বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৩

জাতিসঙ্ঘের সাথেও তারা তঞ্চকতা করেছে-সিরাজুর রহমান

স্কুলজীবনে যাযাবরের দৃষ্টিপাত বইটা পড়া আমাদের অনেকের ফ্যাশন ছিল। যে পড়েনি সে আমাদের আড্ডাগুলোতে ছিল  অনেকটা অপাঙ্ক্তেয়। বইয়ের মোড়ক থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মনমাতানো চটকদার কথায় ভরপুর ছিল। প্রবীণ পাঠকদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন। বড় হয়ে বহুবার ভেবেছি বইটির কথা। চটকদার আর মনমাতানো কথার ফুলঝুরি ছাড়া আর কী ছিল সে বইতে? জবাব খুঁজে পাইনি।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের ও সরকার প্রধানের কথাবার্তা প্রায়ই আমাকে সে বইয়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। তাদের কথাবার্তায় ভাড়া করা জনতা আর চাটার দল অবশ্যই হাততালি দেয়। নইলে তাদের ভাত জুটবে না। অনেকে নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন, কেউ কেউ নিজেই নিজের কথায় বেশি মজা পান। নিজের কথাবার্তায় পাণ্ডিত্যের নিদর্শন খুঁজে পান। নিজের বৈঠকখানায় নিজের অমর উক্তি নিয়ে যদি কেউ সন্তুষ্ট থাকতেন তাহলে বলবার কিছু ছিল না। কিন্তু সেগুলোকে বেদবাক্য মনে করে তাদের অনুসারীরা ১৬ কোটি মানুষের সর্বনাশ করছে, সেটাই হচ্ছে সমস্যা।
গত ১৫ মে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি কিছু চটকদার কথা বলেছেন। একটা হচ্ছে খাল কেটে কুমির আনবেন না। আরেকটা গর্ত খুঁড়ে সাপ বের করবেন না। কারোই বুঝতে বাকি নেই যে কথাগুলো শেখ হাসিনা বলেছেন বিরোধী দলের নেতার তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তনের দাবি প্রসঙ্গে।
পরের দিন নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের তিনি শুনিয়েছেন অন্য কথা। সেখানে তিনি ডাকিনী যোগিনীর ভয় দেখিয়েছেন খালেদা জিয়াকে। বলেছেন তত্ত্বাবধায়কে ফিরলে খালেদা জিয়ার পরিণতি আরো ভয়ানক হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক এলে আবার কারাগারে যেতে হতে পারে। খালেদা জিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিচয় বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছেন ১৯৮২ সালে লে. জে. এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের  সময় থেকে। তারা জানেন, কথায় কথায় ভয় পাওয়ার মানুষ নন বিএনপি নেত্রী। সে পরিচয় শেখ হাসিনা এখনো পাননি, সেটা তার দুর্ভাগ্য।
নিজের কথায় যারা নিজেরাই হেসে কুটিপাটি হন, তারা প্রায়ই বুঝতে পারেন না যে, নিজেদের রসিকতা বুমেরাং হয়ে উল্টে তাদেরই আঘাত হানতে পারে। শেখ হাসিনাকে কি মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি প্রথমেই তুলেছিলেন তিনি নিজে? এ দাবিতে তিনি দোসর জুটিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীকে। ১৯৯৫ সালে খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সমাপ্তি পর্বে এই দুই দল আন্দোলন, হরতাল, সড়ক অবরোধ, রেললাইন উপড়ে ফেলা আর মানুষ হত্যার তাণ্ডব শুরু করে দেয়।
তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির দাবিতে তারা বিদায়ী বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। দেশকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষার জন্য নতুন নির্বাচিত সরকার সংবিধান সংশোধন (ত্রয়োদশ সংশোধন) করে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল। জুন মাসে সে পদ্ধতির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক গরিষ্ঠতা (নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নয়) অর্জন করে এবং জাতীয় পার্টির সদস্যদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে।

অমৃতে অরুচি
তার প্রথম সরকারের পর ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনও হয় তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে। কিন্তু অশাসন-কুশাসনে এবং রাজনৈতিক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। সে নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির ওপর শেখ হাসিনার ঈমান তখনই ছুটে যায়। সে পদ্ধতির বিরুদ্ধে তার লগি-লাঠি-বৈঠার আন্দোলন, দিবালোকে রাজপথে পিটিয়ে বহু মানুষ হত্যা, সড়ক ও বন্দর অবরোধ, রেললাইন উপড়ে ফেলা এবং বঙ্গভবনের পানি, বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ বন্ধ করার হুমকি ইত্যাদি নাশকতা দিয়ে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করে বর্ণচোরা সামরিক স্বৈরশাসনকে আমন্ত্রণ করে। শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল বিমানবন্দরে খোলাখুলিভাবে সে সরকারকে তার আন্দোলনের ফসল বলে অভিনন্দিত করেছিলেন। শেখ হাসিনার অমৃতেও অরুচি ধরে গেছে। এখন আর তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা শুনতেও রাজি নন।
রাজনৈতিক স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে, কিন্তু সবার নয়। অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, লাগাতার হরতাল আর সংসদ বর্জনের ফাদার-মাদার হচ্ছেন শেখ হাসিনা। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি সরকারের আমলে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল আওয়ামী লীগ, সংসদ বর্জন করে রাজনীতিকে সংসদ থেকে সড়কে নামিয়ে নিয়ে এসেছিল। এখন কথায় কথায় তিনি এবং তার মেগাফোন হার ম্যাজেস্টিস ভয়েসরা হরতালের কুফল সম্বন্ধে বিএনপিকে নসিহত করছেন, সংসদে গিয়ে সকল বিষয়ের মীমাংসা করার সদুপদেশ দিচ্ছেন। সংসদে আসুন কথাটা এখন গ্রুভ ভাঙা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে বাজছে তো বাজছেই।
বাংলাদেশের এই অল্প কয়েক বছরের ইতিহাসের কিছু শিক্ষা এখানে স্পষ্ট। শেখ হাসিনা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কখনো জয়ী হননি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, ২০০৮ সালেও তার জয় হয়েছিল একটা বর্ণচোরা সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরই অধীনে। আরেকটু পেছনের দিকে তাকিয়ে বলতে হয়, ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের (শেখ মুজিবের অধীনে) অনুষ্ঠিত নির্বাচনও ন্যায্য, সুষ্ঠু কিংবা শান্তিপূর্ণ হয়নি। বিরোধী দলগুলোকে রং-ফুট করার পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এমনই হঠাৎ নির্বাচন ডাকেন যে, কোনো দল, এমনকি আওয়ামী লীগও নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করার সময় পায়নি।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেয়াদবি নয়
আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে নির্বাচনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। মুজিবের রাজনৈতিক গুরু এবং আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান (যে সরকারে মুজিব দুর্নীতি দমন মন্ত্রী ছিলেন) ধামরাই কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালে আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাকে ছিনতাই করে কয়েক দিন গুম করে রাখে। (স্যার) মার্ক টালি ও আমি সে নির্বাচনের খবর দিতে বিবিসি থেকে গিয়েছিলাম। মূলত জাসদ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সহিংসতা আমরা দেখেছি।  মার্ক টালি তার প্রতিবেদনে বলেছেন, তিনি প্রমাণ পেয়েছেন যে, অন্তত চারটি আসনে আওয়ামী লীগ সহিংসতা ও অন্যান্য অসাধু উপায়ে জয়ী হয়েছিল। নির্বাচনের পরে শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব ছিল যে, আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তার বিরুদ্ধে বেয়াদবি করেছে।
গণতন্ত্র সম্বন্ধে আওয়ামী লীগের এই হচ্ছে মনোভাব। তারা ছাড়া অন্য কারো জয়ী হওয়াকে তারা অসহনীয় মনে করে, অন্য কারো প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের বেয়াদবি মনে হয়। তারা নিজেদেরকে মধ্য যুগের রাজরাজড়াদের মতো ঐশী বিধানে রাজশক্তির অধিকারী মনে করেন। এসব কারণে আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে গণতন্ত্র কথাটা বড্ড বেমানান শোনায়। সেটাকে আমরা গদি চাইতন্ত্র বলাটাই সঠিক হবে।
গ্রুভ-ভাঙা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো একই কথা বলে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী : তার অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। তার যুক্তি : অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের রীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। আওয়ামী লীগ দাবি করে কয়েক হাজার ইউনিয়ন বোর্ড সদস্য নির্বাচনে তারা হস্তক্ষেপ করেনি, সুতরাং জাতীয় নির্বাচনও তাদের অধীনে নিরপেক্ষ হবে। প্রেক্ষাপট ও পটভূমি সম্বন্ধে অজ্ঞ কেউ কেউ এসব যুক্তিতে প্রতারিত হতে পারে; কিন্তু রাজনীতি-সচেতন মানুষের কাছে সেসব যুক্তি অত্যন্ত দুর্বল মনে হবে।
প্রথম কথাই হচ্ছে যে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচন এক নয়। বলতে গেলে কোনো কিছুই পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই ইউনিয়ন পরিষদের। তফাৎটা তিল আর তালের মতো। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন হয় সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এখানেই মূল সমস্যা। বর্তমান সরকার গদিতে আসার সময় থেকে কারো মনেই কোনো সন্দেহ নেই যে, এই সরকার বরাবরের জন্য গদিতে থাকতে চায়। যুগ্ম মহাসচিব হানিফসহ কোনো কোনো নেতা তো প্রকাশ্যেই বলেছেন যে, বাকশাল জাতীয় প্রশাসন কায়েম করাই তাদের লক্ষ্য।

নিহত নিদ্রা, নিহত বিশ্রাম
গদিতে থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার কোনো কিছুই করতে কার্পণ্য করেননি। নিজেদের নিযুক্ত ট্রাইব্যুনালের রায় নিয়েও তারা সন্তুষ্ট নন। অভিযুক্ত সবাইকে ফাঁসির দণ্ডদানের জন্য বিচারকদের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কিছু নাস্তিক ব্লগার ইত্যাদিকে দিয়ে শাহবাগে একটা জঞ্জাল সৃষ্টি করেছে সরকার নিজেই। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে নাস্তিকদের নিরাপত্তা দিতে প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার অনেক কিছুই করেছেন। শুনছি শেষ পর্যন্ত তাদের আমেরিকায় পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। অথচ আল্লাহ-রাসূল সা: আর ইসলামের অবমাননার প্রতিবাদ করতে গিয়ে দলীয়কৃত পুলিশ আর র‌্যাবের শুট অন সাইট গুলিতে বহু নিরীহ মানুষ শহীদ হয়েছেন।
হেফাজতে ইসলাম একটা নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছে ধর্মদ্রোহী চক্র এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক সরকারের ইসলামবিরোধী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, নিজেদের ধর্ম বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে। ৬ মে ভোররাতে হাজার হাজার কান্ত, পরিশ্রান্ত মানুষ যখন মতিঝিল শাপলা চত্বরে ঘুমিয়ে ছিল তখন মিডিয়াকর্মীদের বিতাড়িত করে এবং রাস্তার আলো নিভিয়ে দিয়ে ১০ হাজার পুলিশ, র‌্যাব ও বর্ডার গার্ড নির্বিচারে তাদের ওপর অভিযান চালায়। এক সপ্তাহ সময় নিয়ে এবং বহু ভাবনা-চিন্তা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রেস নোট জারি করেছেন, পুলিশ ও র‌্যাব প্রধানরা বিবৃতি দিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, এই নির্বিচার গুলিবর্ষণে একজন মানুষও মারা যায়নি।
অথচ বাংলাদেশের পত্রিকাতেই আমরা দেখেছি, এক লাখ ৫৫ হাজার বুলেটবৃষ্টি হয়েছিল সেদিন এবং সে রাতে। বুলেটগুলো কি তাহলে মাখনের তৈরি ছিল? সারা বিশ্বের মিডিয়া এখনো বলে যাচ্ছে বহু, বহু নিদ্রিত মানুষ সে রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। আল জাজিরা টেলিভিশন দাবি করেছে যে, অন্তত তিন হাজার মানুষ মারা গেছে সে রাতে। টুইটারে, ব্লগে আর ইন্টারনেটে বহু ফটো আর ভিডিওতে মানুষের লাশ দেখা গেছে। বাংলাদেশ সরকার শুধু গণতন্ত্রই নয়, নিদ্রা ও বিশ্রামকেও হত্যা করেছিল সে রাতে। প্রধানমন্ত্রী যখন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, তিনি লাশ ফেলে ক্ষমতায় যেতে চান, তখন হাসব কী কাঁদব বুঝে উঠতে পারি না। একটার বদলে দশটা লাশ ফেলতে পারেন না?’Ñ এই অমর বাণী কি বাংলাদেশের মানুষ ভুলে গেছে?

গণতন্ত্রে তার কোনো অবদান নেই
প্রধানমন্ত্রী কি হলফ করে বলতে পারবেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে এবং গণতন্ত্র গড়ে তুলতে বিশেষ কোনো অবদান তিনি রেখেছেন? এ কথা সত্যি যে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বারবার তিনি স্বৈরতন্ত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। ১৯৮২ সালে তিনি লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তার সহযোগিতার কারণেই সে স্বৈরতন্ত্র ৯ বছর স্থায়ী হতে পেরেছিল।
১৯৯৬ সালের ২০ মে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন কারা? অবশ্যি দেশপ্রেমিক অফিসারদের তৎপরতায় সে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যায়। আর প্রধানমন্ত্রী নিজেই ২০০৭ সালের ১৫ মে দাবি করেছিলেন, সে বছরের ফখরুদ্দীন-মইন ইউ বর্ণচোরা সামরিক সরকার তারই আন্দোলনের ফসল। বলাই বাহুল্য, সে সরকারের আনুকূল্যে এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশে একটা মাস্টারপ্ল্যানের নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পেয়েছিল।
বহু জ্ঞানী-গুণী এবং প্রধানমন্ত্রীর পিতাও বলেছিলেন (যখন তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন), গণতন্ত্র একদিনে আসে না। গণতন্ত্রকে শিশুর মতো সযতেœ লালন করতে হয়, তবেই সে গণতন্ত্র শিকড় গেড়ে শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র অদ্যাবধি শিকড় গাড়তে পারেনি। সেজন্য আওয়ামী লীগের দায়িত্ব অনেকখানি। সে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের অধীনে এবং দলীয়কৃত আমলাদের দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়, সে কথা শিশুও বলে দেবে।
যে বিতর্কিত রায়ের দোহাই দিয়ে এবং সংসদে ব্রুট মেজরিটির জোরে তিনি সংবিধান সংশোধন এবং তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছেন, সে রায়ের প্রণেতাও নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে আরো কিছু সময়ের প্রয়োজন। সে জন্যই তিনি সুপারিশ করেছিলেন যে আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে হওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী ও সরকার সে রায়ের কিছুটা গ্রহণ এবং অবশিষ্টাংশ বাতিল করেছেন। তারা যেন সিঁদুরে আমের লাল দিকটা খেয়েছেন এবং অন্য দিকটা ফেলে দিয়েছেন।
বিরোধী দল ও জোটকে অনেক আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম যে গণতন্ত্রের আন্দোলন পরিপূর্ণ গণসমর্থন পেয়েছে, সে সমর্থনকে ব্যবহার করে অবিলম্বে আন্দোলনকে তুঙ্গে তুলুন। অন্যথায় তারা বহু ষড়যন্ত্র করবে। আমার সন্দেহ হয় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যারা দোদুল্যমান তাদের প্রভাবেই খালেদা জিয়া এতদিন পর্যন্ত আন্দোলনকে সাফল্য পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি।

রীতিমতো বাঁদরামি
বাঁদরামিগুলো এখন দেশের মানুষের কাছেও স্পষ্ট। তারা এখন জাতিসঙ্ঘকেও প্রবঞ্চনা করছে। বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কট এবং ভবিষ্যৎ বিভীষিকা দেখে বিশ্বসমাজ ও জাতিসঙ্ঘ খুবই উদ্বিগ্ন। এ সংস্থা সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্ডো তারানকোকে পাঠিয়েছিল শান্তিপূর্ণ পন্থায় মীমাংসার জন্য দুই প্রধান দলের মধ্যে সংলাপের পথ সুগম করতে। তারানকো যে কদিন ঢাকায় ছিলেন তত দিন সংলাপ সংলাপ করে আওয়ামী লীগ নেতারা মুখে ফেনা উঠিয়েছিলেন। মহাসচিব সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মিডিয়াকেও বলেছিলেন যে, ১৩ মে সোমবার রাতেই তিনি সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপিকে চিঠি পাঠাবেন। মিডিয়াকে আভাস দেয়া হয়, সে চিঠি নিয়ে তিনি নিজেও খালেদা জিয়ার অফিসে যেতে পারেন। জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধিকে তারা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, তারা সংলাপ চান; কিন্তু বিএনপির পিছুটানের জন্য সংলাপ হতে পারছে না।
তারানকো যে মুহূর্তে বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেন, সে মুহূর্তেই উল্টে গেল মতটা, বদলে গেল পথটা। সরকার এখন সংলাপের ঘোরতর বিরোধী। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংলাপের প্রয়োজন নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন চিঠি দিতে হবেÑ এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু জাতিসঙ্ঘের প্রতিনিধি যখন ঢাকায় ছিলেন তখন প্রয়োজনও ছিল, কথাও ছিল। ভাঙা গ্রুভের গ্রামোফোন রেকর্ডটা আবার চালিয়ে দিয়েছে তারা : সংসদে আসুন। অতীতে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, এই সংসদপ্রীতির কথা একবারও আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে আসেনি।
সাভারের রানা প্লাজা যেদিন ধসে পড়ল সেদিন ছিল বিএনপির দুই দিনের হরতালের দ্বিতীয় দিন। সে ভয়াবহ দুর্ঘটনার ফলে চাপা পড়া মানুষ উদ্ধারে সহায়তার জন্য বেগম জিয়া অবিলম্বে হরতালের অবশিষ্ট অংশ প্রত্যাহার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেদিন ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তাকে। কারণও অবশ্যি ছিল। সরকার তখন ছিল বেকায়দায়। দুর্ঘটনার পেছনে সরকারের রাজনৈতিক অসাধুতা এবং উদ্ধার কাজে রাষ্ট্রীয় বিলম্বের সমালোচনা তখন শুরু হয়েছে বিশ্বজুড়ে।
এবারে দেখুন প্রধানমন্ত্রীর অ্যাবাউট টার্ন! বিশ্বজুড়ে প্রচার হয়ে যায় যে, বিশ্বকাঁপানো সাইকোন মহাসেন ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। সাইকোনের সর্বনাশা স্বরূপ বাংলাদেশের মানুষ চিনে রেখেছে। এবারেও সেরকম ক্ষয়ক্ষতি হলে ত্রাণকাজে সব সরকারি-বেসরকারি উদ্যম ব্যবহারের প্রয়োজন হতো। সে মানবিক মূল্যবোধ থেকে খালেদা জিয়া দুদিনের হরতাল মুলতবি করলেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার চেলারা এবারে তারস্বরে টিটকারি শুরু করে দিলেন। তারা বলছেন যে, সরকারকে ভয় পেয়েই খালেদা জিয়া হরতাল তুলে নিয়েছেন। আসলে প্রধানমন্ত্রী এবং কয়জন দুর্বিনীত আওয়ামী লীগ নেতা যে ভাষায় বিরোধী দলের নেতাকে টিটকারি করছেন, সেটা সভ্য মানুষের মুখে মানায় না।

বেগম জিয়া এখন কী করবেন?
বেগম খালেদা জিয়া কী করবেন এখন? তার দলের নেতাদের প্রায় সবাইকে সরকার জেলে বন্দী করে রেখেছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে মুক্ত হলে আবার জেলগেটে গ্রেফতার করা হচ্ছে তাদের। নেতাদের বন্দী রেখে সরকার বিএনপির আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে চায়। যে দুচারজন বাইরে আছেন, তাদের সবার আনুগত্য সম্বন্ধে নেত্রী নিশ্চিত হতে পারছেন না। হতোদ্যম হয়ে পড়া তার জন্য স্বাভাবিক হতো। কিন্তু বিএনপি নেত্রী ভিন্ন ধাতুতে গড়া। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে, ফখরুদ্দীন-মইন উর বর্ণচোরা সামরিক সরকারের আমলে এবং বিগত তিন বছরে গণতন্ত্রের আন্দোলনে দেশের মানুষ তার ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা দেখেছে, লাখে লাখে তার সমাবেশে যোগ দিয়ে তাকে সমর্থন জানিয়েছে।
আগামীকাল যদি তিনি চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক দেন, আবারো তারা স্বৈরতন্ত্রকে হঠাতে ছুটে আসবে। রাজধানীর পরিস্থিতি ভিন্ন। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে, পল্লীতে-মাঠে বর্তমান সরকারের সমর্থন নেই। এমনকি তাদের নিয়ন্ত্রণও হারিয়ে গেছে। সরকারের দলীয়কৃত পুলিশ এখন কাউকে গ্রেফতার করতে গ্রাম-গঞ্জে অনেক স্থানে যেতে সাহস পায় না, গ্রামবাসীর পিটুনি খেয়ে তারা পালিয়ে আসে। আসলে দেশে সমর্থন নেই বলেই নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে সরকারের এত ভয়। নেতাদের তারা জেলে পুরে রেখেছে, রাখুক। কিন্তু দেশের মানুষ আছে খালেদা জিয়ার পেছনে। এখন যদি নেত্রী চূড়ান্ত সংগ্রামের ডাক না দেন, তাহলে আর তিনি সময় পাবেন না।

পাদটীকা : রানা প্লাজায় গোরস্তান করুন
আগেও আমরা বলেছিলাম, ধসে পড়া রানা প্লাজা থেকে সব লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। নিচের দুই কিংবা তিনটি তল দেবে মাটির নিচে চলে গেছে। সেগুলো খুঁড়ে বের করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আছে কি না সন্দেহ। কিন্তু অবশ্যই বহু লাশ সেখানে চাপা পড়ে আছে। প্রতিদিন শত শত মানুষ নিখোঁজ প্রিয়জনের ফটো নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আমার মাইয়ারে কোথায় পামু? শোকস্তব্ধ পিতার এই আকুল প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
সেনাবাহিনীর উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। এ দিকে লালসার সুদীর্ঘ কুৎসিত থাবা এগিয়ে আসছে। রানা প্লাজায় কী কী প্রকল্প হবে, প্রকল্পের নামে জমিটা কে হাতিয়ে নেবে ইত্যাদি বহু প্রশ্ন ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। অথচ গলিত লাশের দুর্গন্ধে এখনো বাতাস ভারী।
মিডিয়ায় হিসাব বেরিয়েছে, চাপা পড়া গলিত লাশের সংখ্যা সাড়ে ৫ শর বেশি হবে। এই লাশগুলো সেদিন পর্যন্ত ছিল জলজ্যান্ত মানুষ, আল্লাহর সৃষ্ট প্রাণীর মধ্যে সর্বসেরা। এরা কি কোনো সমাধি পাবে না? আমার বিবেচনায় রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষকে একটা জাতীয় সমাধি ক্ষেত্র ঘোষণা করা হোক। মানুষ আসবে, সমাহিতদের শ্রদ্ধা জানাবে। পিতা-মাতা-পরিজনেরা আসবেন। হারানো স্বজনদের উদ্দেশ্যে দোয়া দরুদ পড়ে হৃদয়ের বেদনা একটু হালকা করবেন। ভবন নির্মাণে যারা ফাঁকিবাজি করে থাকে, রানা প্লাজা চিরকাল তাদের প্রতি হুঁশিয়ারি হয়ে থাকবে।


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads