রাতের শেষ প্রহরে জোর করে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেয় সরকার। একই রাতে বন্ধ করে দেয়া হয় ইসলামিক টেলিভিশন। চ্যানেল দু’টি বন্ধ করার ক্ষেত্রে এই সময় নির্বাচন অনেক প্রশ্ন ও রহস্যের জন্ম দিয়েছে। ওই রাতে মতিঝিলে লাখো মানুষের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালানো হয়। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের প্রায় ১০ হাজার সশস্ত্র সদস্য অভিযানে অংশ নেন। শেষ রাতের অভিযানে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের মুহুর্মুহু বিকট আওয়াজে প্রকম্পিত হয় রাজধানী। কয়েক মাইল দূর থেকে ভয়াল উচ্চনাদ মানুষ শুনতে পেয়েছে। দৈনিক যুগান্তর জানিয়েছে, হেফাজতের বিরুদ্ধে এক লাখ ৫৫ হাজার রাউন্ড গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে যৌথ বাহিনী।
বেসামরিক কোনো জমায়েতের বিরুদ্ধে দেড় লাখ রাউন্ডের বেশি গোলাবারুদ ব্যবহারের নজির বিশ্বে সম্ভবত আর ঘটেনি। রাতের গভীরে বাতি নিভিয়ে নজিরবিহীন অভিযানটি চালানো হয়। আতঙ্কিত মানুষ শেষ রাতের বিভীষিকাময় মুহূর্তে দেখতে পেল হঠাৎ করে সবচেয়ে জনপ্রিয় চ্যানেল দিগন্তের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মানুষের ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, শেষ রাতে ভয়ানক একটি অভিযান এবং দিগন্ত টিভি বন্ধ হওয়া একই সূত্রে গাঁথা। কত মানুষ মারা গেছেন? কতজন আহত হয়েছেন? আহতরা গেলেন কোথায়? নিহতদের লাশের কী হলো? এসব নিয়ে সারা দেশে অকল্পনীয় গুজব সৃষ্টি হয়েছে। এর বিপরীতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি মুখপাত্রের ভাষ্য একেবারে পানসে ঠেকেছে। এসব বাহিনীর ভাষ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো যেন নিজেদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কথা বলার সুর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বক্তব্যের কাছাকাছি। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক দলের এতটা তল্পিবাহক হিসেবে বেমানান মনে হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার যে প্রেসনোট প্রচার করল, তা মানুষের অবিশ্বাস আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। গুজব এখন এমন ডালপালা বিস্তার করেছে, যা ঠেকানোর কোনো অস্ত্র সরকারের হাতে অবশিষ্ট নেই। ধরে নিলাম কোনো ধরনের ধীরস্থির চিন্তা না করে টিভি চ্যানেলগুলো বন্ধ করা হয়েছে। এখন পুলিশ, বিজিবি, র্যাব কিংবা সরকারের প্রেসনোট ইস্যুর চেয়ে কার্যকর হতো চ্যানেলগুলোকে তাৎক্ষণিক খুলে দিলে। মানুষ এর মাধ্যমে কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারত। অবিশ্বাস কমে যেত।
দিগন্ত টেলিভিশন দর্শকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে। দেশের বাকি ২৪টি চ্যানেলকে বড় ব্যবধানে পেছনে ফেলে টিআরপিতে (দর্শক-শ্রোতা জরিপে) দিগন্ত এক নম্বর অবস্থানে উঠে আসে। গুজব ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ এটি। মানুষ চ্যানেলটিকে বিশ্বাস করছিল। ২৫টি চ্যানেল থাকলেও বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য দর্শক-শ্রোতা দিগন্তের ওপর নির্ভর করছিল। চ্যানেলটি সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শাহবাগে প্রতিষ্ঠিত ‘গণজাগরণ’ মঞ্চকে কেন্দ্র করে। মঞ্চটির খবর পরিবেশনে দিগন্ত সবচেয়ে স্বচ্ছতা ও বস্তুনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছে।
বিষয়টি ছিল অভাবনীয়। শাহবাগ জমায়েত থেকে দিগন্ত টিভির বিপক্ষে স্লোগান দেয়া হয়েছে। মঞ্চ থেকে চিহ্নিত করা হয়েছে যে চ্যানেলটি বিপক্ষশক্তির। একপর্যায়ে শাহবাগ থেকে সাম্প্রদায়িক ঘোষণা আসে দিগন্তকে উৎখাতের। কোনো আদর্শবাদী আন্দোলন থেকে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক রঙ মাখিয়ে সেটি উৎখাতের অপচেষ্টার নজির পৃথিবীতে আছে কি না সন্দেহ আছে। চ্যানেলটি প্রচারে দেশব্যাপী তখন বিগ্ন সৃষ্টি করা হয়। বলপ্রয়োগ করে অনেক ক্যাবল অপারেটরকে বাধ্য করা হয় দিগন্ত সম্প্রচার বন্ধ রাখতে। মঞ্চ প্রতিষ্ঠার শুরুতে আরো নগ্নভাবে চ্যানেলটির প্রতিবেদককে অকুস্থল থেকে একপ্রকার তাড়িয়ে দেয়া হয়। ঘৃণা সৃষ্টির এত সব অপপ্রয়াসের পরও চ্যানেলটি খবর প্রকাশে আবেগের বশবর্তী হয়েছে এমন দেখা যায়নি। অন্যদের কাছ থেকে খবর ও ফুটেজ সংগ্রহ করে শাহবাগ জমায়েতের খবর দিয়েছে গুরুত্বের সাথে। আমার দেশের পক্ষ থেকে মঞ্চের অনেক আয়োজকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, আয়োজকদের অন্যতম এক নেতার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি লাশের ওপর নাচানাচি করছেনÑ এমন ছবি প্রকাশ পেয়েছে। এ মঞ্চের আহ্বায়কের পরিচয়ও তুলে ধরেছিল আমার দেশ। তারা প্রমাণ হাজির করেছিল, আহ্বায়কের পিতামহ রাজাকার ছিলেন। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক, যারা শাহবাগের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিজেদের প্রদর্শন করেছে, কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে কিভাবে মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তা-ও দেখা গেল। এটি সম্ভবত পত্রিকাটির সুবিধাবাদী নীতি। তারা এমন একটি গল্প ছাপল তাতে স্লোগানকন্যাদের চরিত্রে দারুণভাবে কলঙ্ক লেগে গেল। এর বিপরীতে দিগন্ত টেলিভিশনকে পেশাদার অবস্থানে দেখা গেছে। সরাসরি শত্রু ঘোষণা দিলেও শাহবাগ মঞ্চের বিরুদ্ধে একটি সুযোগও নেয়নি দিগন্ত।
শাহবাগ মঞ্চ থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির উপক্রম হয়েছিল। সারা দেশে ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়, বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে। অসংখ্য স্থাপনা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। একটি মঞ্চ থেকে অনেক ধরনের স্লোগান উঠতে পারে। আয়োজনকারীরা আবেগের আতিশয্যে বাড়াবাড়ি করতে পারেন। মিডিয়ার কাজ হলো সেটিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা। সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারেÑ এমন উপাদানকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়ে খবর প্রচার করা। বাংলাদেশের মিডিয়া সে ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
শাহবাগ যা বলেছে, যা করেছেÑ হুবহু মিডিয়া তা প্রচার করে দিয়েছে। টানা এক মাস ব্যানার হেডিং করেছে পত্রিকা। পুরো পত্রিকায় মঞ্চের অনেক বেশি খবর ও ছবি দেয়ার পরও প্রথম পাতার ওপরের অংশটিতে সব সময় ছবি ছাপিয়ে গেছেন তারা। একটি পত্রিকা নজিরবিহীনভাবে প্রথম পাতার পুরোটা পোস্টার করেও ছবি ছেপেছে। টেলিভিশন সারা দিন লাইভ কাভার করেছে। মানবজমিন এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানায়, শাহবাগ নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি হয়েছে যে, কয়েক শ’ মানুষের উপস্থিতিকে লাখো মানুষের জমায়েত বলে চালিয়ে দিতে দেখা গেছে। আর সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে স্লোগান দেয়া হয়েছে। ধর্মকে আক্রমণ করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের সাথে মধ্যপ্রাচ্য বা ইসলামি দেশগুলোর কোনো সম্পর্ক না থাকলেও আরবীয় পোশাক পরিয়ে কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছে। এগুলোকেই অতি উৎসাহ নিয়ে সরাসরি খবর হিসেবে প্রচার করেছিল মিডিয়া। যার ফলে উগ্র সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অথচ সরকারের একটি নির্দেশনায়ই এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার লাগাম টেনে ধরা যেত। তখন সরকার মিডিয়ার বিরুদ্ধে উসকানি দেয়ার অভিযোগ আনেনি। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক দিগন্তের বিরুদ্ধে সরকার উসকানিমূলক প্রচারণার অভিযোগ এনেছে এখন। কোন সংবাদটি উসকানিমূলক তা সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি।
হেফাজতকে নিয়ে দিগন্ত টিভির বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশনাকে ইতিবাচকভাবে নিতে পারত সরকার। এই অরাজনৈতিক সংগঠনটির ব্যাপারে অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মতো দিগন্তও যদি ব্ল্যাকআউট নীতি অবলম্বন করত তাহলে বিশাল এই সংগঠনটির ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা পেত না কেউ। ৬ এপ্রিল এবং ৫ মে (মধ্যরাত পর্যন্ত) এর কর্মসূচি যথাযথভাবে প্রকাশ করার মাধ্যমে হেফাজতের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা তুলে ধরেছে দিগন্ত। তারা স্বচ্ছতার নীতি অবলম্বন না করলে টোটাল সংবাদমাধ্যমের ব্ল্যাকআউট নীতির সুযোগে গুজব আরো আগে থেকে ছড়াত, যা আরো বেশি সন্দেহ ও বিশ্বাসহীনতার জন্ম দিত।
৬ মে প্রথম প্রহরের পর সরকারের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস-সন্দেহ বহু গুণে বেড়ে গেছে। দিনের আলোয় দেশবাসী মতিঝিলে কয়েক লাখ মানুষকে সমবেত হতে দেখেছে, যারা রাতের দ্বিপ্রহরেও সেখানে অটল ছিলেন। পরের দিন সকালে তারা দেখল পুরো মতিঝিল একেবারে সাফসুতরো। অন্য দিকে সংবাদমাধ্যম জোরেশোরে খবর প্রচার করছে হেফাজতের ‘তাণ্ডব’ নিয়ে। মনে হলো হেফাজতের লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক সারা রাত তাণ্ডব চালিয়ে ভোরের আলোয় হাওয়া হয়ে গেছে। তারা দেখাচ্ছে, মতিঝিলে অফিস-আদালত তছনছ করা হয়েছে। কয়েক ফুট চওড়া পুরো সিমেন্টের ডিভাইডার চূর্ণ হয়ে গেছে। করাত দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে সড়কদ্বীপের গাছ। স্বর্ণ, জুতা, কাপড়ের দোকান পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। কয়েক বর্গমাইল এলাকার খুদে ব্যবসায়ীদের সব আগুনে পুড়ে নিঃশ্বেষ হয়ে গেছে। এগুলোর অর্থনৈতিক মূল্যমান কষতে প্রতিবেদকেরা হিমশিম খাচ্ছেন। কেউ বলছেন, ৫০ কোটি টাকা। কেউ বলছেন, শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বড় বড় অর্থনীতিবিদ জানাচ্ছেন ষড়যন্ত্রতত্ত্বের খবর। হেফাজতের পাকা পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট লুটপাটের। আগুনে মোমের মতো গলে গেছে অ্যালুমিনিয়ামের দৃঢ় খাম্বা। হেফাজতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ আনা হচ্ছে পবিত্র কুরআন শরিফ পোড়ানোর। অর্থাৎ সংগঠনটি যার পবিত্রতা রক্ষায় মাঠে নেমেছে, নিজেরাই সেটা আবার পোড়াচ্ছে। বড় বিচিত্র, বড় অদ্ভুত! রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে ফেলে অভিযোগের তীè তীরটি হেফাজতের বিরুদ্ধে বেশি নিক্ষেপকারী মিডিয়া অনেকটাই নীরব সে রাতে শাপলা চত্বরে জড়ো হওয়া হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের কী পরিণতি হয়েছিল তা নিয়ে। এতগুলো মানুষ রাতের শেষ প্রহরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিভাবে সরে গেলেন। এই প্রশ্নের উত্তরের হাজারো ঢালপালা গজালো শেষ রাতে টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়ার পর। কারণ, মানুষের সবচেয়ে বড় প্রশ্নটির বিস্তারিত উত্তর নিয়ে আসেনি কোনো মিডিয়া। তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তাণ্ডব।
এখন অবিশ্বাস্য সব খবর ছড়িয়ে পড়ছে, যা যাচাই-বাছাই করার কোনো বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম পাঠক-দর্শক পাচ্ছে না। ব্রিটিশ পত্রিকা ইকোনমিস্ট বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে এই সময়ে সরকারের প্রতি সবচেয়ে নতজানু বলে মন্তব্য করেছে। ইনকিলাব লিখেছে, সব প্রাইভেট টেলিভিশন এখন হয়ে গেছে বিটিভি। মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে দেশী সব টিভি চ্যানেলের ওপর থেকে। বাংলাদেশের মিডিয়ার জন্য এসব খবর অত্যন্ত লজ্জার। তারা ব্যর্থ হয়েছেন বস্তুনিষ্ঠ খবর দিতে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে ‘নতজানু’ বলে মন্তব্য করার পর আমাদের সাংবাদিক নেতাদের অবস্থান জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তারা কি লজ্জা পান না! তারা কি বিব্রত হন না! মানুষ এখন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। রাতের অন্ধকারে চালানো অপারেশনের ছিটেফোঁটা কিছু বীভৎস দৃশ্য গুজবের ডালপালাকে আরো বিস্তৃত করছে। শেষ রাতে চালানো অভিযান সরকারের মর্যাদা যতটা ক্ষতি করেছে; একই সময়ে চ্যানেল বন্ধ করে দেয়ায় সেই ক্ষতিটা আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন