বজিৎ দিশেহারা, তখনো তাকে রড দিয়ে পিটিয়েছে নরপশুরা। মাটিতে শুইয়ে পড়ার পরও পাষণ্ডরা বিশ্বজিৎকে লাঠির আঘাত করে যাচ্ছিল, সেই সাথে উল্লাস করছিল মানুষরূপি ওসব হায়েনারা। বিশ্বজিৎ যখন হামাগুড়ি দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করছিল, তখনো ওসব দানব তার রক্তাক্ত শরীরে লাথি-ঘুসি মেরেছে। জীবন বাঁচাতে বিশ্বজিৎ একবার মরণপণ দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করেছিল, ততক্ষণে তার শরীরের রক্ত প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে, শত চেষ্টা করেও পারেনি। একপর্যায়ে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। যাদের রোষের শিকার হলো বিশ্বজিৎ, তাদের নাম ছাত্রলীগ। এই সব ছাত্রলীগ কর্মী কিংবা ক্যাডাররা পুলিশের ছত্রছায়ায় অবরোধ কর্মসূচি পালনরত বিরোধীদলীয় কর্মী শিকারে বেরিয়েছিল। এরাই ‘সোনার ছেলে’ হিসেবে পরিচিত। এই সরকারের মধুচন্দ্রিমার সময় থেকেই এই সব সোনার ছেলের ভেতর এমন এক সর্বগ্রাসী ুধা জাগিয়ে দেয়া হয়েছিল, তাদের পশুত্ব পেয়ে বসেছিলÑ হেন অনিয়ম নেই তারা করেনি। তারা যখন সর্বনাশা ও ভয়ঙ্কর দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী সেই সব দস্যুবৃত্তিকে দস্যিপনা ভেবে অভিমান করে নেতৃত্ব ছেড়ে দায়মুক্ত হওয়ার ভান করেছিলেন। সেই ইতিহাস এখনো ম্লান হয়নি। সেই সোনার ছেলেদেরকেই প্রতিপক্ষ ঠেঙানোর আহ্বান জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশের সাথে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন। তারই বলি হলো বিশ্বজিৎ।
বিশ্বজিতের ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। এর আগে মাত্র ১৩-১৪ বছরের এক মাদরাসাপড়–য়া ছাত্রকে উত্তরায় ছাত্রলীগ কর্মীরা পিটিয়ে যখম করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে গেলে শিশুটি চিৎকার করে বলছিল, আমি জামায়াত-শিবির না, মাদরাসার কেতাব কিনতে বেরিয়েছি। পাষণ্ডরা তার কোনো কথা শোনেনি। একইভাবে রাজপথ অতিক্রম করার জন্য মধ্য বয়সী ভদ্রলোক ছাত্রলীগ ক্যাডারদের চোখে পড়ে যায়। সে দিন ছিল বিরোধী দলের কর্মসূচি। ভদ্রলোকের অপরাধ, মুখে ছিল দাড়ি। মাথায় ছিল টুপি। আর যায় কোথায়! টুপি-দাড়ি মানেই জামায়াত-শিবির। ভদ্রলোককে গণপিটুনি দেয়া শুরু হলো। কী পৈশাচিক উল্লাস করে তারা ভদ্রলোককে মেরে অজানা এক আদিম সুখ পাচ্ছিল! শেষ পর্যন্ত জানা গেল ভদ্রলোক কোনো দলই করেন নাÑ একজন ব্যবসায়ী মাত্র।
উত্তরবঙ্গের কোনো এক মসজিদের ইমাম। জুমার খোতবায় জালেমের মোকাবেলায় মজলুমের বিজয় কামনা করে বক্তব্য দিচ্ছিলেনÑ একজন মুসল্লি তাৎক্ষণিক তাকে বিশেষ দলের লোক বলে সম্বোধন করে গালি দেয়া শুরু করল। তার পরের ঘটনা আরো বীভৎস। তার গায়ে হাত তোলা হলো। ইমামতি থেকে বিদায় করে দিয়ে মসজিদকে ‘জামায়াতি’মুক্ত করার উল্লাস প্রকাশ করল। স্থানীয় লোকদের সাক্ষ্য ছিল, ইমাম সাহেব কওমি মাদরাসাপড়–য়া একজন আলেম। রাজনীতি তার ধাতে নেই। বরং ভিন্ন সুরে জামায়াতের সমালোচক, কিছুটা তাবলিগ ঘেঁষাও।
তার পরের ঘটনা কিছুটা ব্যতিক্রম, সেই সাথে ব্যথাতুর ও লজ্জার। ঘটনাস্থল নিউমার্কেট এলাকা। কম বয়সী এক তরুণী মাথায় স্কার্ফ, গায়ে শালীন পোশাক। একদল ছাত্রলীগ ক্যাডার তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা শুরু করল। একপর্যায়ে শিবির বানিয়ে হেনস্তা করে দেয়ার হুমকি দিলো। মেয়েটি জানান দিলো তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার মামা একসময়ের সরকারদলীয় নেতা। তাতেও উচ্ছৃঙ্খল যুবক দল খামোশ হলো না। শেষ নাগাদ মেয়েটি প্রাণ হাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে জনাকীর্ণ মার্কেটে লোকচুর আড়ালে লুকাতে চেষ্টা করল। জানি না শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল।
ইহুদিরা যেভাবে বায়তুল মোকাদ্দাস ঘেরাও করে রাখে, ইসরাইলি পুলিশ ও সৈন্যরা যেভাবে বন্দুক তাক করে সাঁজোয়া বহর নিয়ে মসজিদটি পাহারা দেয়, এই সরকারের আমলে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের জুমাবারের দৃশ্য আলাদা কিছু নয়। গেল শুক্রবারের ঘটনা। জুমার নামাজ পড়ার জন্য মুসল্লিরা মসজিদের দিকে ছুটছিল। পথ আগলে দাঁড়াল সাদা পোশাকের একজন পুলিশ। তার পাশে পোশাকধারী র‌্যাব সদস্যরা দাঁড়ানো। পাশ থেকে এগিয়ে এলো চার যুবক। তারা নিজেদের ছাত্রলীগের লোক বলে পরিচয় দিয়ে তিন মুসল্লির দিকে ইঙ্গিত করে বলছিল ওরা মৌলবাদী দলের লোক। তখনই পুলিশ তাদের পাকড়াও করল। তারা বারবার বলছিল তারা কোনো দল করে না, সাধারণ মুসল্লি। প্রতি শুক্রবার জাতীয় মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে আসেন। ছিদ্দিকবাজারে তাদের পৈতিৃক বিদ্যুৎ সরঞ্জামের দোকান আছে। পুলিশ তাদের কোনো কথা শুনল না। তাদের টেনে-হিঁচড়ে পুলিশ ভ্যানে তুলে নিলো। তারপর তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে আমরা জানি না। হয়তো তারা গ্রেফতার-বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন, নয়তো আইনের শাসন ও ন্যায় ইনসাফের বিপরীতে অপশাসনের কারণে জেলে কষ্টের জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছেন।
দুই সপ্তাহ আগের ঘটনা, প্রেস কাবের সামনে অনেক মানববন্ধনের সারি। দুইজন আলেম মফস্বল থেকে এসেছেন, ঢাকায় তাবলিগ জামায়াতের জোড়ের জামায়াত শেষে স্বজন-দর্শনে বেরিয়েছেন। পুলিশ তাদের দিকে তাকালও না, পাশ দিয়ে যাচ্ছিল অবরোধবিরোধী টোকাই মিছিল। নেতৃত্ব দিচ্ছিল ছাত্রলীগের ক’জন হোমরাচোমরা। হঠাৎ তারা দুইজন আলেমের ওপর হামলে পড়ল। তাদের অপরাধ দাড়ি, টুপি ও লম্বা জামা। তারা বারবার বলছিল আমরা তাবলিগের লোক, তার পরও তাদের টানা-হ্যাঁচড়া করে অপদস্থ করা হলো। পুলিশ ছিল দর্শক এবং নির্বিকার।
বিরোধী দল আহূত হরতালের আগের রাতের ঘটনা। লালমাটিয়া এলাকায় একটি মেসে ছাত্ররা জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ ছাত্রলীগের স্থানীয় একজন ক্যাডারের নেতৃত্বে পুলিশ দল মেসে হামলে পড়ল। তাদের হিজবুত তাহরীরের কর্র্মী সাজিয়ে থানায় নিয়ে গেল। অতঃপর তারা মানুষ কিংবা নাগরিকের ইনসাফ ও আইনের আশ্রয় পেয়েছিল না হিজবুত তাহরীর সাজিয়ে জেলে পুরেছিল  জানি না,  তবে জাতীয় দৈনিকে পরদিন খবর বেরিয়েছিল তারা সাধারণ ছাত্র, অপরাধ পাশের মসজিদে মাঝে মধ্যে নামাজ পড়ে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক’জন প্রফেসর হজে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্বে অপরাপর টিম সদস্যদের নিয়ে প্রস্তুতির বিষয়আশয় নিয়ে একজন হজে গমনেচ্ছুর বাসায় আলাপ করছিলেন। হঠাৎ ছাত্রলীগের এক ক্যাডার পুলিশকে পথ দেখিয়ে নিয়ে বাসার ভেতর আসে। সম্মানিত এসব শিক্ষককে কথায় পুলিশ কান দিলো না। জামায়াতের গোপন বৈঠকের অভিযোগ এনে তাদের গ্রেফতার করে তাৎক্ষণিক স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়া হলো।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, অফিস-আদালত, হাট-বাজার সর্বত্র কারো সাথে শত্রুতা উদ্ধারের কৌশল হচ্ছে, জামায়াত-শিবির, হিজবুত তাহরীর কিংবা অন্য কোনো ইসলামপন্থী সাজিয়ে দেয়া। গ্রামেগঞ্জে পর্যন্ত জায়গা জমিন নিয়ে মামলার জের ধরে সরকারের প্রতিপক্ষ সাজিয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেয়নি তারা সেজে গেছে মুক্তিযোদ্ধা। আর যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে, সমর্থন জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত করেছে তাদের দাড়ি-টুপির কারণে রাজাকার সাজিয়ে দেয়া হচ্ছে। নামাজিরাও সন্দেহের তালিকায়।
এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উসকানিমূলক আচরণ করে সর্বত্র একধরনের নৈরাজ্যের জন্ম দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে যে সামাজিক সঙ্কট ও অস্থিরতার জন্ম দেয়া হয়েছে, তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। জাতিকে যেভাবে বিভক্ত করে দিয়ে আধিপত্যবাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তার শেষ যে লেন্দুপ দর্জির সিকিমের মতো পরিণতিই হবে না তার নিশ্চয়তা তো কেউ দিচ্ছেন না।
গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা না থাকলে কোনো জাতির শাসকশ্রেণী এমন আত্মঘাতী মারণখেলায় নেমে পড়তে পারে না। এটা স্বাধীনতা অর্জনের মাস। বিজয় দিবস জাতিকে বিভক্ত করার প্রেরণা জোগায় না। এ দেশের মাটি-মানুষের বোধ-বিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রƒপ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে না। দেশে দেশে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় নেতারা ঐক্যের আহ্বান জানান। ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ার  প্রেরণাদায়ক গল্প শোনান। অগ্রগতির প্রেরণা জোগান। শুধু বাংলাদেশই খতম করে দেয়ার ঘৃণ্য ও বিদ্বেষী আহ্বান জানানো হয়। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার প্রজাতন্ত্রের সন্তানতুল্য নাগরিকদের বিরুদ্ধে এভাবে উগ্রতা ও হিংসার বিষ ছড়িয়ে দেয় না। জানি না কোন পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বিশ্বজিৎকে নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম, প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বিব্রতকর ঘটনা টানলাম ছাত্রলীগকে দুষবার জন্য নয়। ছাত্রলীগকে দুষবার চেষ্টা করলে বেশুমার ঘটনা জানা যাবে। এমন কোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ছাত্রলীগ তাণ্ডব সৃষ্টি করেনি। প্রশাসনের কর্মকর্তা ও পুলিশসহ সব শ্রেণীর মানুষকে তারা লাঞ্ছিত করেছে। স্থানীয় প্রশাসন তাদের ভয়ে তটস্থ। অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দেয়া যেন তাদের অহঙ্কার। এসব অপকর্ম আশকারা দেয়াই যেন সরকারের দায়। জানি না এত দায় পরিশোধ করার  মতো সময় সরকার পাবে কি না। তবে ধর্মের কল যেভাবে বাতাসে নড়ছে তাতে বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয় যে, দাম্ভিক মানুষেরা ক্ষমতার জোরে যা চায় তা হয় না, বিধাতা যা চান তাই হয়।
digantaeditorial@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads