বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও
সামাজিক জীবনে শুরু থেকেই অব্যাহত সঙ্কটের মূলে দু’টি বড় কারণ আছে। যার জন্য কোনো স্থিতিশীলতা ও শান্তি আসছে না দেশে।
সঙ্ঘাত ও অস্থিরতায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন। বাংলাদেশের জন্ম থেকেই আছে
কারণ দু’টি। এ দু’টিরই কেন্দ্রে রয়েছে আওয়ামী লীগ।
প্রথমত, আওয়ামী লীগ ভাবে বাংলাদেশের মালিক একমাত্র তারাই। তারাই দেশ স্বাধীন
করেছে। অতএব দেশটাও কেবল তাদেরই। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের পর এই মনোভাব নিয়েই ভারত
থেকে তারা দেশে ফেরে। এটা তাদের চেতনার একেবারে গভীরতম জায়গায় ভয়ানক শক্ত হয়ে
গেড়ে বসে আছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। তাদের
হাবভাবে, প্রতিটি কথায় ও কাজে সব সময় এই মনোভাবই প্রকাশ পায়। অনেক সময়
কোনো রাখঢাক না করে প্রকাশ্যেই তারা তা জানিয়ে দেয়ও। তারা চায় দেশের সবাই তাদের
মালিকানা মেনে নিক। তাদের এই অনড় অবস্থান থেকে একবিন্দুও এদিক-ওদিক হবে না বলে
ঠিক করে নিয়েছে তারা। এমন মনোভাব যে ন্যায্য নয় বা এ থেকে রাষ্ট্র ও সমাজে
যেকোনো মারাত্মক সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে এটাও আওয়ামী লীগ আমলে দিতে নারাজ।
তাদের মালিকানার এই মনোবৃত্তির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ একবার ঘটেছিল ১৯৭৫
সালের প্রথম দিকে তাদের বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে ছিটকে
পড়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে দু’টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমে তারা করেছে শরিক হিসেবে ঘরের মধ্যে
ঢুকে নিজেদের বসার মতো একটা জায়গা করে নেয়ার রাজনীতি। সেটা হয়ে যাওয়ার পর তারা
শুরু করে তাদের আসল রাজনীতি। এখন তাদের চলছে অন্য শরিকদের উচ্ছেদ করে মনের বাসনা
অনুযায়ী স্থায়ীভাবে একক মালিক হয়ে যাওয়ার রাজনীতি। এ জন্য তারা শাসনতন্ত্র
সংশোধন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেয়া থেকে হামলা-মামলা, ভয়ভীতি দেখান, শাহবাগ স্কোয়ার
মঞ্চ, একে নিষিদ্ধ করা, তাকে নিষিদ্ধ করা পর্যন্ত যত রকম কলাকৌশল অবলম্বন করা যায় করে
যাচ্ছে।
সমস্যা বেধেছে যে, দেশের সব মানুষই নিজেদের জন্মভূমির ওপর আওয়ামী লীগের বা কোনো একটি
রজানৈতিক দলের এ ধরনের একক মালিকানা মেনে নিতে কখনো রাজি নয়। আওয়ামী লীগ অনেক
চেষ্টা করেছে মানুষকে তা মেনে নিতে বাধ্য হতে। কিন্তু পেরে ওঠেনি। তবু তারা হাল
ছাড়তে রাজি নয়। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সঙ্ঘাত সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র ও সমাজে।
দেশ এখন হয়ে উঠেছে একটা বারুদের স্তূপ। যেকোনো সময় একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে
গিয়ে দেশটা একেবারে ছারখার হয়ে যেতে পারে তাতে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে মোটেই ভীত
বা উদ্বিগ্ন মনে হয় না সে জন্য। তাদের ধারণা যেকোনো সঙ্ঘাতে তারাই জিতবে। অতএব
সঙ্ঘাত বাধলে তাদেরই লাভ। মালিকানা নিরঙ্কুশ করা যাবে তাতে।
দ্বিতীয় যে জিনিসটি আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করেছে তা হচ্ছে, পরিচ্ছন্ন
রাজনীতির কোনো সুযোগই সৃষ্টি হতে পারেনি বাংলাদেশে। দেশটির যাত্রার শুরতেই সে
সম্ভাবনা নষ্ট করে দেয়া হয়। যেকোনো দেশের রাজনীতির মাঠকে একটা খেলার মাঠের সাথে
তুলনা করা যেতে পারে। পরিচ্ছন্নভাবে যাতে খেলা চলতে পারে সে জন্য খেলার মাঠে কিছু
সুষ্ঠু নিয়মকানুন লাগে। নিয়মকানুনের মধ্যে সুযুক্তি ও সুবিবেচনা থাকতে হয়।
সবাইকে সেসব নিয়মকানুন মানতে হয়। তা না হলে খেলা আর খেলা থাকতে পারে না, খেলাটা হয় কেবল
ফাউলেরই খেলা।
বাংলাদেশের জন্য একটা অপূর্ব সুযোগ এসেছিল রাজনীতির মাঠকে একেবারে
ঢেলে নতুন করে সুন্দর করে সাজানো যাতে সবাই ঠিকমতো দেশের রাজনীতির এই মাঠে খেলতে
পারে। সুযোগটা সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশের জন্মের সাথে সাথেই। এ অতি গুরুত্বপূর্ণ
কাজটা করার দায়িত্বটা ছিল আওয়ামী লীগেরই। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে দায়িত্ব ঠিকমতো
পালন তো করেইনি, উপরন্তু তারা খেলার মাঠের অবস্থা এমন করে ফেলে যে, সেখানে ফাউল না
করে খেলার আর কোনো উপায় থাকে না। আওয়ামী লীগ যে বাংলাদেশের রাজনীতির খেলার মাঠকে
একটা পরিচ্ছন্ন রূপ দেয়নি তখন তার মূলেও কাজ করেছে নিজেদের এ দেশের একমাত্র মালিক
গণ্য করার মনোভাব।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ফাউল করে খেলার সেই ধারাবাহিকতাই এখনো চলছে।
আওয়ামী লীগ এখন খেলার মাঠের মালিক, একমাত্র স্বাধীন খেলোয়াড়, তারা তাদের যেমন
ইচ্ছা খেলবে, কোনো নিয়মকানুন তাদের মানতে হবে না, তারাই বলে দেবে অন্যেরা কে
কিভাবে খেলবে এবং খেলতে চাইলে তাদেরও সেভাবে খেলতে হবে। আর আওয়ামী লীগই হবে এ
মাঠের প্রধান খেলোয়াড়, নিয়ন্ত্রক এবং একই সাথে একমাত্র আম্পায়ারও। বন্দী দর্শকদের যেমনই
লাগুক না কেন বসে বসে কেবল হাততালি দিয়ে যেতে হবে।
কিছু দিন আগে একজন প্রবীণ কলাম লেখক আক্ষেপ করে লিখেছেন যে, তারা যখন ছাত্র ছিলেন তখনো
ছাত্ররাজনীতি ছিল, কিন্তু এখনকার মতো ভিন্নমতের জন্য একজন আরেক জনকে খুন করে ফেলতে চাইত
না। তার কারণ তখন যে কেউ অন্য শরিকদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে একাই নিজেকে
বাড়ির মালিক হয়ে যেতে চাইত না। সমস্যাটা তো হয়েছে এখানেই।
শরিকরাই বা এখন কী করবে? বারবার ঘুরে ফিরে কেউ যদি
অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেকেই একক মালিক বলে দাবি করে তাকে কী করে আর বিশ্বাস করা
যায় এবং ভয় না করে পারা যায়? তাকে ঠেকাতে না পারলে তো এসব শরিকের একেবারে বাস্তুহারা হয়ে পড়তে
হয়। আরেকটি কারণে তাদের আরো ভয়। সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হলে তার ঠাই মিলতে
পারে রাস্তায়, গাছতলায় বা পার্কের বেঞ্চে। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এসব
শরিকেরা বাস্তুচ্যুত হলে তাদের কি ঠাই মিলবে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের কোথাও? কারণ রাস্তা, গাছতলা বা পার্ক
সব কিছুরই যে মালিক ভাবে আওয়ামী লীগ নিজেকে। কবরেরও তো জায়গা মিলবে না তাদের
জন্য। ১৯৭৫ সালের বাকশালের মর্ম তো ছিল এটাই। বাকশাল মানেই তো প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক
নেতা ও কর্মীদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া এবং দেশজুড়ে তাদের অগণিত সমর্থকদের
আওয়ামী খাঁচায় বন্দী হয়ে পড়া। চরম বিপর্যয়কর সেই বাকশালের ফিরে আসার পদধ্বনিই
তো শোনা গেছে অবিরত চার বছর ধরে। আওয়াজ তার ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে হতে
এখন তো তা একেবারে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ার উপক্রম। যারা নিশ্চিহ্ন বা বন্দী হয়ে
পড়ার ভয়ে ভীত তাদের পিঠ তো আজ একেবারে দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন হয় তাদের আওয়ামী
লীগের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে অথবা আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার শেষ চেষ্টা করা
দেখতে হবে। সংক্ষেপে আজ এই তো হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক
পরিস্থিতি।
এ অবস্থায় দেশের যে দশা হওয়ার কথা তাই হয়েছে। দেশ থেকে শান্তি, সদ্ভ¢াব ও সদাচার একেবারে নির্বাসিত
হয়েছে। দেশটা একটা ভয়ঙ্কর অন্ধকার, দুর্গন্ধময় কাঁটাবনের গোলকধাঁধার
মতো হয়ে গেছে। এর মধ্যে হারিয়ে গিয়ে বেরিয়ে আসার কোনো পথ যেন আমরা কেউ আর
খুঁজে পাচ্ছি না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন