১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় এ দেশে
জমিদারিপ্রথা বিলুপ্ত হয়। কায়িক পরিশ্রম ছাড়া বসে থেকে আরাম-আয়েশে
জীবনযাপনকারী জমিদার শ্রেণীর মানুষ পড়েন তখন মহা বিপাকে। বিশেষ করে হিন্দু
জমিদারেরা প্রমাদ গোনেন, এ দেশে আর থাকা কেন? মুসলমান প্রজারা পাকিস্তানের পে ভোট দিয়েছেন মুসলিম লীগের
প্রার্থীদের। তখন মুসলিম লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা ছিল, পাকিস্তান কায়েম
হলে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হবে। এ দফা পূর্ববাংলার আপামর কৃষক-প্রজাদের
পাকিস্তানের পে ভোট দিতে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
ওই নির্বাচনে কিছু রাজনৈতিক দলের যে জোট হয়েছিল, তাতে মুসলিম
লীগের সাথে যুক্ত বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি শরিক ছিল। সেই নির্বাচনে ভারতের
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ছিলেন মুসলিম ভোটার-অধ্যুষিত
রংপুরের সৈয়দপুর আসনের প্রার্থী। তখন জ্যোতি বসুর পে মাঠে নেমেছিলেন মুসলিম লীগের
অবিসংবাদী নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ মুসলিম
নেতা। সৈয়দপুর আসনের ভোটারদের বেশির ভাগ ছিলেন অবাঙালি রেলওয়ে শ্রমিক। জ্যোতি
বসুর সেটাই ছিল জীবনের প্রথম নির্বাচন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অধ্যাপক কবি
হুমায়ন কবির। তিনি ছিলেন কংগ্রেস ও শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির
সমর্থিত প্রার্থী। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে ছিল তার
ঈর্ষণীয় আধিপত্য। শিতি বাঙালির ঘরে ঘরে ও সুধী সমাজে সুপরিচিত নাম। জ্যোতি বসুর
চেয়ে বয়সেও বড় ছিলেন হুমায়ন কবির। শিা-দীা, যোগ্যতা ও বহুমাত্রিক
অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অপূর্ণ ছিল না তার। একজন যোগ্যপ্রার্থীর যে মানদণ্ড তার সবই ছিল
হুমায়ন কবিরের। সেই হেভিওয়েট প্রার্থীর সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয় তরুণ
ব্যারিস্টার জ্যোতি বসুর। তাতে কী? নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে যে
ছলাকলা, তন্ত্রমন্ত্র প্রয়োজন তার সবই রপ্ত করা ছিল তার। লন্ডনে
ব্যারিস্টারি পড়ার সময় তার সহপাঠী ছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর ছোটভাই আহম্মেদ
আলী। তার আস্তিন ধরে জ্যোতি বসুর মোহাম্মদ আলীর কাছে যাওয়া এবং সেই সূত্রে শহীদ
সোহরাওয়ার্দীর আস্থা অর্জন করে অবাঙালি মুসলিম আসনের মনোনয়ন বাগিয়ে নিতেও সম
হন। নির্বাচনে বিজয়ী হতে তাকে বড় বেশি বেগ পেতে হয়নি।
মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, আবুল হাশিমদের
কথায় সে দিন সৈয়দপুরের অবাঙালি মুসলিমরা জ্যোতি বসুকে ভোট দিয়েছেন। তাই দেখা
যায় বাঙালি জ্যোতি বসু তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম নির্বাচনে জিতেছেন আবাঙালি
মুসলমানদের ভোটে। তখন মুসলমানদের ভোট নিতে কমরেড, কমিউনিস্টদের নাসিকা কুঞ্চিত
হয়নি। রাজনীতির ইতিহাসের নানা বাঁকে কমিউনিস্ট বামদের বিবেচনায় যারা
সাম্প্রদায়িক, স্বৈরাচার তাদের সাথে রাজনৈতিক পিরিত কোনো বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু
সেসব বিষয় আলোকপাত করা হয় না বলে তারা বরাবর ধোয়া তুলসী পাতা থেকে যান।
স্বৈরাচার বলতে যাদের মুখে ফেনা ছোটে, সেই কমিউনিস্ট পার্টিকেও আমরা ১৯৮৬
সালে এইচ এম এরশাদের পার্লামেন্টে দেখেছি। তখন পার্টির জাঁদরেল সব নেতা সংসদ সদস্য
নির্বাচিত হন। বিএনপির বয়কট করা সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীও
শরিক হয়। এরশাদ তার জাতীয় পার্টি নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলে শেখ
হাসিনা চট্টগ্রামে এক জনসভায় বড় গলায় বলেন, সামরিক স্বৈরাচারের নির্বাচনে
যারা অংশগ্রহণ করবে তারা জাতীয় বেঈমান।
তা বাতাসে ভেসে টেকনাফ হয়ে তেঁতুলিয়া না পৌঁছাতেই শেখ হাসিনা
গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ঘোষণা দিলে দেশের মানুষের
কাছে উন্মোচিত হয় তার চরিত্র। তার চার বছর আগে ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ অস্ত্রের মুখে
রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাপ্রধান এরশাদ
যখন রাষ্ট্রমতা দখল করেন, তখন ভাষার চাতুর্যে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে দেখেছে দেশের মানুষ।
এরশাদের মতা দখলের ঘটনায় শেখ হাসিনা ‘অখুশি নন’ বলে তার সমর্থন প্রকাশ করেন।
তার নয় মাস আগে ভারতের নৈনিতাল থেকে দীর্ঘ প্রবাসজীবন শেষ করে বাংলাদেশে
প্রত্যাবর্তনের মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট
হাউজে বিপথগামী সেনাবাহিনীর একটি গ্র“পের হাতে দেশপ্রেমিক জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শাহাদৎ বরণ
করেন। শেখ হাসিনাকে মতায় বসাতে তখন থেকেই দেশের ভেতর ও প্রতিবেশী নানা শক্তিকে
সক্রিয় হতে দেখা যায়। ১৯৮২ সালে সেনাপতি এরশাদের অবৈধ মতা দখল ছিল শেখ হাসিনার
জন্য মাঠ তৈরির অংশ। ১৯৮৬-এর নির্বাচনের আগে তার অনেক আলামত পাওয়া যায়। সে সময়
রাজশাহী বিভাগের আওয়ামী লীগের কয়েক ডজন শীর্ষ নেতা মিলিত হন বগুড়ার দণি পাড়ার
মতাবানদের নিবাসে। সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের
আলোচ্য বিষয় ছিল ‘জাতীয় নির্বাচন’ নিয়ে। বৈঠকে
রাজশাহী বিভাগের ৭৭টি সংসদীয় আসনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের কৌশলগত
অবস্থান নিয়ে আলোচনা হয়। সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগের অংশ নেয়ার খবর বগুড়ার একটি
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলে দলটির এই এলাকার কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে বিচলিত
হয়ে ওঠেন। স্থানীয় পত্রিকার সংবাদ বলে তার সত্যতা ও ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে
অস্বীকার করতে চান তাদের কেউ কেউ। তবে যাদের সাথে তাদের বৈঠক হয় সেই পরে কেউ ওই
সংবাদ নিয়ে তখন আপত্তি করেননি। কথাগুলো বলা প্রয়োজন এই জন্য যে, আওয়ামী লীগের
সেনা সম্পর্কের রাজনীতি কত গভীর তা যারা ক্যান্টনমেন্ট-বিরোধী কথা বলে নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ হিসেবে জাহির করেন এবং ওই দলের লেজুড়বৃত্তি করেন, তাদের ও আওয়ামী
লীগের খাসলতের এ এক সামান্য উদাহরণ। এমন অসংখ্য নজির আছে।
বাংলাদেশে সেনাসম্পর্কিত ঘটনায় আওয়ামী লীগের আঁতাতের রাজনীতি তো
ছিল ‘ওয়ান ইলেভেন’। দলটির নেত্রী নিজেই যখন
রাখঢাক না করে বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেন সরকার’ তাদের আন্দোলনের ফসল। তখন দেশের রাজনীতির ক খ জানা মানুষের বুঝতে
কোনো বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিতের কাছে যেতে হয়নি। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ফখর উদ্দীন-মইন
উদ্দিনকে আস্বস্ত করেন এই বলে যে, আওয়ামী লীগ মতায় গেলে তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হবে। বৈধতার
নিশ্চয়তার পর দেশের সচেতন মানুষ দেখেছেন, দুই উদ্দিনের অবৈধ সরকার দুই
বছরে যেসব কাজ করেছেন তাতে শেখ হাসিনার মতায় আসার রাস্তা নিষ্কণ্টক হয়।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূলের শক্তি ও অবলম্বনগুলো
দুর্বল করে দেয়া হয়। সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার
বিরুদ্ধে জনগণকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলতে ওই দুই বছরে চাল, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, সবজির প্রভৃতি
মূল্যস্ফীতি ঘটিয়ে মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, শ্রমজীবী গরিব মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলা হয়। শহর-বন্দরের
পাশাপাশি গ্রামের হাট-বাজারের দোকানপাট উচ্ছেদ অভিযানে সরাসরি সেনাবাহিনীর
সদস্যদের ব্যবহার করে তাদের ওপর জনগণের আস্থার জায়গায় চির ধরানোর কাজো ছিল দুই
উদ্দিনের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। গ্রামের হাট-বাজারে রোজগারের জায়গা হারানো
সারা দেশের লাখ লাখ মানুষের হিসাব আমরা কে রেখেছি? ভুক্তভোগীরা বলেন, আওয়ামী লীগের পে
তখন মাঠ তৈরির কাজ কতই না সূক্ষ্ম ও চতুরতার সাথে করা হয়েছে। ভোগ্যপণ্য ও
নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে জনসাধারণের কষ্টের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। তখন
বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা প্রত্য করেছেন, গ্রাম থেকে শাকসবজি বিক্রি
করতে নিয়ে আসা চাষি ও ব্যবসায়ীদের শহরের বাজারে বসতে দেয়া হয়নি। এক দিন
বগুড়ার বাজারে গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থেকে বেগুন ও কুরিকচু বিক্রি করতে আসা
এক বৃদ্ধা ও তার ছেলেকে অন্যায়ভাবে মারধর করে বাজারে ত্রাস সৃষ্টি করে মঈন
উদ্দিনের পোশাক পরা লোকজন। বগুড়া শহরের বড় কাঁচাবাজারে তখন মাঝে মধ্যে তথাকথিত
বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে অভিযান চালিয়ে ুদ্র পুঁজির কাঁচামালের ব্যবসায়ীদের ওপর ‘মতা’ দেখানো হতো। আর সেই পরিস্থিতিতে বাজারে সরবরাহ কমতে থাকে। বাড়তে
থাকে প্রতিটি সবজির দাম। ভোক্তা জনসাধারণের নাভিশ্বাস ওঠে। সে সময় সারা দেশের
হাটবাজারে মইন উদ্দিনের লোকজন ওই একই মাত্রার কাজ করেছে। এসব কাজের উদ্দেশ্য ছিল
বাজারে সরবরাহ কমে মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জনসাধারণের ভোগান্তি
বাড়ানো। দুর্ভোগের কারণে মানুষ তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু
করে। শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের জন্য তখন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা
ভঙ্গের কাজ করেছিল ফখর উদ্দীন, মইন উদ্দিন গং। শেখ হাসিনার কাম্য কাজ করে তারা বিদেশে নিরাপদ
নির্বাসিত জীবন যাপনের সুযোগ পেয়েছেন।
সেই গ্রাউন্ড ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধান থেকে খালাস করা হয়েছে। আর এসব কাজ করা
হয়েছে ‘ভিশন টু টোয়েন্টি ওয়ানকে’ সামনে রেখে।
ওয়ান ইলেভেন সরকারের দুই বছরে ‘ভিশন টু টোয়েন্টি ওয়ান’-এর গুণাগুণ ফেরি
করতে দেখা গেছে বিশেষ ঘরানার সুশীল বাবুদের। বগুড়ায় তখন তাদের ব্যয়বহুল এক
সেমিনারের বক্তব্য থেকে আঁচ করা যায় সরকারে কারা আসছে ও কী ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিং
করে ‘ভিশন টু
টোয়েন্টি ওয়ানের’ সরকারকে মতায় বসানো হবে।
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক খালাস মানে তো আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দল বা জোটের
মতায় আসার সুযোগ থাকছে না। বগুড়ার পর্যটন মোটেলে সেই অনুষ্ঠানে মূল বক্তার
ঘুরেফিরে একটাই কথা ছিল ‘ভিশন টু টোয়েন্টি ওয়ানের’ জন্য পাঁচ বছর
মেয়াদি সরকার দিয়ে ল্য অর্জন সম্ভব নয়। ভাষার চাতুর্যে তিনি যে কথা বলেছেন, তার সার কথা ছিল
সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তির পর দ্বিতীয় দফায় দেশ শাসনের ধারাবাহিকতা রার
সুযোগ থাকতে হবে। দেশবাসীর কাছে এখন তো সব কিছু স্পষ্ট ‘ভিশন টু টোয়েন্টি ওয়ানের’ ল্য অর্জনের জন্যই সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল
করা হয়েছে। আর তা করে শেখ হাসিনাকে দ্বিতীয় মেয়াদে মতায় পুনর্বহালের ব্যবস্থা
পাকাপোক্ত করতে সুশীল বাবুদের লুকোচুরির আর কী অবশিষ্ট আছে? ‘ভিশন টু টোয়েন্টি ওয়ান’ সম্পর্কে
উন্নয়নের যত ফুলঝুরি ছড়ানো হোক না কেন? এ সম্পর্কে আমাদের যত
তাড়াতাড়ি মোহমুক্তি ঘটবে, ততই শত্র“র ষড়যন্ত্র নিষ্ফল করার মিছিলে শক্তি জোগাবে। মনে রাখতে হবে এ মিছিল
শরণার্থী শিবিরের সদস্য হওয়ার তালিকায় নাম উঠানোর মিছিল নয়। ১৯৪৭ সালে অর্জিত
মানচিত্র ঘিরে ১৯৭১-এর স্বাধীনতাকে ‘মোন্না’ শকুনের কালা থাবা থেকে হেফাজত
করার মিছিল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন