মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
অর্থনীতি, ব্যবসানীতি, সমাজনীতিসহ সব নীতির নিয়ামক শক্তি হলো রাজনীতি। রাজনীতি অনিশ্চিত তো সবকিছুই অনিশ্চিত। সুস্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এক ভয়ানক অনিশ্চয়তার পথে ধাবিত হচ্ছে দেশের চলমান রাজনীতি।
প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষ ও র্যাব-পুলিশের সামনে বিশ্বজিত্ দাসকে চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তাত্ক্ষণিক গ্রেফতার, নির্ভীক সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া, খালেদা জিয়াকে একের পর এক গ্রেফতারের হুমকি প্রদান—নিঃসন্দেহে রাজনীতিতে তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয়, সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হবে এবং দেশের রাজনীতি কোন দিকে ধাবিত হবে। সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপ গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেই তৈরি করতে হবে বিরোধী দলের আগামী দিনের ‘রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি’।
নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে বিরোধী জোটের সঙ্গে শাসক দলের দূরত্ব এখন চরমে। এই ইস্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বিরোধী জোট তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরবে না। সরকারও তার সিদ্ধান্তে অটল। এই পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থায় কার্যত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পথ বেরিয়ে আসছে না।
আগামী নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যাপারটি শাসক দলের মনে হয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই ‘রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি’ নির্ধারণ তাদের জন্য সহজ হচ্ছে। হয় দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন, না হয় অন্য বিকল্প কিছু—এ চিন্তা মাথায় নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। তারা বিরোধী দলের রাজনীতি স্তব্ধ করে দিতে চায়, কণ্ঠরোধ করতে চায় গণমাধ্যমের; দেশকে নিয়ে যেতে চায় সেই সত্তরের দশকের অন্ধকার রাজনীতির যুগে।
দেশে কোনো নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং দেশকে উল্টো সুকৌশলে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, একটা ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে, রক্ত ঝরছে; মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষালয়ও। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, রাজনীতির আকাশে শুধুই অশনিসঙ্কেত; সবকিছু নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সঙ্কটের আবর্তে। মানুষের মনে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস ও উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা—কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, কী হতে যাচ্ছে দেশে। দেশ কি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে? প্রথিতযশা সাংবাদিক ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা তো এমনই আশঙ্কা করছেন। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে গৃহযুদ্ধের পথেই দেশ ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
চার বছরের মাথায় এসে হাজারো প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখোমুখি সরকার। মানুষের স্বপ্ন এখন দুঃখ ও বেদনায় পরিণত হয়েছে। তাই অবস্থা বুঝে সরকার বেপরোয়া হয়ে অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং এটাকেই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকা ও আবার ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। দেশের কোথাও কিছু ঘটলে সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অকারণে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার করে চরম হেনস্থা করছে। সরকারের দমননীতির মুখে বেপরোয়া পুলিশের হাতে রাস্তায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা মার খাচ্ছেন, নাজেহাল হচ্ছেন এবং রিমান্ডে যাচ্ছেন। যত নাজেহাল এবং নির্যাতন করুক, এতে শেষ রক্ষা হবে না; রাজনীতিবিদরা রুখে দাঁড়ালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা সরকারকে করতেই হবে। নয়তো বাধাগ্রস্ত হতে পারে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ধারা। মানুষ হারাতে পারে তাদের ভোটের অধিকার, দেশ হতে পারে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন।
দেশকে অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে গঠনমূলক, সহনশীল ও পরিপকস্ফ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। আপনি কত বড় রাজনীতিবিদ সেটি বড় কথা নয়, আপনার কর্মকাণ্ড দেশের জন্য কতটা ইতিবাচক ও মঙ্গলজনক—জাতির কাছে সেটিই বড় বলে বিবেচিত। জাতির কাছে একটি সত্য দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে, বর্তমান সরকার ইচ্ছা করলে দেশকে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
সাংঘর্ষিক ও প্রতিশোধমূলক রাজনীতি পরিহারের জন্য স্থিতিশীল আবহ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু জাতি শাসক দলের কাছ থেকে তেমন দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যক্ষ করছে না, বরং কঠিন মারপ্যাঁচের জালে রাজনীতিকে আটকে ফেলার দুরভিসন্ধি নিয়ে শাসক দল অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে যা কিছু ঘটে চলেছে, তা এক পরিকল্পিত দুরভিসন্ধিরই বাস্তবায়ন বলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার শাসক দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র যোগ্যতা, এ ইস্যুর সুস্পষ্ট বেনিফিশিয়ারি বর্তমান শাসক দল; এর মাধ্যমে তারা বিরোধী রাজনীতিকে কোণঠাসা করে রাখার প্রাণান্তকর ও ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও নজিরবিহীন ব্যর্থতা থেকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে তারা।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সব মহলেই উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কেননা এ নির্বাচনের ওপর দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। দেশে অরাজকতা সৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত করে নির্বাচন বানচালের মাধ্যমে বর্তমান শাসক দলের একাধিক স্বার্থ হাসিল হতে পারে। যেমন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া রুখে দেয়া, দেশে সর্বগ্রাসী সঙ্কট, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, রেল মন্ত্রণালয়ের কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারিসহ আরও অসংখ্য কেলেঙ্কারি ও সীমাহীন দুর্নীতি এবং নজিরবিহীন ব্যর্থতার মাধ্যমে শাসক দলের গায়ে যে দুর্নীতির কালিমা লেগেছে তা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার সুযোগ পাওয়া, জামায়াত-শিবিরকে দমনের নামে জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দুই শিবিরে বিভক্ত করা, নিস্ক্রিয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ দখলে নেয়া ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, অরাজকতার মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কি জনমত পক্ষে আনা যায়? নাকি মানুষের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পায়? শেষ পর্যন্ত এ দুর্ভোগের দায়ও শাসক দলকেই নিতে হয়, যেমন অতীতে অন্য দল নিয়েছে।
জনসভা, গণমিছিল ও গণসংযোগ এবং মানববন্ধনসহ বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অবধারিতভাবে প্রমাণ হয়েছে জনগণ বিএনপির পক্ষে আছে। এখন এই জনগণের শক্তিকে বিএনপি কীভাবে এবং কোন কাজে ব্যবহার করবে—এই কৌশল বিএনপিকে ঠাণ্ডা মাথায় প্রণয়ন করতে হবে।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম থেকে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
কোন কাজটি এখন, এই মুহূর্তে করতে হবে এবং কোনটির জন্য করতে হবে অপেক্ষা, রাজনীতিতে এটি নির্ধারণ করা জরুরি। চলমান রাজনীতিকে এলোমেলো করে দেয়ার একটা প্রক্রিয়া চলমান। এসব ব্যাপার বিএনপির রাজনৈতিক ভাবনায় থাকতে হবে।
রাজনীতিতে একটা কথা বিবেচনায় রাখা অনস্বীকার্য যে, কোনো একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব রকম শক্তিশালী মানুষ মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনিই হয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর দুর্বলতম মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর ‘খেলা শুরু হয়েছে’ বক্তব্যের সূত্র ধরে বলতে চাই, রাজনীতিতে যে যত খেলাই খেলুন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পথেই ফিরে আসতে হয়; নির্বাচন ছাড়া রাজনৈতিক দলের সামনে বিকল্প কোনো পথ নেই। নির্বাচন অনিশ্চিত তো রাজনীতিকদের জীবনও অনিশ্চিত।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় এটা অবধারিত সত্য। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ঠিক একই ধরনের বা মাত্রায় হয় না। এবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা হবে আরও ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর। কাজেই সময় থাকতে পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করার দিকে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে। যাতে সংঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়ানো সম্ভব হয়। যাতে সুস্থ রাজনীতির ধারা দেশে ফিরে আসে। যাতে সামনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com
প্রকাশ্যে হাজার হাজার মানুষ ও র্যাব-পুলিশের সামনে বিশ্বজিত্ দাসকে চাপাতি দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তাত্ক্ষণিক গ্রেফতার, নির্ভীক সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া, খালেদা জিয়াকে একের পর এক গ্রেফতারের হুমকি প্রদান—নিঃসন্দেহে রাজনীতিতে তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। এতে সহজেই প্রতীয়মান হয়, সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হবে এবং দেশের রাজনীতি কোন দিকে ধাবিত হবে। সরকারের রাজনৈতিক পদক্ষেপ গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেই তৈরি করতে হবে বিরোধী দলের আগামী দিনের ‘রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি’।
নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে বিরোধী জোটের সঙ্গে শাসক দলের দূরত্ব এখন চরমে। এই ইস্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বিরোধী জোট তার অবস্থান থেকে এক চুলও সরবে না। সরকারও তার সিদ্ধান্তে অটল। এই পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থায় কার্যত রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পথ বেরিয়ে আসছে না।
আগামী নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যাপারটি শাসক দলের মনে হয় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই ‘রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি’ নির্ধারণ তাদের জন্য সহজ হচ্ছে। হয় দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন, না হয় অন্য বিকল্প কিছু—এ চিন্তা মাথায় নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। তারা বিরোধী দলের রাজনীতি স্তব্ধ করে দিতে চায়, কণ্ঠরোধ করতে চায় গণমাধ্যমের; দেশকে নিয়ে যেতে চায় সেই সত্তরের দশকের অন্ধকার রাজনীতির যুগে।
দেশে কোনো নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বরং দেশকে উল্টো সুকৌশলে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, একটা ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে, রক্ত ঝরছে; মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষালয়ও। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, রাজনীতির আকাশে শুধুই অশনিসঙ্কেত; সবকিছু নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এক সর্বগ্রাসী সঙ্কটের আবর্তে। মানুষের মনে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাস ও উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা—কোন দিকে যাচ্ছে দেশ, কী হতে যাচ্ছে দেশে। দেশ কি গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে? প্রথিতযশা সাংবাদিক ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদরা তো এমনই আশঙ্কা করছেন। আগামী নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে গৃহযুদ্ধের পথেই দেশ ধাবিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
চার বছরের মাথায় এসে হাজারো প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখোমুখি সরকার। মানুষের স্বপ্ন এখন দুঃখ ও বেদনায় পরিণত হয়েছে। তাই অবস্থা বুঝে সরকার বেপরোয়া হয়ে অবর্ণনীয় দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং এটাকেই তারা ক্ষমতায় টিকে থাকা ও আবার ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। দেশের কোথাও কিছু ঘটলে সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অকারণে হয়রানি, মামলা ও গ্রেফতার করে চরম হেনস্থা করছে। সরকারের দমননীতির মুখে বেপরোয়া পুলিশের হাতে রাস্তায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা মার খাচ্ছেন, নাজেহাল হচ্ছেন এবং রিমান্ডে যাচ্ছেন। যত নাজেহাল এবং নির্যাতন করুক, এতে শেষ রক্ষা হবে না; রাজনীতিবিদরা রুখে দাঁড়ালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা সরকারকে করতেই হবে। নয়তো বাধাগ্রস্ত হতে পারে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ধারা। মানুষ হারাতে পারে তাদের ভোটের অধিকার, দেশ হতে পারে ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন।
দেশকে অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে গঠনমূলক, সহনশীল ও পরিপকস্ফ রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। আপনি কত বড় রাজনীতিবিদ সেটি বড় কথা নয়, আপনার কর্মকাণ্ড দেশের জন্য কতটা ইতিবাচক ও মঙ্গলজনক—জাতির কাছে সেটিই বড় বলে বিবেচিত। জাতির কাছে একটি সত্য দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে, বর্তমান সরকার ইচ্ছা করলে দেশকে যে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
সাংঘর্ষিক ও প্রতিশোধমূলক রাজনীতি পরিহারের জন্য স্থিতিশীল আবহ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু জাতি শাসক দলের কাছ থেকে তেমন দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যক্ষ করছে না, বরং কঠিন মারপ্যাঁচের জালে রাজনীতিকে আটকে ফেলার দুরভিসন্ধি নিয়ে শাসক দল অগ্রসর হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে যা কিছু ঘটে চলেছে, তা এক পরিকল্পিত দুরভিসন্ধিরই বাস্তবায়ন বলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার শাসক দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র যোগ্যতা, এ ইস্যুর সুস্পষ্ট বেনিফিশিয়ারি বর্তমান শাসক দল; এর মাধ্যমে তারা বিরোধী রাজনীতিকে কোণঠাসা করে রাখার প্রাণান্তকর ও ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও নজিরবিহীন ব্যর্থতা থেকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে তারা।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার বিষয়টি এখন সর্বতোভাবে শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে পক্ষপাতহীন নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি দেশও এক অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে সব মহলেই উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কেননা এ নির্বাচনের ওপর দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ভর করছে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। দেশে অরাজকতা সৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত করে নির্বাচন বানচালের মাধ্যমে বর্তমান শাসক দলের একাধিক স্বার্থ হাসিল হতে পারে। যেমন বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া রুখে দেয়া, দেশে সর্বগ্রাসী সঙ্কট, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, রেল মন্ত্রণালয়ের কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারিসহ আরও অসংখ্য কেলেঙ্কারি ও সীমাহীন দুর্নীতি এবং নজিরবিহীন ব্যর্থতার মাধ্যমে শাসক দলের গায়ে যে দুর্নীতির কালিমা লেগেছে তা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করার সুযোগ পাওয়া, জামায়াত-শিবিরকে দমনের নামে জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দুই শিবিরে বিভক্ত করা, নিস্ক্রিয় নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করার মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ দখলে নেয়া ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, অরাজকতার মাধ্যমে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কি জনমত পক্ষে আনা যায়? নাকি মানুষের দুর্ভোগ আরও বৃদ্ধি পায়? শেষ পর্যন্ত এ দুর্ভোগের দায়ও শাসক দলকেই নিতে হয়, যেমন অতীতে অন্য দল নিয়েছে।
জনসভা, গণমিছিল ও গণসংযোগ এবং মানববন্ধনসহ বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে অবধারিতভাবে প্রমাণ হয়েছে জনগণ বিএনপির পক্ষে আছে। এখন এই জনগণের শক্তিকে বিএনপি কীভাবে এবং কোন কাজে ব্যবহার করবে—এই কৌশল বিএনপিকে ঠাণ্ডা মাথায় প্রণয়ন করতে হবে।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম থেকে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
কোন কাজটি এখন, এই মুহূর্তে করতে হবে এবং কোনটির জন্য করতে হবে অপেক্ষা, রাজনীতিতে এটি নির্ধারণ করা জরুরি। চলমান রাজনীতিকে এলোমেলো করে দেয়ার একটা প্রক্রিয়া চলমান। এসব ব্যাপার বিএনপির রাজনৈতিক ভাবনায় থাকতে হবে।
রাজনীতিতে একটা কথা বিবেচনায় রাখা অনস্বীকার্য যে, কোনো একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে কাউকে অসম্ভব রকম শক্তিশালী মানুষ মনে হতে পারে, আবার আরেকটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনিই হয়ে যেতে পারেন পৃথিবীর দুর্বলতম মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর ‘খেলা শুরু হয়েছে’ বক্তব্যের সূত্র ধরে বলতে চাই, রাজনীতিতে যে যত খেলাই খেলুন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের পথেই ফিরে আসতে হয়; নির্বাচন ছাড়া রাজনৈতিক দলের সামনে বিকল্প কোনো পথ নেই। নির্বাচন অনিশ্চিত তো রাজনীতিকদের জীবনও অনিশ্চিত।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় এটা অবধারিত সত্য। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ঠিক একই ধরনের বা মাত্রায় হয় না। এবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে তা হবে আরও ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর। কাজেই সময় থাকতে পরস্পর ভেদাভেদ ভুলে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করার দিকে সবাইকে মনোনিবেশ করতে হবে। যাতে সংঘাত-সংঘর্ষের পথ এড়ানো সম্ভব হয়। যাতে সুস্থ রাজনীতির ধারা দেশে ফিরে আসে। যাতে সামনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন