* যৌথ বিনিয়োগের বিষয়টি আমি জানি না-নৌ-পরিবহন মন্ত্রী * এ ধরনের বিনিয়োগ সম্পর্কে বোর্ড কিছু জানে না -বিনিয়োগ বোর্ড নির্বাহী * এই ঘটনা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি -আমাদের স্বাধীনতা আছে কি না -আনু মোহাম্মদ
টার্মিনাল পোর্ট নারায়ণগঞ্জে নির্মাণের টেন্ডার দিয়েছে ভারত সরকার দিল্লীতে!
Ministry
এইচ এম আকতার, কামাল উদ্দিন সুমন : সরকারের অগোচরে নারায়ণগঞ্জে অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে ভারত সরকার। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ শহরের খানপুরের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের ৪৬ একর জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে এই টার্মিনাল। এরই মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে কারিগরি ও বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য দরপত্রও আহ্বান করেছে। দর প্রস্তাব জমা দেয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৭ জুন বিকাল ৫টা পর্যন্ত। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর (ডিজি শিপিং) ও বিনিয়োগ বোর্ড কারও অনুমোদন নেই। এমনকি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখাসহ বন্দর শাখাও এ বিষয়ে কোনো কিছুই অবগত নয়। এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ বোর্ডেও এ বিষয়ে কোনো আবেদন জমা পড়েনি। এদিকে এধরনের ঘটনাকে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত দরপত্রের টার্মস অব রেফারেন্সে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে ৪৬ একর জমি রয়েছে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল লিমিটেডের। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওই জমিতে একটি অভ্যন্তরীণ নৌ-কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। টার্মিনাল নির্মাণে কারিগরি ও বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ভারত সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ দরপত্র আহ্বান করেছে। দরপত্র বিবরণীতে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের আওতাও তুলে ধরা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নারায়ণগঞ্জের প্রস্তাবিত টার্মিনালের স্থান পরিদর্শন করে একাধিক প্রতিবেদন জমা দেবে। এসব প্রতিবেদনে স্থানীয় বিভিন্ন শিল্পপণ্যের উৎপাদন, বর্তমান প্রবৃদ্ধি, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি প্রকল্পের শক্তি, সম্ভাবনা, দুর্বলতা ও ঝুঁকি বিষয়েও বিশ্লেষণ করতে হবে। এই ধরনের একটি খবর কয়েকদিন আগে দৈনিক মানবজমিন প্রকাশ করেছে।
নারায়ণগঞ্জের আশপাশে আর কোনো অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল রয়েছে কিনা, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে তাও গুরুত্ব পাবে। চলমান কনটেইনার টার্মিনালের সক্ষমতা, কনটেইনার ও কার্গোর ধরনসহ অবকাঠামো ও ব্যয় বিষয়ে আলোকপাত করতে হবে। জমির দাম, তার উন্নয়ন খরচ, অবকাঠামো নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপনে সম্ভাব্য ব্যয়ের একটি চিত্র তুলে ধরতে হবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদনে। একই সঙ্গে থাকবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, টার্মিনাল ভাড়া, ভ্যালু এডেড সার্ভিসসহ অন্যান্য খাত থেকে সম্ভাব্য আয়ের বিবরণীও। এছাড়া টার্মিনাল পরিচালন ব্যয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, কর ও শুল্কসহ আনুষঙ্গিক ব্যয়ের হিসাবও সংযুক্ত করতে হবে। এদিকে কার্যাদেশ পাওয়ার পর ১৪ সপ্তাহের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। ছয় সপ্তাহের মধ্যে অর্ন্তবর্তীকালীন প্রতিবেদন পার্ট-এ, পরবর্তী তিন সপ্তাহে অর্ন্তবর্তীকালীন প্রতিবেদন পার্ট-বি, পরবর্তী তিন সপ্তাহে খসড়া প্রতিবেদন (পার্ট-এ, পাট-বি ও পার্ট-সি) এবং পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে দরপত্রে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আদি ভারতীয় পরামর্শক/পেশাদারদের কাছ থেকে সিলগালা দরপত্র আহ্বান করছে। সেকশন অফিসার (ডিপিএ), রুম নং ৩১৩১, বি উইং, জওয়াহর লাল নেহরু ভবন (জেএনবি), নয়া দিল্লী থেকে ২০০০ রুপির পে-অর্ডারের বিনিময়ে পাওয়া যাবে দরপত্রের ডকুমেন্ট। এ জন্য ‘পে এন্ড একাউন্টস অফিসার, মিনিস্ট্রি অব এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স, নয়া দিল্লী’ বরাবরে এই পে-অর্ডার বা ব্যাংক ড্রাফট জমা দিতে হবে। দরপত্র জমা দেয়ার সময় এর সঙ্গে এক লাখ রুপির ইএমডি ড্রাফট ‘দ্য পে এন্ড একাউন্টস অফিসার, মিনিস্ট্রি অব এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স’ বরাবর জমা দিতে হবে। দরপত্র জমা দিতে হবে দুই-বিজ্ঞপ্তি (টু বিড) সিস্টেমে। এর একটি হবে টেকনিক্যাল। আরেকটি মূল্য বা খরচ বাবদ। সীলযুক্ত আলাদা আলাদা খামে তা জমা দিতে হবে। খামের ওপর লিখতে হবে ‘টেন্ডার ফর টেকনো-কমার্শিয়াল ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর সেটিং আপ অন ইনল্যান্ড কন্টেইনার পোর্ট অ্যাট নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ’। জমা দিতে হবে আন্ডারসেক্রেটারি (ডিপিএ), রুম নং. ৩১০০, বি উইং, জওয়াহরলাল নেহরু ভবন (জেএনবি), নয়া দিল্লী- এই ঠিকানায়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ রকম দরপত্র আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভিনদেশী কোনো সরকার এ দেশে বিনিয়োগের উদ্যোগ নিলে তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দিতে হবে। অতঃপর বিনিয়োগ বোর্ডসহ সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে সে প্রস্তাব অনুমোদনেরও প্রয়োজন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি শিপিং) কমডোর জোবায়ের আহমেদ বলেন, ভারত সরকারের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল করতে হলে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া বিদেশী বিনিয়োগের ব্যাপারে কিছু আইনগত বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। এক্ষেত্রে দেশী কোম্পানির অবশ্যই ৫১ শতাংশ শেয়ার থাকতে হবে। আমার জানা মতে, সরকারের সঙ্গে কুমুদিনী কিংবা ভারতের এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি। একই তথ্য জানান বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী সদস্য নাভাস চন্দ্র মন্ডল। তিনি বলেন, ভারত সরকার বা কুমুদিনীর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো বিনিয়োগ প্রস্তাব বিনিয়োগ বোর্ডে আসেনি।
নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানও বলেন, এ বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের বিষয়টি আমি জানি না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দরপত্র আহ্বানের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমুদিনী কনটেইনার টার্মিনালের প্রধান নির্বাহী (সিইও) কমডোর মুহাম্মদ ফারুক প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। তবে তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জে তাদের জমি রয়েছে। সেখানে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এ ব্যাপারে কারো কোনো সহযোগিতা নেয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কনটেইনার টার্মিনাল তৈরির পরিকল্পনা করে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট। সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠন করা হয় কুমুদিনী কনটেইনার টার্মিনাল। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের পাশাপাশি ভারতীয় আমদানি-রফতানিকৃত পণ্য লোড-আনলোডে নারায়ণগঞ্জ কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনই এর প্রধান উদ্দেশ্য। বেনাপোল বন্দরের বিকল্প হিসেবে এ টার্মিনাল ব্যবহার করা যায় কিনা, তাও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
কুটনীতিবিদ ড. শমসের মবিন চৌধুরী দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, কোন দেশে বিনিয়োগ করতে হলে সে দেশে বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে করতে হবে একই সাথে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও অনুমোদন প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জের কন্টেইনার টার্মিনাল বিনিয়োগে এসব অনুমোদন রয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে বিনিয়োগ করতে হলে সঠিক প্রক্রিয়ায়ই করতে হবে যদি তা না হয় তবে এটি হবে কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত যা কোন গণতান্ত্রিক দেশ করতে পারে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ দৈনিক সংগ্রামকে জানান, বাংলাদেশের ভূমি ভারত ব্যবহার করতে চাচ্ছে অথচ বাংলাদেশ সরকার তা জানে না। এটা একটা অদ্ভূত পরিস্থিতি। দেশের মানুষকে অন্ধকারে রেখে এধরনের বিনিয়োগ চুক্তি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। দেশের স্বাধীনতা রয়েছে কিনা আমাদের চিন্তা করা উচিত। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের তেল গ্যাস ভাগাভাগি হচ্ছে। তা দেশের জনগণ জানে না। এ কর্মকা- দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একই সাথে এধরনের বিনিয়োগ কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। সুত্র- সংগ্রাম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন