মানবসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে এখন আমাদের বসবাস। বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট মানুষদের মধ্যে যারা যত ক্ষমতাবান দুর্যোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাদের অবদান তত বেশি। এখন ক্ষমতাবানদের শঠতা-প্রতারণা, জুলুম-নির্যাতন, শোষণ-নিপীড়নের কারণে এক অমানবিক পরিবেশে আমাদের আয়ু ক্ষয় হচ্ছে। সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য আমরা সমাজবদ্ধ হয়েছিলাম, রাষ্ট্র নির্মাণ করেছিলাম। আজ কেন আমাদের এমন দশা হলো? এর নাম কি বেঁচে থাকা? পশু-পাখিওতো বেঁচে থাকে, কিন্তু পশু-পাখি ও মানুষের বেঁচে থাকা কি একই রকম বিষয়?
সংবাদপত্রের কলামে বেশি দার্শনিকতার সুযোগ থাকে না, সরাসরি প্রসঙ্গে আসতে হয়, যদিও দার্শনিক ভাবনা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণকে প্রভাবিত করে থাকে। আমাদের দেশে এখন যেন ভাল জিনিসের দুর্ভিক্ষ চলছে। শুধু নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেই যে একথা সত্য তা নয়, শিল্প-বাণিজ্য, রাজনীতি সবক্ষেত্রেই খারাপ খবরের ঢল। রানা প্লাজায় যে মর্মান্তিক ঘটনা লক্ষ্য করা গেলো তা শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিষাদসিন্ধু নয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে আমাদের রাজনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার কুৎসিত চিত্র। গত কিছুদিন ধরেই পত্রপত্রিকায় রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি প্রসঙ্গে আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, আইন-কানুন, নির্মাণ বিধি, শাসন-প্রশাসন ও রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন ধারায় ও মাত্রায় আলোচনা-সমালোচনার চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। এসব আলোচনা-সমালোচনায় সরকারের ব্যর্থতার চিত্র যেমন লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি লক্ষ্য করা গেছে বিরোধীদলের গঠনমূলক তৎপরতার দৈন্যও। আসলে যেসব উপাদানের গুণে মানুষ মানুষ হয়, সমাজ সমাজ হয় তার অভাব এখন প্রকট। ব্লেমগেমের মাধ্যমে এই অভাব দূর হবার নয়। রানা প্লাজার ট্র্যাজেডি যে বিষয়টি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে তা হলো, আমাদের আবার শুরু থেকে শুরু করতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবার এ ক্ষেত্রে করণীয় আছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে যেসব উপাদান সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন তা অর্জনের কর্মযজ্ঞে আমাদের এখন নিয়োজিত হতে হবে।
রানা প্লাজার মর্মান্তিক ঘটনার জের না কাটতেই হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ও শাপলা চত্বরের ৫ই মের সমাবেশকে কেন্দ্র করে রচিত হলো আরেক বিষাদসিন্ধু। বহু মানুষ সেদিন আহত-নিহত হয়েছে। ভাঙচুর ও অগ্নিকা-ের ঘটনাও ঘটেছে সেদিন। ভাঙচুর ও অগ্নিকা-ের ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, কিভাবে ঘটিয়েছে সে ব্যাপারে রয়েছে নানা বক্তব্য। হেফাজতের শাপলা চত্বরের সেদিনের সমাবেশে লাখ লাখ মানুষের শান্তিপূর্ণ অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু সমাবেশের প্রান্তসীমায় দুপুর থেকেই সহিংস ঘটনা দেখা গেছে। টেলিভিশনের দর্শকরা সেদিন দেখেছেন দুপুর থেকেই হেফাজতের মঞ্চ থেকে বার বার সহিংস আক্রমণ বন্ধ করার ব্যাপারে পুলিশের প্রতি আকুল আহ্বান জানানো হচ্ছিল। পাশাপাশি হেফাজত কর্মীদের ধৈর্যের সাথে সমাবেশে বসে থাকার নির্দেশ দেয়া হচ্ছিল। অবাক ব্যাপার হলো, দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত সমাবেশের প্রান্তসীমায় আক্রমণের ও প্রতিরোধের ঘটনা বন্ধ হয়নি। আমাদের সরকার ও পুলিশ প্রশাসন কি এতটাই দুর্বল যে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেলেও একটি অনুমোদিত সমাবেশকে তারা নিরাপত্তা দিতে সমর্থ নন? উপরন্তু একপর্যায়ে লক্ষ্য করা গেলো হেফাজত কর্মীদের উপর সরকারি দলের ক্যাডার এবং পুলিশ ও র্যাবের যৌথ হামলা চালাতে। আগ্নেয়াস্ত্রের মোকাবিলায় তো হেফাজত কর্মীদের লাঠি ও পাথর তেমন কার্যকর নয়। অতএব লুটিয়ে পড়লো হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। রক্তে রঞ্জিত হলো রাজধানীর রাজপথ। সহিংস এমন পরিবেশে বায়তুল মোকাররমের আশপাশে ভাঙচুর ও অগ্নিকা-ের ঘটনা লক্ষ্য করা গেলো। ধ্বংসাত্মক এমন ঘটনার বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। হেফাজত বিরোধীরা বলছেন, হেফাজতের এ কেমন কর্মকা-? আর হেফাজতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমাদের সমাবেশ আমরা হিংসাত্মক কর্মকা-ের মাধ্যমে প- করতে যাব কেন? পুলিশের সহযোগিতায় ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকারি দলের ক্যাডাররা আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমাদের ইমেজ ক্ষুণœ করার জন্য তারাই সমাবেশ স্থলের আশপাশে ভাঙচুর ও অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটিয়েছে। বিরোধপূর্ণ এসব বক্তব্য হয়তো আরো কিছুদিন চলবে। এরই মাঝে প্রকৃত সত্যও হয়তো উদ্ভাসিত হবে। ৫ই মে তারিখেও বিভিন্ন প্রহরে সময় এগিয়ে গেছে। একসময় রাত গভীর হয়েছে। গভীর রাতে শাপলা চত্বরে অবস্থানকারী হেফাজতের নেতা-কর্মীদের উপর চালানো হলো ‘অপারেশন মিডনাইট’। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি আর সরকারদলীয় ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলার মুখে মতিঝিল এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা। সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, যৌথ বাহিনীর গুলী, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট হামলায় হেফাজতের তিন হাজার নেতা-কর্মী শাহাদাতবরণ করেছেন। এ সময় ১০ সহ¯্রাধিক ব্যক্তি আহত ও অসংখ্য নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। এই অপারেশন মিডনাইটকে বিরোধীদল, পর্যবেক্ষক মহল, সুধী সমাজ ও বিভিন্ন সংগঠন গণহত্যা অভিযান বলে অভিহিত করে। এই অভিযানে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। সরকারিভাবে এখনও কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। তবে যৌথ অভিযানের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা দেশ। ভাবতে অবাক লাগে, হেফাজতে ইসলামের মত একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের ১৩ দফা দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে সক্ষম হলো না সরকার। মীমাংসার পরিবর্তে ব্যবহ্রা করা হলো সাঁজোয়া যান ও যৌথ বাহিনী। সরকারের এমন আচরণের কারণে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা কি বার্তা বহন করে নিয়ে গেলো সারাদেশের মানচিত্রে? এই বার্তা কি আমাদের সরকারের জন্য মঙ্গলজনক বলে বিবেচিত হবে? মিডনাইট অপারেশন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিদের কাছে বেশ চেনা- চেনা বলেই মনে হচ্ছে। জোর-জবরদস্তিমূলক এমন আপাত জয় আসলে পরাজয়কেই ডেকে আনে। ইতিহাস এমন সাক্ষ্যই দেয়।
হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে একটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় এখন ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বিষয়টি হলো পবিত্র কুরআন পোড়ানোর চিত্র। মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি ঘরানার রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী সবাই এখন পবিত্র কুরআনের পুড়ে যাওয়া পৃষ্ঠা হাতে ধরে বলছেন, হেফাজতের এ কেমন ইসলাম? যারা অবলীলায় পবিত্র কুরআন পুড়িয়ে দেয় তাদের মুখে তো ইসলামের বক্তব্য শোভা পায় না। বরং কুরআন অবমাননার কারণে গ্রেফতার করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। তবে ঘটনার যারা পর্যবেক্ষক তারা মুচকি হেসে বলছেন, রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহারের এটা এক চাতুর্যপূর্ণ দৃশ্য। তারা প্রশ্ন রেখেছেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যেই তো ঐ দিনের সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। ঐ ১৩ দফার মধ্যে কি পবিত্র কুরআনের অবমাননা বা পুড়িয়ে ফেলার মতো কোনো কর্মসূচি ছিল? নাকি পবিত্র কুরআন এবং আল্লাহ ও রাসূলের মর্যাদা সমুন্নত রাখার প্রস্তাব ছিল? এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ ওলামায়েকেরাম প্রশ্ন রেখেছেন, ইনকিলাবসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্তৃক কুরআন পুড়িয়ে দেয়ার ছবি প্রকাশিত হওয়ার পরও তাদের গ্রেফতার করা হলো না কেন? অগ্নিকা-ে কুরআন পুড়ে যাওয়ার ঘটনাকে নিয়ে হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা চলছে তাতে বিরক্ত হয়ে বাম ধারায় বিশ্বাসী এক সম্পাদকও সেদিন টিভি টকশোতে বললেন, নগরীতে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না। আসলে আগুনের ধর্ম জ্বালানো। হেফাজতের কোনো কর্মী ইচ্ছাকৃতভাবে পবিত্র কুরআনে আগুন লাগিয়েছে, এ কথা কোনো নাস্তিকও বিশ্বাস করবে না। কারণ পবিত্র কুরআনের মর্যাদা সমুন্নত রাখাই হেফাজতের তৎপরতার মূল বিষয়। আসলে অতি-কথা, অতি-অভিনয় কখনো মানুষ পছন্দ করে না। পবিত্র কুরআনে আগুন লাগার ঘটনায় সরকারি ঘরানার লোকজন যেভাবে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন তাতে এখন জনমনে নতুন একটি প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ও সরকারি দলের লোকজনের পবিত্র কুরআনের প্রতি যখন এতই দরদ, তখন তারা দেশে কুরআনের শাসন প্রবর্তন করছেন না কেন? পবিত্র কুরআন যেভাবে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজ পরিচালনা করতে বলেছে, সরকারি ঘরানার রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সংস্কৃতিসেবীরা কি বিগত দিনগুলোতে সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন? নাকি যারা কুরআন কেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছেন তাদের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন তারা। তাই কুরআন পোড়ানোর ঘটনায় যেভাবে হেফাজতবিরোধী মহল মায়াকান্না শুরু করেছেন, তাতে তাদের ব্যাপারে জনমনে বরং বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, পবিত্র কুরআনকে আমরা অবশ্যই সম্মান করবো, ভালবাসবো, তবে পবিত্র কুরআন শুধু ভালবেসে চুমু খাওয়ার বিষয় নয়। পবিত্র কুরআন মহানবী (সাঃ)-এর মাধ্যমে এই পৃথিবীতে নাযিল হয়েছে মানব জীবনে ও সমাজে বাস্তবায়নের জন্য। মহানবী (সাঃ) জীবনে ও সমাজে তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন। আমাদেরও মহানবী (সাঃ)-এর দেখানো পথেই পবিত্র কুরআনকে ভালবাসতে হবে। এর পরিবর্তে পবিত্র কুরআনকে ভালবাসার নামে চাতুর্য কিংবা মোনাফেকির পথ অবলম্বন করলে তা সংশ্লিষ্ট কারো জন্যই ভালো হবে না। বরং তাতে ক্ষতির মাত্রাই বৃদ্ধি পাবে। বিষয়টি উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন