ছোটবেলা পাঠ্য বইয়ে পড়েছি : ‘আপনারে বড়ো বলে বড়ো সেই নয়/লোকে যারে বড়ো বলে বড়ো সেই হয়’। শুনেছি আজকাল শিশুদের যা
পড়ানো হয় অনেক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘রাবিশ’ তাতে ঢুকে গেছে। জাতির প্রকৃত
ইতিহাস তারা যাতে জানতে না পারে তার সব ধরনের চেষ্টা করছে সরকার ও শাসক দল।
জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেনÑ এ দিব্যসত্যটি
নতুন প্রজন্মকে জানতে দিতে সরকার ও শাসক দলের যেন মাথা কাটা যায়। সম্প্রতি দেখলাম
নিজের লেখা একটা বই নিয়ে সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল আবদুল করিম
খন্দকার সরকারের মধ্যেই বিপদে পড়েছেন।
তার বইখানি পড়ার সুযোগ আমার হয়নি, কিন্তু সে বইয়ে তিনি নাকি
লিখেছেন যে, স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। এয়ার ভাইস
মার্শাল খন্দকার মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তার তখনকার অবদানের কথা সবাই
এতকাল স্বীকার করে এসেছেন। সুতরাং স্বাধীনতার ঘোষণার মতো মৌল বিষয়টা তার জানা
থাকার কথা। অন্তত এ কথা তো বলা যায়, স্বাধীনতার যুদ্ধে মন্ত্রিসভার
অন্য কোনো সদস্য অত কাছে ছিলেন না, তাদের কারো অবদান এ কে
খন্দকারের সাথে তুলনীয় নয়। কিন্তু সঠিক তথ্যটি প্রকাশের কারণে তিনি নাকি
মন্ত্রিসভার রোষের মুখে পড়েছেন।
আমাদের অন্য একজন জাতীয় বীরও বর্তমান সরকারের গ্রহণের অযোগ্য হয়ে
পড়েছেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ব্রিটিশ আমলের আসামে কৃষক-জনতার
স্বার্থরক্ষার আন্দোলন করতেন। ব্রিটিশরা আসন্ন স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা
নির্ধারণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী লর্ড র্যাডকিফকে। র্যাডকিফ রায়
দিয়েছিলেন যে তৎকালীন আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেট জেলাটির ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে
গণভোটে। মওলানা ভাসানী সিলেটকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত করার জন্য অকান্ত
প্রচারাভিযান চালান। তার নেতৃত্বে যেসব কর্মী আন্দোলন করেছিলেন তাদের একজন ছিলেন
শেখ মুজিবুর রহমান।
আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগেরই স্বত্বাধিকারী। ১৯৪৯
সালের পলাশী দিবসে (২৩ জুন) লাইব্রেরির মালিক ও ঢাকার মেয়র কাজী মোহাম্মদ বশীরের
বাগানবাড়ি রোজ গার্ডেনে এক সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পরে রাজনীতির মত ও পথ
নিয়ে তাদের মতান্তর ঘটলেও ব্যক্তিগতভাবে ভাসানী ও মুজিবের সম্পর্ক খুবই আন্তরিক
ছিল। ভাসানী শেখ মুজিবুর রহমানকে পুত্রের মতোই স্নেহ করতেন। ১৯৬৯ সালে পোড়াবাড়ীর
কাছের বিন্নাফৈর গ্রামে আমি মওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। তার এক
কামরার ঘরে একটা মাত্র ফটো ছিল শেখ মুজিবের কাঁধে হাত রাখা অবস্থায় মওলানা
ভাসানীর।
এতগুলো ভূমিকা দিতে হলো একটামাত্র উদ্দেশ্যে। বলতে চাচ্ছিলাম প্রকৃত
পরিস্থিতি এবং প্রকৃত ইতিহাসকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান সরকার ও
বর্তমান আওয়ামী লীগের এত ভয়ের কারণটা আমি বুঝতে পারি না। ব্যক্তির বেলায় বলা
হয় নিজের কাজের ভুলকে স্বীকার করে এবং সে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই মানুষ বড় হতে
পারে। কথাটা জাতির বেলাতেও অবশ্যই প্রযোজ্য হবে।
গত ২৪ এপ্রিল বুধবার সাভার রানা প্লাজা নামের আটতলা ভবনটি ধসে পড়ে।
ভবনের নিচের কয়েকটা ফোর একেবারে মাটির তলায় তলিয়ে গেছে। এ ভবনে দোকানপাট
ইত্যাদি ছাড়াও পাঁচটি গার্মেন্ট কারখানা ছিল। সবমিলিয়ে ধারণা করা হয় যে কয়েক হাজার
মানুষ ধসে পড়ার সময়ে রানা প্লাজায় ছিল। স্থানীয় জনসাধারণ, উদ্যোগী কিছু
তরুণ, হেফাজতে ইসলামের লোকজন এবং মাদরাসার ছাত্ররাই প্রথম কয়েক ঘণ্টা
উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কোনো রকম সংগঠন ও যন্ত্রপাতি চাড়াই তারা ধ্বংসস্তূপে
আটক বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন। এরপর সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজে অংশ নেয়। ক্ষিপ্রতার
সাথে এগিয়ে আসে ফায়ার ফাইটার দল ও অন্যরা।
দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে
সাধারণ স্বেচ্ছাসেবী মানুষ উদ্ধারকাজে পারদর্শী হবেন বলে আশা করা
যায় না। তা ছাড়া সেজন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি। সব উন্নত দেশেই
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকারীদের সংগঠন থাকে। উদ্ধারকাজের কৌশল, যন্ত্রপাতি এবং
একই সাথে ত্রাণের কাজের সামগ্রী ও পারদর্শিতা তাদের থাকে। ব্রিটিশ সরকার এবং
জাতিসঙ্ঘ সাভারে উদ্ধারকারী দল পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। তারা যথাসময়ে এসে
পড়লে নিশ্চয়ই আরো বহু প্রাণ রক্ষা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সে প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। তারা নাকি বলেছিলেন যে, বিদেশী সহায়তা
নেয়া হলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ুণœ হবে।
আমার সাংবাদিক জীবনে বহু দেশে বহু প্রলয় ও বিপর্যয়ের খবর দেখেছি।
প্রায় সময়ই সেসব ক্ষেত্রে উদ্ধার ও ত্রাণকার্যে বিভিন্ন দেশ শরিক হয়েছে।
তাতে কোনো দেশের ভাবমূর্তি ুণœ হয়েছে বলে
অভিযোগ কখনো শুনিনি। বরঞ্চ যারা নিজেরা উদ্ধারকাজে আনাড়িপনা ও ব্যর্থতার পরিচয়
দিয়েছে কিন্তু বিদেশী সাহায্য চায়নি দুর্নাম তাদেরই হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, যে মানুষগুলোকে
বাঁচানো যেত কিন্তু সরকারের আত্মাভিমান ও দম্ভের কারণে বাঁচানো যায়নি, তাদের অপমৃত্যুর
জন্য সব দায়িত্ব সে সরকারকেই নিতে হবে।
রানা প্লাজা ধসের ঠিক এক সপ্তাহ পরে বুধবার (১ মে) প্রধানমন্ত্রী
দুটো উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সাভারের ভবনধসে উদ্ধারকাজ
ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।’ প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্ত
শ্রমিকদের পুনর্বাসনে সরকার সবকিছুই করবে। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে সরকার কি এই ট্র্যাজেডির
ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ও যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে? জবাবটা অবশ্যই নেতিবাচক হতে
বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের উচিত ছিল ট্র্যাজেডি ঘটার পরপরই সব আড়ম্বর-অনুষ্ঠান
স্থগিত করে অবিলম্বে রাষ্ট্রযন্ত্রকে উদ্ধার ও ত্রাণের কাজে নিয়োজিত করা। সাভার
ট্র্যাজেডির ব্যাপারে সরকার সেটা করেনি। বরং প্রধানমন্ত্রী নিছক একখানি ট্রেনের
উদ্বোধনে গিয়েছিলেন এবং সন্ধ্যায় নতুন রাষ্ট্রপতির অভিষেকেও প্রচুর আড়ম্বর
হয়েছে, মনে হয় যেন সরকারের মনোযোগ সে দিকেই ছিল বেশি।
হাসপাতালে আহতদের দেখতে প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন চার দিন পরে। তিনি
উদ্ধারকাজ দেখতে প্রথম দিকে সাভারে যাননি, ধ্বংসস্তূপও দেখতে গিয়েছিলেন
চার দিন দেরি করে। অন্য দিকে এ ব্যাপারে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার ভূমিকা
অনেক বেশি প্রশংসনীয়। সেদিন ছিল ১৮ দলের জোটের ৩৬ ঘণ্টার হরতালের দ্বিতীয় দিন।
খালেদা জিয়া অবিলম্বে উদ্ধারকাজ সুগম করার লক্ষ্যে হরতাল প্রত্যাহার করেন, তিনি নিজেও সেদিন
উদ্ধারকাজ দেখতে সাভারে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ দেখতে
যাওয়ার আগেই বহু হাজার মাইল দূরে বিলেতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের
দুরবস্থা নিয়ে ব্রিটেনে আন্দোলন শুরু হয়। বিভিন্ন মহল থেকে এবং পত্রপত্রিকায়
ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি ওঠে, লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে প্রাইমার্কের প্রধান দোকানের সামনে
বিক্ষোভ হয়। তার জের ধরেই এই কোম্পানি এখন রানা প্লাজায় হতাহত পোশাকশ্রমিকদের
ক্ষতিপূরণদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
এত কিছুর পর প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল বিদেশে যারা সাভার ট্র্যাজেডিতে
উদ্বিগ্ন হয়ে উদ্ধারকাজে সহযোগিতা দিতে চেয়েছিল এবং যারা ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের
জন্য সাহায্য ও ক্ষতিপূরণের জন্য আন্দোলন করেছিল তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করা। কোনো দেশের প্রকৃত ভাবমূর্তি এভাবেই গড়ে ওঠে। কিন্তু তারও আগে
প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল সরকারের প্রয়োজন কিংবা সংগঠন ছাড়াই শুধু হাতের জোরে
যারা চাপা পড়া মানুষগুলোকে উদ্ধারের কাজে লেগে গিয়েছিল তাদের সবাইকে ধন্যবাদ
জানানো এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তার পরিবর্তে মনে হচ্ছে, যেন সব প্রশংসা
তিনি সরকারের জন্যই দাবি করছেন। বলে দেয়া প্রয়োজন যে, এই ট্র্যাজেডিতে
সরকারের ভূমিকা মোটেই আদর্শস্থানীয় কিংবা প্রশংসনীয় ছিল না।
যেসব ব্যবস্থা অবিলম্বে নিতে হবে
বাংলাদেশে অতীতে দেখা গেছে ত্রাণের অর্থ ও সামগ্রী নিয়ে হরিরলুট হয়, সেসব সামগ্রী
যোগ্য ব্যক্তিরা প্রায়ই পায় না। রিলিফের জন্য প্রাপ্ত কম্বল যথাযোগ্যরা পায়নি
বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও স্বীকার করেছিলেন, ব্যক্তিবিশেষকে
তিনি নিজেই ‘কম্বল চোর’ খেতাব দিয়েছিলেন।
প্রাইমার্কের (এবং হয়তো অন্য কোনো বিদেশী প্রতিষ্ঠানও) লোকেরা নিজেরা বাংলাদেশে
এসে ক্ষতিপূরণের অর্থ বাটোয়ারা করবে না। খুব সম্ভবত সরকার কিংবা কোনো এনজিওর
মারফৎ তারা সে অর্থ বণ্টন করবে। এ ব্যাপারে যাতে কোনো লুটপাট না হয় সরকার ও অন্য
সবাইকে সে ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের দুরবস্থা সম্বন্ধে আগেও বহু সমালোচনা হয়েছে।
মার্কিন সরকার ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কয়েক বছর যাবৎ শ্রমিকদের কাজের শর্ত ও অবস্থা
নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি এবং শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনের
অধিকার দাবি করেছে। গত বছরের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানায় আগুনে পুড়ে ১১২
জন শ্রমিকের মৃত্যুর পর আমেরিকার বৃহত্তম রিটেলার চেইন ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ থেকে
তৈরী পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। এর আগেও কোনো কোনো কারখানায় আগুন থেকে
পালানোর পথ না থাকায় শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ এপ্রিলের ট্র্যাজেডির পর
ইউরোপীয় ইউনিয়নও হুঁশিয়ারি দিয়েছে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে ইইউর দেশগুলোতে
বিনা শুল্কে পোশাক রফতানির অবাধ অধিকার বাংলাদেশ হারাবে। এই সংস্কারগুলো অবিলম্বে
না হলে বাংলাদেশ তার প্রধান রফতানি বাজার হারাবে। বিদেশের আমদানিকারকরা পরবর্তী
দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণদানের ঝুঁকি নিতে চাইবে না। তারাও বাংলাদেশ থেকে তৈরী
পোশাক আমদানি বন্ধ করে দেবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন