বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংঘাত নিরসন এবং আগামীতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় খুঁজে বের করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের পক্ষ থেকে সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল চার দিনের সফরে সম্প্রতি ঢাকা এসেছিলেন। সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করা ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। সফরকালে আগামী নির্বাচন প্রক্রিয়া কোন পদ্ধতিতে হবে এবং প্রক্রিয়া নির্ধারণে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উভয় দলের অবস্থান কি তাও তিনি জানতে চেয়েছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে একটি কার্যকর সংলাপের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কোন সহায়তা দিতে পারে কি না সেই বিষয়টিও তিনি খতিয়ে দেখেছেন বলে জানা গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জাতিসংঘের বিশেষ দূত গত দু’মাস ধরে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আইনজীবী শাহদীন মালিক এবং রেহমান সোবহানও তার সাথে আলোচনা করেছেন বলে জানা যায়। তিনি জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও গওহর রিজভী. প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিনের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে দলের তিন সদস্যের এক প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। বৈঠককালে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসংঘের বিশেষ আগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেই ঠিক করতে হবে এবং তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন যে, সমঝোতার কোনও বিকল্প নেই এবং বাংলাদেশের সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ অতীতের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি আরো বলেছেন বর্তমান পরিস্থিতির সাথে অতীতের নির্বাচন পূর্ব পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। তার মতে অব্যাহতভাবে চলা এসব সহিংসতার অবসান হওয়া উচিত। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে সংবিধানের আওতায় কিভাবে এগুনো যায় সে সম্পর্কে অস্কার ফার্নান্দেজ জানতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে সংবিধানে কি কি বিকল্প রয়েছে সেগুলোও তিনি শুনেছেন। উভয় নেত্রীর সাথে ফলোআপ বৈঠক করে জাতিসংঘের এই দূত ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
দুই.
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের জন্য এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, তারা কখনো নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারেন না। এজন্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হয় তাদের কাউকে কাউকে বিদেশী শক্তির কাছে ধর্না দিতে হয়। নতুবা স্বপ্রণোদিত হয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমস্যা সমাধানে তাদের পরামর্শ দিতে এগিয়ে আসেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের শুরু থেকেই সম্ভবত এটা এদেশের মানুষের ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল আলোচনা সংলাপ গোলটেবিল বৈঠক তার সমাধান করতে পারেনি। ফলে সংঘাত সংঘর্ষের সূচনা ঘটে এবং তা দমনের জন্যে তৎকালীন সরকার সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দমন-নিপীড়নের আশ্রয় নেয়। এজন্যে তারা সংবিধান, রাষ্ট্রীয় সংহতি ও অখ-তার দোহাই দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনবিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছিল এবং রাজনীতিকদের একটি অংশ প্রতিবেশী একটি দেশের সামরিক-বেসামরিক সহযোগিতাকে প্রাধান্য দিয়ে সমস্যা সমাধান এবং ক্ষমতার সংক্ষিপ্ত সিঁড়ির অনুসন্ধান করেছিল। এই প্রক্রিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্ম দেয় এবং দেশ স্বাধীন এবং স্বাধীন দেশের নতুন সরকার মানুষকে গণতন্ত্র, ইনসাফ, শান্তি-প্রশান্তি শোষণ ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখালেও তা তারা দিতে পারেননি। দেশকে তারা লুটপাট সমিতিতে পরিণত করেন। তাদের হত্যা, গুম, জুলুম-নির্যাতন, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম অধ্যায় হয়ে আছে। দলটি গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করে একদলীয় শাসন কায়েম করে। ফলে সকল রাজনৈতিক দল, মত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। দলীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চারটি মাত্র পত্রিকা রেখে বাকি সকল পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। এই সময় দলীয় নিয়ন্ত্রণে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে কারচুপি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছিল তা ছিল নজিরবিহীন। তৎকালীন সরকারের দুঃশাসন, নির্যাতন ও গণতন্ত্র হত্যার প্রতিফল শুভ হয়নি। এর অমোঘ পরিণতি হিসেবে যে পরিবর্তন ঘটে তাতে দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল। অবশ্য এই পরিবর্তনের ফলে দেশে স্বৈরাচারী একদলীয় বাকশালী শাসন থেকে মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেয়েছিল। এই অবস্থা বেশিদিন টিকেনি, এরশাদের ডিক্টেটরশীপ পুনরায় দেশবাসীর ঘাড়ে চেপে বসে। এই স্বৈরাচার হটাতে নয় বছরের আন্দোলন দেশে স্বৈরাচার বিরোধী গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি করেছিল। এরশাদের স্বৈরাচারী সরকার সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু গণবিস্ফোরণের ঘূর্ণিঝড় এরশাদ সরকারের সাংবিধানিক দোহাই ও ক্ষমতা লিপ্সাকে তছনছ করে দিয়েছিল। তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জনাব এরশাদই বাংলাদেশে সম্ভবত: একমাত্র সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান যিনি ক্ষমতায় থাকাকালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছর জেল খেটেছিলেন। দেশবাসী অবশ্য তার জুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচার নিপীড়নের বিচার করেনি।
তিন.
নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের এরশাদ উত্তর নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা ছিল সামরিক এবং দলীয় সরকারের অধীনে আমাদের দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দৃষ্টান্ত না থাকায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর স্বৈরাচারী মনোভাব ক্ষমতা লিপ্সা ও ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় নির্বাচনে সীমাহীন কারচুপির আশ্রয় নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার দাবি উঠে। এই দাবিটি প্রথমে ছিল জামায়াতের। কিন্তু পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ তা লুফে নেয় এবং কালক্রমে তা জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ এই দাবি আদায়ের জন্য হরতাল-অবরোধ গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, সরকারি স্থাপনার উপর হামলা অসহযোগ এবং হরতালকালে কর্মকর্তাদের দিগম্বর করাসহ এমন কোন ধ্বংসাত্মক আন্দোলন নেই যা করেনি। এর ফলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সংবিধানের দোহাই উঠে যায় এবং ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর এই ব্যবস্থার অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছে; দু’টিতে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে এবং একটিতে বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট জয়ী হয়েছে। শেষোক্ত নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ এখনো ক্ষমতায় রয়েছে। শেষের এই নির্বাচনটি হবার কথা ছিল ২০০৭ সালের ২২শে জানুয়ারি। কিন্তু তৎকালীন কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান এবং নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তাদের আস্থা না থাকায় এবং তাদের দৃষ্টিতে জনমত তাদের বিরুদ্ধে থাকায় তারা নির্বাচন বর্জন ও দেশব্যাপী আন্দোলনের পথ বেছে নেন। এজন্যে তারা হরতাল-অবরোধের আশ্রয় নেন এবং দেশব্যাপী ভঙ্গুর-অগ্নিসংযোগ, খুন-রাহাজানি এবং নৈরাজ্যের এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তারা প্রেসিডেন্ট হাউসে গ্যাস পানি, বিদ্যুৎ ও খাবার সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দেন। প্রকাশ্য দিবালোকে লগিবৈঠা দিয়ে তারা মানুষ হত্যার যে নজির সৃষ্টি করেছেন ইতিহাসে তা বিরল। তাদের নৈরাজ্য ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতার ফলে ওয়ান ইলেভেনের সৃষ্টি হয় এবং বাংলাদেশে সেনাসমর্থিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সরকারকেই শেখ হাসিনা তার আন্দোলনের ফসল বলে অভিহিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, এই সরকারের সাফল্য তাদের সাফল্য এবং এর ব্যর্থতা তাদেরই ব্যর্থতা। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের এই সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এই সরকারই শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াসহ সারা দেশের শত শত রাজনৈতিক নেতাকে তারা গ্রেফতার করেছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দেয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের দায়ে রুজু করা ১৫টি মামলার মধ্যে চারটি মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এ মামলাসমূহে তার বিরুদ্ধে যে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল তাতে মামলার বিচারে তার শাস্তি অবধারিত হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় তাকে উদ্ধারের জন্যে ত্রাণকর্তা হিসেবে একটি প্রতিবেশী দেশ আবির্ভূত হয় এবং ব্যাপক কূটনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা তাকে উদ্ধার করতেও সমর্থ হন। সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার কার্যত এই শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে। প্যারোলে মুক্তি পেয়ে শেখ হাসিনা বিদেশ যাবার সময় তৎকালীন কেয়ারটেকার সরকার প্রধানসহ তার জন্য নির্ধারিত সাব-জেলে তার সাথে উপদেষ্টাদের রহস্যজনক বৈঠকই ছিল এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এর পর অনেক নাটক হয়েছে এবং একটি আঁতাতের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্ষমতায় আসার পর তিনি ও তার সরকার কি করেছেন দেশবাসী তা অবগত আছেন। পিলখানায় বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, হলমার্ক, ডেস্টিনি, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ইউনিপে টু ইউ, পদ্মা সেতু, বিমান, রেলওয়ে, টেলি কমিউনিকেশন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহন প্রভৃতি সংস্থা ও খাতের লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি তার সরকারেরই অনন্য কীর্তি। সরকারের এমপি, মন্ত্রী এবং সরকারি দলের খুব কম নেতা-কর্মীই আছেন যারা বর্তমানে দুর্নীতি, অনিয়ম ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িত নেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কেয়ারটেকার আমলে রুজু করা দলের সমস্ত নেতা-কর্মীর মামলা প্রত্যাহার করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের সকল মামলা বহাল রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারকে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে অপমানকরভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবার সদস্যরা আজীবন সরকারি ব্যয়ে নিরাপত্তা সুযোগ পাওয়া ছাড়াও গণভবনের মালিকানা পেয়েছেন। এই সুযোগ অভাবিতপূর্ব।
ক্ষমতা যাতে কখনো হাতছাড়া না হয় তার ব্যবস্থাও দলটি করেছে। ক্ষমতায় এসেই তারা প্রতিবেশী দেশের ঋণ পরিশোধে উঠে-পড়ে লেগেছেন। তাদের নিরাপত্তা ছাতার আশ্রয়েও তারা চলে গেছেন। তাদের দ্বিতীয় কাজটি হচ্ছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা এবং সংবিধানের ১৯৭২ সালের ১২৩ নং অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারের মেয়াদ শেষের তিন মাস আগে ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে। এই বিধান অনুযায়ী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য সকলকেই পদ ও ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখানে লেবেল প্লেয়িং গ্রাউন্ডের কোন ব্যবস্থা নেই। এই বিধানটি সংবিধানেরও পরিপন্থী। সংসদ সদস্যদের পদে রেখে নির্বাচনের বিধান দুনিয়ার কোথাও নেই। সরকার নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যেসব কথাবার্তা বলছেন সংবিধানে তার কোন অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাই না। ক্ষমতাসীন জোট তথা ১৪ দলের মিটিং শেষে ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র বলেছেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কাউকেই তারা মানবেন না। কিন্তু এর একদিন পরেই এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ বলেছেন যে, শেখ হাসিনাকেই যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কথাবার্তার মধ্যে যে স্ববিরোধিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তাতে তারা আসলে দেশবাসীকে কি বুঝাতে চান তা নির্ণয় করা অত্যন্ত কঠিন।
শেখ হাসিনা বরাবরই বলছেন যে, অনির্বাচিত কেয়ারটেকার সরকারে তিনি ফিরে যাবেন না। বিরোধী নেত্রীকে তিনি ভীতিও প্রদর্শন করছেন এবং বলছেন যে, খাল কেটে কুমির আনবেন না। কারণ ঐ কুমির আপনাকেই প্রথম কামড় দেবে। এ কথা বলে সম্ভবত তিনি সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার আমলে তিনিসহ রাজনীতিকদের ওপর যে দমন নিপীড়ন চলেছিল তার কথাই বলতে চাচ্ছেন। এখানে একটি প্রশ্ন দেশবাসীকে সবসময় পীড়া দেয় এবং সেটি হচ্ছে তিনি অথবা তার সরকার কিংবা রাজনীতিকরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত না হন অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার না করেন তাহলে তার এত ভয় কেন? কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে পাকিস্তানে সম্প্রতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন পিপলস পাট্র্রি শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে এবং দলটির প্রধানমন্ত্রীকে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত করে তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। এই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার ইস্যুতে আরো কঠোর অবস্থানে চলে গেছেন বলে মনে হয়। কেননা গত সাড়ে চার বছরে তার সরকারের আমলে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ যেসব অঘটন ঘটেছে তা তার সরকারকে শংকিত করে তুলেছে। দলীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে যদি নির্বাচন হয় এবং তারা যদি ক্ষমতায় না আসতে পারেন তাহলে তাদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং তা তাদের জন্য সুখকর হবে না বলে তাদের মনে আশংকার সৃষ্টি হয়েছে।
(চার)
আমি সংলাপ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম। এই সংলাপ প্রসঙ্গ নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘ দূত পাঠিয়েছে। বিদেশী কূটনীতিকরা সরকার ও বিরোধীদলের ওপর চাপ দিচ্ছেন। সরকারি দলের তরফ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপের চিঠি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে ৪৯০ ঘণ্টারও বেশি পার হয়ে গেছে। সরকার তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছে। এখন বলছেন যে, আনুষ্ঠানিক কোন পত্র দেয়া হবে না। সংসদেই সংলাপ হবে। সংসদ সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা অবশ্যই জানেন যে, সংসদে সংলাপ হয় না বিতর্ক হয় এবং তার ভিত্তিতে ভোটাভুটিতে সিদ্ধান্ত হয়। যারা সংলাপের জন্যে সংসদে যাবার কথা বলেন তারা দেশবাসীকে বোকা বানাতে চান কিনা আমি জানি না। তবে এর মধ্যে সরকার কর্তৃক গৃহীত কয়েকটি পদক্ষেপ দেশের প্রতিটি মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সরকার মানববন্ধনসহ সকল প্রকার সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। যারাই তা করতে যাচ্ছেন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এর শিকার হচ্ছে জামায়াত-শিবির, বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং হেফাজতে ইসলামের নিরীহ আলেমরা। দেশে এখন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু উভয়ে প্রায় একই ভাষায় বলেছেন, যে কোন উপায়ে হোক তাদের নির্বাচনে জিততে হবে। এটা গণতন্ত্রের ভাষা নয় সন্ত্রাসের ভাষা। সরকার জনগণের মতামত প্রকাশ ও দল গঠনের অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের পাইকারীহারে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং জামিন পাবার পর জেলগেট থেকে তাদের আবারও পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মৌলিক অধিকারের জায়গাগুলো এখন আর সরকারের হাতে নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় যা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় তা হচ্ছে সরকার চাচ্ছেন যে বিরোধী দল তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুক। কিন্তু কেউ যে আত্মসমর্পণ করে না সরকারের সামনেই তার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। মানুষের সামনে সকল পথ যখন রুদ্ধ হয়ে যায় তখন তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ মঙ্গল বয়ে আনে না। আর আমরা কেউ তা চাই না। কাজেই কেয়ারটেকারের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডার ভিত্তিতে কার্যকর সংলাপের পথে এগিয়ে আসাটাই সরকারের জন্য কল্যাণকর হবে।
(পাঁচ)
আওয়ামী লীগ গত সাড়ে চার বছরে দেশকে যে অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাতে শুধু নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করলেই যে সুষ্ঠু এবং সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচনের গ্যারান্টি পাওয়া যাবে তা আমি বিশ্বাস করি না। দেশ ও জাতিকে এর জন্য আরো অনেক কিছু করতে হবে। কেননা প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি পরতে দলীয়করণ বর্তমানে সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করেছে। পুলিশ ও সিভিল প্রশাসন এবং এমনকি বিচার বিভাগও এখন ব্যাপক দলীয়করণের শিকার। নির্বাচন কমিশন সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। দলীয় কর্মী দিয়ে ভোটার তালিকা হাল নাগাদ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এতে দলীয় বলয়ের বাইরে লাখ লাখ লোক ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ছে। এর প্রতিবিধান হচ্ছে না। জাতীয় পরিচয়পত্র ও ভোটার আইডি তৈরির নামেও চলছে নৈরাজ্য ও পয়সার খেলা।
পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনে একজনের উপর এক জনকে এমনভাবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে আগামী দু’একটি নির্বাচনই শুধু নয়, বংশানুক্রমে দশকের পর দশক ধরে বর্তমান ক্ষমতাসীনরাই ক্ষমতায় থাকতে পারেন। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলে থাকেন যে প্রশাসন চলছে এখন হাফপ্যান্ট বাহিনীর নির্দেশে। হাফপ্যান্ট পরা দলীয় কর্মীরাই পুলিশকে বলে দেয় কি করতে হবে, কি করতে হবে না, কে জামায়াত-শিবির, কে বিএনপি, কে হেফাজত, কাকে গ্রেফতার করতে হবে কাকে নয় তারাই বলে দেয়। গ্রেফতার বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। শোনা যায় এই অর্থ ভাগাভাগি হয় সকলের মধ্যে। আবার ডিবি পুলিশ থানা পুলিশের মধ্যে আসামী কেনাবেচা চলে। এই সরকারের আমলে রাজনৈতিক মামলায় পুলিশ ঘুষ বাণিজ্যের যে সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো এমনটি হয়নি। পুলিশ বাহিনী ও বিজিবিতে ৩০ সহ¯্রাধিক দলীয় সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের চাকরি দিয়ে সমগ্র আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কলুষিত করে দেয়া হয়েছে। তাদের অবৈধ কামাই রোজগারের অবাধ সুযোগ ভবিষ্যতে বন্ধ করা যেমনি কঠিন হবে, তেমনি ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারের পক্ষে বিরোধী দল নির্মূলে তাদের ব্যবহারও সহজতর হবে এবং হচ্ছে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাজি, দখলবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি ও সিট বাণিজ্য এবং ঘুষ দুর্নীতি তাদেরকে টাকার কুমিরে পরিণত করেছে। ফলে ক্ষমতা অর্থ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাছে নির্বাচন জিম্মি হয়ে পড়ছে। উপজেলা পর্যায়ে সিভিল প্রশাসন ও উন্নয়ন কর্মকা-ে দলীয় নেতা এমপিরা একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ঠুটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছে। যারা সরকারি দলের সমর্থক নন তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে তাদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিপুল অংকের রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপচয় করে জেলা পরিষদে দলীয় প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে যাতে জাতীয় নির্বাচনকে তারা প্রভাবিত করতে পারেন। দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। জনজীবন পর্যুদস্ত। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করা হয়েছে। নোবেল বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূস যথার্থই বলেছেন, রানা প্লাজার ফাটল ও বিধ্বস্ত ভবন আমাদের গার্মেন্টস খাতের সহ¯্রাধিক লোকের প্রাণ নিয়েছে এবং আহত করেছে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিককে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে ফাটল ধরেছে তার ফলে যে ধ্বংসযজ্ঞ আসন্ন হয়ে পড়েছে তাতে আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। এর বিরুদ্ধে জনগণকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার এই বিশাল ফাটল আওয়ামী লীগই তৈরি করেছে।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গিয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মীমাংসিত একটি বিষয়কে বাতিল করে দেন। এই পদ্ধতিটি ছিল জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার গ্যারান্টি। তারা এ ব্যবস্থাকে বাতিল করার অজুহাত হিসেবে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়েছেন। আদালতের এই রায় সম্পর্কে বিভিন্ন রকমের কথা আছে। এবং সকলেই জানেন যে, কেয়ারটেকারের অধীনে আরও ২টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে আদালত তার সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য যে সংসদীয় কমিটি গঠন করেছিলেন সেই কমিটির বিভিন্ন শ্রেণীপেশা বিশেষ করে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞের সঙ্গে একাধিকবার সভায় মিলিত হয়েছিলেন এবং তাদের প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি রাখার অনুকূলে মতপ্রকাশ করেছিলেন। সংসদীয় কমিটির প্রধান সংবিধান সংশোধনের আগের দিন পর্যন্ত দেশবাসীকে এইমর্মে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার পর সবকিছু উলট-পালট হয়ে যায়। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আর কোনদিন বাংলাদেশে ফিরে আসবে না। তার নির্দেশনাতেই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি তুলে দেয়া হয়েছে। এখন তার পুনরুজ্জীবন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরই নির্ভর করছে। এই ব্যাপারটি পুনঃপ্রবর্তনের পর অন্যান্য আনুষঙ্গিক যে বিষয়গুলোর কথা আমি বলেছি তারও সুরাহা করতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন