আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার শেষ বছর পার করছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ বছরের শেষ দিকে। এই নির্বাচন নিয়ে পাড়ায়-মহল্লায়, দোকানে-অফিসে, খেলার মাঠে ও ড্রয়িংরুমসহ বিভিন্ন স্থানে আড্ডা জমে উঠছে। কী হতে যাচ্ছে সামনের নির্বাচনে? কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবেÑ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নাকি ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে? নাকি আসছে সর্বদলীয় জাতীয় পরিষদ? নানা ভাবনা দানা বেঁধে উঠেছে। কোন আসনে কে কে প্রার্থী হচ্ছেন সে হিসাবও আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে। দুই-একটি দল ইতোমধ্যেই তাদের প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নেতাদের কেউ কেউ বিভিন্ন সভায় ও আলোচনায় নিজেদের দলের ও জোটের পক্ষে ভোটও প্রার্থনা করছেন। আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য নির্বাচনী প্রচারণা আরম্ভ না হলেও নির্বাচনী হাওয়া যে কিছুটা বইছে, তা টের পাওয়া যায় পথে-প্রান্তরে, বাড়ির ছাদে ও কফি হাউজে। আমলা-শিক্ষকসহ সব পেশাজীবী; শিক্ষার্থী-দোকানদার-রিকশাওয়ালা-শ্রমিক; সবার ভাবনায় কোনো না কোনোভাবে জায়গা করে নিয়েছে আসন্ন সংসদ নির্বাচন।
নির্বাচন-ভাবনাকে ঘিরে শুরু হয়েছে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ এবং ভাগাভাগি-টানাটানি প্রক্রিয়া ও কৌশল। বড় দলগুলো নিজেদের জোট ঠিক রাখতে কিংবা সম্প্রসারণ করতে ব্যস্ত। ছোট দলগুলো হিসাব কষছেÑ কোন জোটে ভিড়লে ‘লাভ’ হবে বেশি। বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনকালীন বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী নিয়োগের লিখিত দাবি জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর আবেদন-আপত্তি বিবেচনা করে দেখছে। কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকার সীমানা আর পুনর্নির্ধারণের কাজও এগিয়ে চলেছে। অবশ্য সংসদীয় আসনের এই সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৌশলে কোনো বিশেষ দলকে সুবিধা দেয়ার অভিযোগও উঠেছে। যা হোক, সব মিলিয়ে সারা দেশে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী প্রচ্ছন্ন হাওয়া। তবে আমাদের মনে হয়েছে, ভোট আর জোটের মারপ্যাঁচে বরাবরের মতো এবারো আলোচনা-বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে সাধারণ নাগরিক বা ভোটারের অভিমত ও ভাবনা। যাদের ঘিরে এত আয়োজন ও তোড়জোড়, মোড়ে ও মঞ্চে যাদের ম্যান্ডেটের দোহাই দিয়ে এত বক্তৃতাÑ সেই ‘জনগণ’ নির্বাচনী ভাবনা থেকে খানিকটা দূরেই রয়েছে। ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ভোটের সময় তারা তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেÑ শুধু এটাই তাদের একমাত্র ‘পবিত্র’ দায়িত্ব! কিছু এনজিও এবং নির্বাচন-পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান অবশ্য মাঝে-মধ্যে জনতার কথা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরার সামান্য প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মাঝে মধ্যে ‘সংলাপ’ ও ‘জরিপ’ যথেষ্ট নয় মোটেও।
জনগণ যাকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করবে, তার যোগ্যতা কী হবে, অন্তত দেশের বেশির ভাগ লোক কী ভাবছেÑ সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। সাম্প্রতিককালে লক্ষ করা গেছে, টাকার জোর বা পেশিশক্তি সাধারণ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেছে। অনেক ক্ষেত্রে ভোটাররা প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতাকে বিবেচনায় না নিয়ে ‘ভয়ে’ কিংবা ‘টাকার বিনিময়ে’ ভোট প্রয়োগ করেছে। গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। ভোটার যেন নিজের পছন্দ ও ইচ্ছেমতো ‘নির্ভয়ে’ ও ‘নিরাপদে’ তার মতামত প্রকাশ করতে পারে, সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ‘যোগ্য’ প্রার্থী না থাকলে ‘না’ ভোট প্রয়োগের সুযোগ রাখতে হবে বলে অনেকেই মনে করেন। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও অপরাধমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সৎ-শিক্ষিত-নির্ভীক-দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা বা প্রতিনিধি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। জনগণের ভোট নিয়ে পরবর্তী-সময়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া নেতার সংখ্যা এ দেশে কম নয়। লোভ আর লাভের রাজনীতির ফলে দিনে দিনে এক অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ কী ধরনের নেতৃত্ব চায়, সে বিষয়ে এখন থেকেই আঞ্চলিক পর্যায়ে জনমত জরিপ, সংলাপ, মুক্ত আলোচনা প্রভৃতির আয়োজন করতে পারে নির্বাচন কমিশন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলও সব নির্বাচনী এলাকায় ভোটারের মতামত গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারে। আর এখনই এসব করার মোক্ষম সময়। আমরা মনে করি, ভোটগ্রহণের আগে কারা ভোট দেবেন, কাকে ভোট দেবেনÑ সেসব বিষয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকার এবং রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা দরকার। আর জনমত জরিপের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে জানিয়ে দিতে পারেÑ প্রার্থীর যোগ্যতা কেমন হবে। নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ, ভোটের গুরুত্ব, ‘না’ ভোটের প্রাসঙ্গিকতা এবং ভোট প্রদান-পদ্ধতি বিষয়ে গ্রামে ও মহল্লায় আয়োজন করা হতে পারে কর্মশালা। পত্রিকা-রেডিও-টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমেও জনগণকে নির্বাচন বিষয়ে সচেতন করে তোলা সম্ভব। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এসব করা হতে পারে। মোট কথা, জনগণকে সচেতন করে তুলতে হলে, নির্বাচনকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে সুদূরপ্রসারী ও বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কিছু পত্র-পত্রিকা টেলিফোনে নাগরিক মন্তব্য এবং টিভি সরাসরি পাবলিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান-কর্মকর্তা-নেতৃবৃন্দ সেখান থেকে কিছু পাঠ নিতে পারেন। জাতীয় সংসদ, সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন-পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান, সমাজ-উন্নয়নমূলক সংগঠন নিজ নিজ অবস্থান থেকে কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আরো আন্তরিক হবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।
‘ওএসডি’ নামক অদ্ভুত এক প্রথা স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতিকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। দলীয় সরকার বা সরকারি দল পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু কর্মকর্তাকে পরিকল্পিতভাবে ‘বিশেষ ভারপ্রাপ্ত’ বলে ‘ভারমুক্ত’ রাখা হয়। অর্থাৎ অফিসে তার কোনো কাজ থাকে না। কিংবা এমন দায়িত্ব দেয়া হয় বা এমন স্থানে বদলি করা হয়, যেন তিনি কোনো কাজ করার সুযোগ না পান। এই প্রক্রিয়ায় ভিন্ন মতের অথবা ভিন্ন চিন্তাধারার কর্মজীবীকে দলিত করা হয়ে থাকে। তবে, এর ফলে কোনো বিশেষ দল বা জোট কিছুটা উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, সরকার ও জাতি। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করলেও তারা বিনিময়ে কিছুই দিতে পারেন না। অন্য দিকে ‘বিশেষ সরকারের মেয়াদে’ (পাঁচ বছরকাল) কর্মহীন থাকায় তাদের মেধা, প্রতিভা-যোগ্যতা এবং কর্মস্পৃহা বিনষ্ট হয়ে পড়ে। এই অবস্থার পরিবর্তনে এবং রাষ্ট্রের সব মানুষকে কাজে লাগিয়ে অগ্রগতির সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করতে হবে দলগুলোকে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র বিশেষ কোনো দলের বা জোটের নয়। এসব বিষয়ে মিডিয়াকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। দলবাজি না করে বরং জনগণের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি এবং দেশের সার্বিক অগ্রগতি-পশ্চাৎগতির বিষয়ে বক্তব্য প্রকাশ করতে হবে।
সাম্প্রতিককালে লক্ষ করা গেছে, সাবেক আমলা ও সেনা-কর্মকর্তারা রাজনীতিতে প্রবেশ করছেন। রাষ্ট্র যাদের অবসর-যাপনে পাঠিয়েছে, রাজনৈতিক প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে, পরবর্তীকালে তারা হয়ে পড়েন জাতীয় নীতিনির্ধারক! এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিশেষ বিবেচনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা দল বা সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে অবশ্যই কাজ করতে পারেন। কিন্তু তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে সার্বক্ষণিক হিসেবে নিয়োগ করলে, সে কাজটি যথাযথ হবে কি না, তা ভেবে দেখতে হবে। এ ছাড়া ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং পেশাজীবীরা যেন প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকেন, তাও নিশ্চিত করতে হবে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনকে। কেননা, ব্যবসায়ীরা রাজনীতি করলে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র ও বাণিজ্য-পরিসরের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। আর পেশাজীবীরা রাজনীতি করলে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা থেকে অনেকটাই হয় বঞ্চিত। রাজনীতিবিদদের বয়সসীমা নির্ধারণ করার বিষয়টিও বিবেচনা করা যেতে পারে। কেননা, বয়সের ভারে ন্যুব্জ ব্যক্তির পক্ষে অনেক সময় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ কারা রাজনীতি করবেন, কী যোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা থাকলে জাতীয় সংসদের সদস্য ও মন্ত্রী হওয়া যাবে, সেসব বিষয়ে স্পষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে। জনগণের কাছে তাদের সম্ভাব্য প্রতিনিধি সম্বন্ধে সব তথ্য প্রকাশ ও উপস্থাপনের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। অস্পষ্টতা ও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে নির্বাচন কিংবা সরকার গঠন যা-ই হোক না কেন, তাতে কেবল রাজনৈতিক জটিলতাই বাড়বেÑ জনতার কল্যাণ করার স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। আমরা বিশ্বাস করি, রাজনীতিকে পেশারূপে গ্রহণ না করে জনসেবা হিসেবে আত্মস্থ করতে আগ্রহী হতে পারলে দেশ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের পথ প্রসারিত হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন