মতিঝিল শাপলা চত্বরে ‘হেফাজতে ইসলাম দমন অভিযান’ নিয়ে মানুষের মনে বহু প্রশ্ন। জবাব মিলছে না। এতে রহস্য আর বিভ্রান্তি বাড়ছেই। হেফাজত ইস্যুতে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রধানত সরকার। অনুকূল মিডিয়া এবং ক্ষমতাসীন দলের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এ ক্ষেত্রে খুব সহায়ক বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ৫ তারিখের রহস্যময় সহিংসতা ও তাণ্ডবের ‘সুফল’ তারা যতটা পাবেন বলে ভাবছেন, তাদের এর চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে গেছে শাপলা চত্বর অপারেশনে। এই অভিযানের কারণ হিসেবে জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে, পর দিন বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সচিবালয়ে হামলার মতো নাশকতার আগাম খবর এসেছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক এক মাস আগে একই স্থানে হেফাজতের মহাসমাবেশের পূর্বলগ্নে সরকার জানিয়েছিল, এই উপলক্ষে নাশকতা চালানো হবে। অথচ কোনো কিছুই ঘটেনি এবং মহাসমাবেশও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। অতএব, প্রশাসনের এসব প্রচারণা কতটা বিশ্বাসযোগ্য হবে গণমানুষের কাছে?
একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকায় জানানো হয়েছে, ৫ মে রাত ১০টার মধ্যেই হেফাজতের মহাসমাবেশের দু-তৃতীয়াংশ লোক চলে গিয়েছিল। যদি তা-ই হয়, নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত খুব বেশি মানুষ শাপলা চত্বরে থাকত না। তা ছাড়া সন্ধ্যা থেকেই আকাশের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছিল, রাতে বৃষ্টি হবে। তাহলে সমাবেশটি আরো ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত এমনিতেই। এ অবস্থায় সরকার অপেক্ষা করতে পারত। কোনো প্রাণহানি এড়িয়ে চলার জন্য এটাই করা জরুরি ছিল। কিন্তু তা না করে যুদ্ধংদেহি সাজে মধ্য রাতের আঁধারে যা করা হলো, এতে শুধু ‘হেফাজতী’রা নয়, এখন অন্যরাও নিজেদের জানের হেফাজত নিয়ে নিদারুণ উদ্বিগ্ন।
দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছে ‘(সম্মিলিত বাহিনীর অভিযানের পর) হেফাজত কর্মীদের সকলের চোখেমুখে ছিল এক আতঙ্কের ছাপ। অনেকের বয়স ছিল ১০ বছর থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। তারা নিজেরাও জানে না, এ ধরনের একটি অভিযান হবে। অনেকেই হেঁটে সমাবেশস্থলে এসে দিনভর কোনো খাবার না পেয়ে তাদের শারীরিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ।’
এর সাথে তুলনা করুন শাহবাগে দিনের পর দিন বিরিয়ানি প্যাকেটসহ নানা খাবার আর অর্থ সরবরাহের বিষয়। তখন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের অন্তত এক দিনের বেতন সে জন্য দিতে হয়েছে। একটি পত্রিকায় তখন সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে জানানো হয়েছিল, একটি বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন থেকে লক্ষাধিক টাকার বিরিয়ানি কিনে দুপুরের খাবার হিসেবে শাহবাগে পাঠানো হয়েছিল।
কত লোক মারা গেছে?
যে সময়ে, যে অবস্থায় এবং যেভাবে যৌথ দমন অভিযান চালিয়েছে তিনটি বাহিনী, তাতে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে নানা ধরনের ধারণা, প্রচারণা এবং গুজব ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া অনিবার্য। এটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে যে বিষয়টি, তা হলোÑ সরকার এত ভয়াবহ একটা ঘটনার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি কতজন নিহত হয়েছে বলে তারা নিশ্চিত। কয়েক দিন পর ডিএমপি কমিশনার সংবাদ সম্মেলনে এমন ভঙ্গিতে বললেন যে, মনে হয়েছে, বড় কিছু ঘটেনি এবং কয়েকজন মারা যাওয়া তো কোনো ব্যাপারই নয়। বলা নিষ্প্রয়োজন, অতীত থেকেই আমাদের দেশে পুলিশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের ওপর সাধারণত মানুষ আস্থা রাখতে পারে না। বিরোধী দল জনগণের এই অভিমতের প্রতিধ্বনি করেছে। এ দিকে শাপলা চত্বরে নিহতের অনুমিত সংখ্যা ১০, ২০, ৩০ ছাড়িয়ে ১০০, ২০০, এক হাজার এমন কি দুই হাজারে পৌঁছে গেছে মানুষের মুখে মুখে। তবে প্রত্যক্ষদর্শী যেমন নেই, তেমনি কেউ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছেন না, আসলে হতাহতের সংখ্যা কত। অপর দিকে, ঘটনার যে ছবি ও বিবরণ সরকারের আস্থাভাজন পত্রিকাগুলো পর্যন্ত দিয়েছে, তাতে জনমনে আতঙ্ক ও ক্ষোভ, দুটোই বেড়েছে।
কত লোক মারা গেছেন, তা নিয়ে ‘নানা মুনির নানা মত’। পুলিশের সাফাই বক্তব্য, সরকারি দলের নেতাদের বাগাড়ম্বর, বিরোধী দলের পরিসংখ্যান, খোদ হেফাজতের দাবি, জনগণের অনুমানÑ এগুলোর মধ্যে মিল নেই। সচেতন নাগরিকেরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করেছেন, অভিযানকারী পুলিশের বড় কর্তা যখন ‘কয়েকজন’ নিহত হওয়ার কথা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করলেন, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র (সে হিসেবে সরকারপ্রধানের রাজনৈতিক মুখপাত্র) মাহবুব-উল আলম হানিফ অবলীলায় নিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে বসেছেন, ‘শাপলা চত্বরে কোনো লোক নিহত হয়নি।’) নিউএজ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে outrageous (নিষ্ঠুর, নির্লজ্জ, মর্মান্তিক) বলা হয়েছে এই মন্তব্যকে।
কতগুলো বিষয় বিবেচনার দাবি রাখে : ১. ৫ মে রোববার মধ্য রাতে অভিযান চালানোর সময় শাপলা চত্বরে অসংখ্য লোক ছিলেন বলে ধরে নেয়া যায়। কোনো পত্রিকা লিখেছে, অর্ধলক্ষ; কোনো পত্রিকার মতে লক্ষাধিক।
২. প্রকাশিত তথ্যমাফিক, তিন দিক থেকে অভিযানে অংশ নিয়েছে পুলিশ-র্যাব-বিজিবির মোট ১২ হাজার সদস্য।
৩. সংবাদপত্রের তথ্যমোতাবেক, ৫ তারিখ দিবারাত্র মিলিয়ে লক্ষাধিক বুলেট ব্যয় করেছে বিভিন্ন বাহিনী।
৪. শাপলা চত্বরে নজিরবিহীন কঠোর অভিযানটি হয়েছে বাতি নিভিয়ে দিয়ে, গভীর রজনীর বিভীষিকাময় অন্ধকারে। এতে কতজন হতহাত হচ্ছে, তা বুঝা প্রায় অসম্ভব। তাই এমন ধারণাই জন্ম নিয়েছে, যে ২/১টি টিভি চ্যানেল তখনো ‘লাইভ’ দেখাচ্ছিল, তারাও ঘটনার ভয়াবহতা কিছুটা মাত্র দেখাতে পেরেছে সে অন্ধকারের মধ্যে।
৫. আমাদের দেশে ব্রিটিশ আমল থেকে বিভিন্ন সরকার এ ধরনের ঘটনায় বহু লাশ সরিয়ে ফেলা এবং নিহতের সংখ্যা কমিয়ে বলা একটা ‘ঐতিহ্য’ হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলেও এমনটা হয়েছে। ফলে মানুষ ধরেই নেয়, সরকারের ইমেজ ুণœ না হতে এবং জনমনে আতঙ্ক রোধের জন্য লাশ না সরিয়ে থাকতে পারে না এবং ‘ঘটনা তেমন মারাত্মক নয়’ দেখাতে এটা করাই যেন নিয়ম।
এ অবস্থায় বিভিন্ন মহল ও সূত্র বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিচ্ছে হতাহত সম্পর্কে। তবে নিশ্চিত হওয়ার যেহেতু উপায় নেই, তাই যার যার আশঙ্কামাফিক অনুমান তুলে ধরা হচ্ছে। এতে সাধারণ নাগরিকেরা আরো বিপন্ন বোধ করছেন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। এর মূল কারণ, প্রশাসনের আচরণের ওপর অনাস্থা। সাম্প্রতিককালে নানা স্থানে বিরোধী দল দমনে পুলিশের বেপরোয়া ও নির্বিচার গুলি বা রাবার বুলেট বর্ষণ মানুষের এমন প্রতিক্রিয়ার জন্য অনেকটাই দায়ী।
হেফাজতে ইসলামের তীব্র বিরোধী এবং তাদের প্রতিপক্ষ, শাহবাগ মঞ্চের অত্যন্ত উৎসাহী সমর্থক পত্রিকা দৈনিক নিউএজ। গত বুধবার এর সম্পাদকীয়ের শিরোনাম ছিল, Hanif’s outrageous claim about Motijheel crackdown casualty.
শাপলা চত্বরের ট্র্যাজেডি সম্পর্কে সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়, Prudence dictated that the Awami league-led government would come up with a credible account of what had happened in the wee hours of Monday. However, what eventually came from the incumbents, via the AL joint general secretary Mahbub-ul-Alam Hanif, amounts to a blatant affront to the intelligence of people at large … Hanif told a news conference … that ‘there was no killing’ during the operation and that ‘the whole motijheel episode was aired live by TV channels’. Neither of these claims tallies with the reality on the ground, though.
তাণ্ডবে ক্ষতি হলো কাদের?
এখন বেশির ভাগ মিডিয়ায় ‘হেফাজতের তাণ্ডব’ একটি বড় ইস্যু। সে তুলনায় শাপলা চত্বরের ‘তাণ্ডব’ গৌণ করে দেখানো হচ্ছে। শান্তিকামী নাগরিকদের কাছে তাণ্ডব তাণ্ডবই। রাজপথের সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দু’টিই বিপজ্জনক সাধারণ মানুষের জন্য। প্রকাশ্য দিবালোকে বায়তুল মোকাররম এলাকার সন্ত্রাসে মানুষের মাল গেছে। আর মধ্যরাতের অন্ধকারে শাপলা চত্বরে হামলায় মানুষকে খোয়াতে হলো প্রাণ। যারা রাস্তায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে, তারা ‘জনগণের জন্য’ আন্দোলনের কথা বলে এসব কাজে মেতে ওঠে। তেমনি, সরকারের বাহিনীগুলো ভালো-মন্দ, দরকারি-বেদরকারি, হামলা-হত্যা, পাকড়াও, পিটুনি ইত্যাদি যা-ই যে উদ্দেশ্যে করুক না কেন, সব ক্ষেত্রে ‘জনস্বার্থ’ কথাটার উল্লেখ অনিবার্য ও অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।
যা হোক, ক্ষতিগ্রস্ত হকার-দোকানি, ব্যাংকার-ব্যবসায়ী যেমন এ দেশের মানুষ, তেমনি হতাহত, আটক ও নির্যাতিত ‘হেফাজতিরা’ও এই বাংলাদেশেরই সাধারণ নাগরিক। তারা ভারতীয় জঙ্গি কিংবা পাকিস্তানি তালেবান নয়। আগুন ও ভাঙচুরে সব মালামাল হারিয়েছেন ফুটপাথের শত শত খুদে ব্যবসায়ী। তারা দরিদ্র, বড় জোর নি¤œ মধ্যবিত্ত। অন্য দিকে, হেফাজতের সমাবেশে যারা এসেছিল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে, তারাও প্রধানত নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণীর তালেবে এলেম বা ‘হুজুর’। যারা সেই মহাসমাবেশ নিজ চোখে দেখেছেন, তারা এর সাক্ষী। আবার সংঘর্ষকালে উত্তেজিত লোকজনের হাতে বা অন্যভাবে, পুলিশ ও বিজিবির যারা মর্মান্তিকভাবে প্রাণ দিয়েছেন, তারাও সাধারণ পরিবারের সদস্য।
এই যে তিন ধরনের মানুষের কথা বলা হলো, ছোট দেশটিতে তাদের অনেকের মধ্যেই আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক হেফাজতি, ব্যবসায়ী, পুলিশ-বিজিবি নির্বিশেষে। নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের বেশির ভাগই হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখন আমরা দেখছি, শাপলা চত্বরে নিহত তরুণের মা-ভাইবোন, নিহত পুলিশ-বিজিবি সদস্যের স্ত্রী-সন্তান আর সর্বস্বহারা হকার-দোকানিদের আহাজারি।
কুরআন পোড়ানোর রহস্য
৫ তারিখে বায়তুল মোকাররমের উত্তর আর দক্ষিণ পাশের রাস্তা-ফুটপাথে তাণ্ডবের প্রেক্ষাপটে লেট নাইট অপারেশনের তাণ্ডব চালানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন : ক. যারা ফুটপাথের দোকানপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে নির্বিচারে, তারা যে বিশেষ একটি দল বা গোষ্ঠীর, তা কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়? বিভিন্ন দেশে এমন অনেক ক্ষেত্রে এজেন্ট দিয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো হয়। তদুপরি, সুযোগসন্ধানীরা ফায়দা লুটতে ‘আগুনে ইন্ধন জোগায়’। খ. কয়েক শ’ খুদে দোকানে ধ্বংসযজ্ঞ এবং কয়েকটি ভবনে আগুন দেয়া যদি নৈশ অভিযানের কারণ হয়, তা হলে জিজ্ঞাসা, বিকেলে ও সন্ধ্যায় সংশ্লিষ্ট দুর্বৃত্তরা এসব ঘটিয়ে গভীর রাতেও এক কিলোমিটার দূরে হেফাজত সভাস্থলে গিয়ে বসে থাকবে বলে বিশ্বাস করা যায় কি? টিভিতে অসংখ্য মানুষ দেখেছেন, বায়তুল মোকাররম ও পল্টন মোড় এলাকায় সংঘর্ষ-সহিংসতার সময়েও মতিঝিলজুড়ে সমাবেশ চলছিল স্বাভাবিকভাবে, শান্তিপূর্ণ অবস্থায়। তাই শাপলা চত্বর মঞ্চ থেকে বহু দূরের ওসব স্থানের সংঘর্ষ, ভাঙচুর, আগুনের কারণে মতিঝিলের সে চত্বরে শত শত সশস্ত্র পুলিশ ও অন্য দু’টি বাহিনীর হামলার যুক্তি থাকে না।
দৈনিক ইনকিলাব ৮ মে সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় এক রিপোর্টে জানায়, বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটের ুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকের মাঝে ভর করেছে জীবনহানির ভয়। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই কুরআন পোড়ানোর মতো জঘন্য কর্মকাণ্ডে যুক্ত দুষ্কৃতকারীদের চিনতে পারলেও এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। জীবনের ভয়ে কেউ-ই নিজের পরিচয় প্রকাশ তো দূরের কথা, সাংবাদিক দেখলেই এড়িয়ে চলছেন। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা এ ঘটনায় কেউ-ই হেফাজতে ইসলামকে দায়ী করেননি। এটাকে তারা ‘সুযোগসন্ধানী দুষ্কৃতকারীদের জঘন্য কাণ্ড’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তারা বলছেন, ‘যে আলেম ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা কুরআন ও নবী সা:-এর সম্মান রক্ষার্থে জীবন দিতে ঢাকায় এসেছিলেন, তারা এ কাজ করেছেনÑ এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। বরং হেফাজতে ইসলামকে ঘায়েল করতেই এক ধরনের ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়াকে দিয়ে এ বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে।’
ওই পত্রিকার রিপোর্টারকে ক্ষতিগ্রস্ত ুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে বলেছেন, ‘আমরা এসব দুষ্কৃতকারীর নাম প্রকাশ করে দিলে আমাদের গুম বা নিখোঁজ করে দেয়া হবে। শার্টপ্যান্ট পরা অগ্নিসংযোগকারীরা গ্যালনে করে পেট্রল নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে এসেছিল। বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটের অনেকেই তাদের চেনেন। তারা হেফাজতের কেউ হতে যাবেন কেন?’ বায়তুল মোকাররম আদর্শ পুস্তক ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাওলানা মুজিবুর রহমান কুরআন পোড়ানোর ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, কিছু টিভি ও মিডিয়ায় হেফাজতের ঘাড়ে এ ঘটনার দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারের উচিত এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। দক্ষিণ গেটের একজন বই-বিক্রেতার মতে, ইসলামি বই মার্কেটে তাদের দোকান বরাদ্দ দিলে এ সমস্যা হতো না। বই ব্যবসায়ী নয়Ñ এমন লোকদের সেখানে বরাদ্দ দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে তার অভিযোগ।
সেখানকার একজন টুপি ব্যবসায়ী জানান, সাহায্য পাওয়ার জন্য তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন। তার ভাষায়, ‘কে আগুন দিয়েছে, আমরা দেখিনি। তাই সে আবেদনে হেফাজত দায়ী বলে উল্লেখ করা ঠিক হয়নি।’ একজন বই ব্যবসায়ী বলেন, হেফাজত রাজধানীতে কুরআন পোড়ানোর জন্য আসেনি। তাদের ঘায়েল করতে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এ কথাগুলো বললেও এই মার্কেটের মালিক সংস্থা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর (মার্কেট) মহিউদ্দিন মজুমদারের দাবি, ‘হেফাজতই দোকান পুড়িয়ে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি করেছে।’
ড. কামাল, আসিফ নজরুল, পীর হাবিব
ড. কামাল হোসেন শুধু সাবেক পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীই নন, ‘৭২ সালের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের অন্যতম প্রধান প্রণেতা। তিনি হেফাজতে ইসলাম এবং ধর্মীয় রাজনৈতিক মহলের ঘোর বিরোধীদের একজন। গত ৮ মে ডেইলি স্টারে তার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। তিনি এতে বলেছেন, ‘হেফাজত ইস্যুতে সরকার যা করেছে, তাতে দেখা যায়Ñ সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাও নেই। এটা গণতান্ত্রিক নয় মোটেও।’ ড. কামাল বললেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কিছু ব্যতিক্রমধর্মী কথা বলেছেন। যেমন, হেফাজতের লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করতে বল প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। আরো আগ বাড়িয়ে বললেন, এমনকি তারা যাতে বাড়ি থেকেও বের হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা হবে।’ এ ব্যাপারে কামাল হোসেনের বক্তব্য, ‘কোনো নাগরিক যে দল-মতেরই হোন না কেন, তাকে হুমকি দেয়া অকল্পনীয়। যদি জনগণকে নিজ নিজ ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন, তাহলে নিজেকে কিভাবে গণতন্ত্রী বলে মনে করতে পারেন? সংবিধানের অনুসারী কোনো সরকারের আচরণ এমন হতে পারে না। তাদের অবশ্যই সম্মান করতে হবে সংবিধান এবং প্রতিপক্ষের অধিকারকে।’
টকশোতে প্রায়ই বক্তব্য দেন এমন একজন বিশিষ্ট কলামিস্ট ড. আসিফ নজরুল। তিনি ১০ মে প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘সাধারণ যুক্তিতে দেখলে শাপলা চত্বরে সরকারের হত্যাযজ্ঞ চালানোর কোনো কারণ নেই। স্পষ্টত, সে দিন সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল, হেফাজতের কর্মীদের শাপলা চত্বর থেকে বিতাড়িত করা। এ কাজটি করার জন্য বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রয়োজন পড়ে না। তবে কোনো আন্দোলনস্থল ত্যাগ না করার জন্য অনেক মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলে সুকৌশলী অভিযান ছাড়া একদমই বিনা রক্তপাতে তাদের বিতাড়ন সব সময় সম্ভব হয় না।’ তাই এই কলামিস্ট মনে করেন শাপলা চত্বরে প্রাণহানি ‘স্বাভাবিক’।
এই কথাগুলো যিনি বললেন, তিনিও এরপর না বলে পারলেন না, ‘শাপলা চত্বরে যৌথবাহিনীর অভিযানটি ছিল একতরফা। পুলিশি কর্ডনের ভেতর থাকা স্লোগান বা জিকিররত মানুষকে মধ্যরাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে বিতাড়নকালে যে শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে, তা বিরল এবং ভয়ঙ্কর একটি ঘটনা।’ আসিফ নজরুল প্রশ্ন রেখেছেন, ‘শাপলা চত্বরের মানুষ মধ্যরাতে কি কারও জানমালের প্রতি তাৎক্ষণিক কোনো হুমকি ছিল?… হেফাজতে ইসলাম, বিশেষ করে আল্লামা শফীর সাথে আরো আলোচনা করে তাদের স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কি শাপলা চত্বর ত্যাগ করানোতে রাজি করা যেত না?… এই অভিযান প্রচারকারী বিরোধী দলপন্থী টিভি চ্যানেলগুলোকে কেন বন্ধ করে দেওয়া হলো, যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।’
৮ মে বাংলাদেশ প্রতিদিনে কলাম রিখেছেন এর নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান। হেফাজতে ইসলাম ইস্যু নিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ যেখান থেকে সঙ্ঘাতকে উসকানি দিয়ে মাটি খুঁড়ে হেফাজতকে বের করে আনা হয়েছিল সেটিও সরকার গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সরকার শেষ বেলায় হলেও সিদ্ধান্তটা ঠিকমতো নিয়েছে।’ অবশ্য শাহবাগ মঞ্চের উদ্যোক্তারা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে খোলা রাস্তায় কর্মসূচি পালন করছেন।
এই কলামিস্ট ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং আওয়ামী মহলের ঘনিষ্ঠ। তিনি পর্যন্ত ৬ মে মধ্যরাতে শাপলা চত্বরের অবর্ণনীয় পরিস্থিতিতে মর্মাহত। লিখেছেন, ‘হেফাজতের মঞ্চের কাছে লাশ কাঁধে নিয়ে কর্মীরা ছুটে আসছেন, বেসরকারি টিভি চ্যানেলে লাইভ দেখা যাচ্ছে। অন্য দিকে আল্লাহর দরবারে করুণ আর্তি ও বিচার চেয়ে যে মোনাজাত হচ্ছিল, তা যেকোনো ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করবেই।’
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিবসহ কয়েকজন শীর্ষনেতাকে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত করে সরকার মামলা, গ্রেফতার ও রিমান্ডের ব্যবস্থা করেছে। সরকার বলছে, এ টাকা সরকারের প্রতিপক্ষ মহল দিয়েছে। আর পীর হাবিবুর রহমান বলছেন, ‘খোদ আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ে এমন খবরও বলাবলি রয়েছে যে, হেফাজত আগেরবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি সফল করে চলে যাবে, এই শর্তে দূতিয়ালের মাধ্যমে হেফাজতকে যে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল, তার একটি বড় অংশই নাকি গায়েব হয়ে গেছে। কারো কারো মতে, দূতিয়ালের পকেটেই ঢুকেছে সেই টাকা।’ আমরা এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাই না এ বিষয়ে। যত বিতর্কই হোক, সত্য এক দিন প্রকাশ পাবে।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই
দেশের বিশিষ্ট অনেক আলেম শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড এবং বায়তুল মোকাররম মার্কেটে তাণ্ডবকালে কুরআন শরিফ পোড়ানোর ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জোরালো দাবি জানিয়েছেন। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিএনপির অন্যতম শীর্ষনেতা মওদুদ আহমদ জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে এ ব্যাপারে বিচার বিভাগের মাধ্যমে তদন্ত করার দাবি জানালেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) হেফাজতবিরোধী মনোভাব সত্ত্বেও বিচারিক তদন্তের অপরিহার্যতা উল্লেখ করেছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্বচ্ছতার ওপর গুরুত্বারোপ করে টিআইবি বলেছে, “শাপলা চত্বর থেকে সমাবেশকারীদের অপসারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে অভিযান পরিচালনা করেছে, তার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং সে অভিযানে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে ‘গুজব’ অবসানের জন্য অবিলম্বে শ্বেতপত্র প্রকাশের আহ্বান জানাই।” এ দিকে দেশের গণতন্ত্রমনা ও শান্তিকামী নাগরিকেরা উপলব্ধি করছেন, ৫ মে দিনে ও সন্ধ্যায় বেসরকারি লোকজন এবং গভীর রাতে সরকারি বাহিনীর তাণ্ডব উভয় ক্ষেত্রে দায় কাদের, তা নির্ধারণ করা এবং প্রকৃত দোষীদের যথাযথ বিচারে উপযুক্ত শাস্তি হওয়া জরুরি। এ জন্য সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে অবিলম্বেই।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন