সরকার সম্ভবত পৃথিবীতে সব কিছু জয় করে ফেলেছে। অথবা মনে করছে যে, জয় করে ফেলেছি। আর সে কারণে এখন সরকার ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করছে। কিন্তু তারা স¤ভবত পাখা-ওঠা পতঙ্গের মতো আগুনেই লাফ দিতে যাচ্ছে। তারা যে একেবারেই বুঝতে পারছে না, এমন নয়। আমরা ছেলেবেলায় বিদ্যুৎবিহীন গ্রামে বসবাস করেছি, সেখানেই পড়ালেখা করেছি। কেরোসিনের কুপি কিংবা হারিকেনের আলোতে ছিল আমাদের পড়াশোনা। এসব আলোর চারপাশে ভাই-বোনরা বসে একসঙ্গে পড়েছি। তখন পতঙ্গের আত্মহনন প্রক্রিয়া অবিরাম দেখেছি। কুপির নিচে পাখা-ওঠা পতঙ্গের স্তূপ জমে গেছে। আমরা শক্ত কাগজ দিয়ে সেগুলো সরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে আবার পড়ালেখায় মনোনিবেশ করেছি।
এভাবেই আমরা শৈশব-কৈশোর এবং প্রারম্ভ-তারুণ্য পার করেছি। বিদ্যুৎ এসেছে তারও পরে। কিন্তু প্রতিনিয়ত পতঙ্গের অবিরাম মৃত্যু আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পতঙ্গের ওড়া-উড়ি দেখছি। এটা ঠিক আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নয়।
যেন এক অনিবার্য পরিণতির দিকে এক অন্ধ শাসক সমাজ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। অথবা তারা এই মর্মে নিশ্চিত হয়েছে যে, তারা মানবাধিকারের যত লঙ্ঘনই ঘটাক না কেন সারা পৃথিবী তাদের সমর্থন দিয়েই যাবে। কারণ তারা বাংলাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূলের কর্মকা- অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে পরিচালনা করছে।
এদেশে যারা ধর্মবিশ্বাসী, তারা এখন রাষ্ট্রের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র সকল শক্তি প্রয়োগ করে তাদের নির্মূলে বদ্ধ-পরিকর। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার গণহত্যায়ও কুণ্ঠিত নয়। গত ৫-৬ মে হেফাজত ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা এখন আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা বলে অভিহিত হচ্ছে। দশ থেকে পনের হাজার সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী নিয়ে সরকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের ঘুমন্ত লাখ লাখ কর্মীর ওপর হামলে পড়ে। সেই হামলায় কত মানুষ খুন হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। হেফাজত দাবি করেছে, তাদের প্রায় আড়াই হাজার কর্মী ঐ রাতে নিহত হয়। সরকার বলেছে , ঐ হামলায় কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। তাহলে দেড় লাখ রাউন্ড বুলেট, সাউ- গ্রেনেড, রাবার বুলেটÑ এর সবকিছুই কী ছিল মিত্র-প্রতীম?
পৃথিবীর কেউ তা মেনে নেয়নি। এক এক মিডিয়া এক এক রকম তথ্য দিলেও সবার বক্তব্য ছিল একই। সেখানে এক গণহত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আল জাজিরা একজন গোরখোদকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। গোরখোদক জানিয়েছে, সে একাই জুড়াইন গোরস্থানে দাঁড়িওয়ালা জোব্বাপরা চৌদ্দজন লোককে সমাহিত করেছে। আর আলজাজিরা দাবি করেছে যে, তাদের কাছে হত্যাযজ্ঞের ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। এ ছাড়াও ফেসবুক-টুইটারে শত শত ফটো, ভিডিও বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশে এ গণহত্যা এখন বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত সত্য।
সরকার ভেবেছিল কয়েক হাজার টুপি-দাঁড়িওয়ালা লোককে যদি তারা হত্যা করতে পারে, তবে পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমান হত্যার জন্য তাদের বিরাট অভিনন্দন জানানো হবে। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক তেমনটা হয়নি। মুসলমান নিধনযজ্ঞ মানেই বিরাট কৃতিত্বের কাজ, এমনটা গোটা বিশ্ব মেনে নেয়নি। পৃথিবীর মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই গণহত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করছে অত্যন্ত সরবে। মুসলমান হত্যা যদি ক্ষমতায় থাকার চাবিকাঠি হতো, তাহলে যুগোশ্লাভিয়ার মাইলো স্লোভিচ বিচারের মুখোমুখি হতেন না। রুয়ান্ডা হত্যাযজ্ঞ নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত এক পা-ও অগ্রসর হতো না।
কিন্তু বাস্তব ঘটনা হলো, আওয়ামী লীগ এই ধারণার উপরেই মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের লোকেরা বলছেন, যদি এত লোক খুনই হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা এগিয়ে আসছেন না কেন? তারা এসে তো জানান দিতে পারেন যে, তাদের স্বজনরা ৫ তারিখের পর এখনও বাড়ি ফেরেনি। এ-ও এক অন্ধত্বের শামিল। হেফাজতের কর্মী-সমর্থকরা অতি দরিদ্র সাধারণ মানুষ। তারা ইসলামকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে। ঐ হত্যাযজ্ঞের পর প্রতিটি মসজিদের ইমাম আজ নজরদারিতে, চাপের শিকার। তাদের বলতে বাধ্য করা হচ্ছে যে, তারা হেফাজতের সঙ্গে নেই। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম লিখেছেন, এখন মসজিদের ইমামরা অশ্রু দিয়ে আওয়ামী নেতাদের পা ধুইয়ে দিতেও প্রস্তুত। তাদের পেছনে নামায পড়তে তার কুণ্ঠাবোধ হয়।
অথচ এদের পরিচয় অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, এরা অতি সাধারণ মানুষ। কর্ম আর ধর্ম নিয়ে থাকেন। সরকারের বুলেট-গ্রেনেড-বেয়োনেট-পিটুনির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের কাছে আল্লাহু আকবর ছাড়া আর কোনো ধ্বনি নেই। এই ফ্যাসিবাদী শক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে তারা শুধু ঐ ধ্বনিই দিতে পারেন। আর যাদের বুকে ফ্যাসিবাদী সরকারের গুলী লেগেছে, তারা সম্ভবত প্রত্যেকেই মৃত্যুর আগে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ’ এই কলেমা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের বেহেশত নসিব করুন।
ঘটনা তো আর চেপে রাখা যায়নি। ঠিক আছে, সমস্ত ব্লগ, ইন্টারনেটে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ সরকার অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু গুগল আর্থে ধারণকৃত ফুটেজ তো অস্বীকার করা যাবে না। সেখানে ৬ মে শুরুতে সরকার যে পৈশাচিক হামলা চালিয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র ধারণ করা আছে। তাহলে? সরকার বলছে, সেদিন শাপলা চত্বরে কোনো হতাহতের ঘটনাই ঘটেনি। তাই যদি হয় তাহলে খুব ভোর থেকে দমকল বাহিনী ও মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি দিয়ে কেন দৈনিক বাংলা মোড় থেকে এক নম্বর রামকৃষ্ণ মিশন রোড পর্যন্ত হোসপাইপ দিয়ে ধুয়ে দেওয়া হলো। এবারে রক্তের দাগ শুকানোর আগেই সে দাগ মুছে ফেলতে চেয়েছে সরকার। এত রক্ত চাই? সাধারণ মানুষের এত রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চাই? ক্ষমতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়ও ব্যক্তির জীবন দীর্ঘস্থায়ী নয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই তার মৃত্যু অনিবার্য। র্যাব, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে ক্ষমতা হয়তো দীর্ঘস্থায়ী করা যায়, কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা প্রতিটি মানুষের জন্য যতটুকু জীবন নির্ধারণ করেছে তা প্রলম্বিত করা যায় না।
ওকে, বাংলাদেশের সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু অটোগ্রাফ ও ফটোগ্রাফ শিকারি পার্লারচর্চিতা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হঠাৎ করেই কেন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রয়োজন হলো? তার আগে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশ সফর করে সরকারের উদ্দেশ্যে কেনই বললেন, “সমস্যা দ্রুত মীমাংসা করুন। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।” এ রকম সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি একেবারে হুড়োহুড়ি করে ছুটে গেলেন জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলতে। বান কি মুনের সঙ্গে বাংলাদেশের কী কথা? এটা সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেল না। পার্লারচর্চিতা দিপু মনি জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বিনা নোটিশেই ছুটে গেলেন নিউ ইয়র্ক।
জাতিসংঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের ভাষ্য মতে, “দিপু মনি বান কি মুনের সঙ্গে সাভার গার্মেন্ট বিপর্যয়, দেশের রাজনৈতিক সংঘাত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান এবং আসন্ন সাধারণ পরিষদ সভায় আলোচ্য বিষয়াদি”, প্রভৃতি নিয়ে বান কি মুনের সঙ্গে আলোচনা করেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, আসলে দিপু মনির এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দিপু মনি এমন এক সময় জাতিসংঘ সফরে গেলেন যখন মহাসচিব বান কি মুনের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকো ঢাকা সফর করছিলেন। সম্ভবত সে সময় জাতিসংঘ বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভিন্ন কোনো চিন্তা শুরু করেছে।
২০০৭ সালেও আমরা এমন পরিস্থিতি দেখেছি। এটা অজানা নয় যে, ঐ সময় জাতিসংঘ (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য মিলে) সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং ঘোষিত নির্বাচন বাতিলে প্রভাবিত করেছিল। এটা জাতিসংঘের কাছ থেকে কিছুতেই আশান্বিত ছিল না। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকামী মানুষ জাতিসংঘসহ ঐসব অপশক্তির ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ করেছে। আর সে জন্যই বার্তা সংস্থা রয়টার তার প্রাথমিক রিপোর্টে লিখেছিল যে, “আপনারা যদি মনে করেন জাতিসংঘ কোনো সামরিক অভ্যূত্থান করে না, তাহলে দ্বিতীয়বার চিন্তা করুন।”
এখন সরকার তথ্য প্রবাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ধারাবাহিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। সে নিশ্চিহ্নকরণ শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, শারীরিকভাবেও। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনির জাতিসংঘ ভ্রমণ আকস্মিক নয়। এই ভ্রমণ তিনি তখনই হুট করে করলেন, যখন মানবাধিকার সংস্থাসমূহ ও স্বাধীন আইনজীবীরা ২০১৩ সালের ৬ মে ভোরে হেফাজতে ইসলামের প্রায় আড়াই হাজার কর্মী-সদস্য হত্যার জন্য জাতিসংঘের কাছে এর নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে একটি গণহত্যা তদন্ত করার আবেদন জানান। সাপ্তাহিক হলিডে লিখেছে, দিপু মনির আকস্মিক ও তরিৎ নিউ ইয়র্ক সফরের কারণ হলো এই যে, জাতিসংঘ যেন এ ধরনের তদন্তের কোনো আয়োজন না করে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার সহযোগীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার জন্য বিচার না করে।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এক অংশীদার। এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মানবতাবিরোধী ও গণহত্যার যে কোনো অভিযোগের বিচার করতে পারে। যদি (এক) ঐ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের কোনো দলের ব্যক্তি হয়ে থাকেন, (দুই) যদি সংশ্লিষ্ট দেশে ঐ অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে, (তিন) বিষয়টি যদি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়ে থাকে, (চার) আর যদি সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় আদালত ঐ বিষয়ে তদন্ত ও বিচার করতে অনীহা ও অপারগতা প্রকাশ করে।
সাপ্তাহিক হলিডের তথ্য অনুযায়ী জাতিসংঘে যারা আবেদন করেছে তারা ৬ মে (২০১৩) ভোরে হেফাজতের উপর যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, বিশ্বব্যাপী তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে বলে উল্লেখ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাতিসংঘ সনদের সাত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালের ৮ নভেম্বর জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য একটি আন্তর্জাতিক আদালত গঠন করে। যদিও সেখানে গণহত্যার বহু প্রমাণ রয়েছে, তবু সরকার বলেছে যে সেখানে এমন ধরনের কোনো ঘটনা ৬ মে ভোর রাতে ঘটেইনি।
যারা জাতিসংঘে আবেদন করেছেন তারা তাদের সকল তথ্য-উপাত্ত, যুক্তি উপস্থাপন করেছেন এবং আশা করছেন যে, বাংলাদেশে এই গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হবে। ৬ মে ভোর রাতে শাপলা চত্বরে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে তা শত শত স্থির চিত্র ও ভিডিও এখন সর্বত্র প্রচারিত। এটি লুকোনোর জায়গা নেই। সামনের দিনগুলোর অবস্থা কী দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার পালা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন