বৃহস্পতিবার, ২৩ মে, ২০১৩

আল্লামা বাবু নগরীর রিমান্ড ও জবানবন্দী প্রসঙ্গে


হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নিয়ে দেশব্যাপী নানা প্রশ্ন উঠেছে। উল্লেখ্য যে, গত ৫ মে রাজধানীর মতিঝিল-পল্টন এলাকায় হেফাজতে ইসলামের অবরোধ চলাকালে সংঘটিত সহিংস ঘটনাবলীর অজুহাত তুলে পুলিশ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে প্রথমত ৯ দিন ও পরে বিভিন্ন মামলায় আরও ২২ দিনের রিমান্ডে নেয়। সরকার সমর্থক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী দ্বিতীয় দফা রিমান্ড চলাকালেই জনাব বাবুনগরী ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম জনাব হারুন অর রশিদের নিকট জবানবন্দী প্রদান করেছেন। রিপোর্ট অনুযায়ী জবানবন্দীতে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ৫ মে অবরোধ চলাকালে সকাল থেকেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসী তৎপরতায় ছাত্রদল, যুবদল ও জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা অংশ গ্রহণ করেছিল। এতে হেফাজতের কিছু কর্মীরও অংশ নেয়ার কথা তিনি স্বীকার করেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত জবানবন্দী অনুযায়ী ১৮ দলের লোকজন তাদের অর্থসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়েছেন এবং প্রয়োজনে আরও অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থ লেনদেন ও সামগ্রিক তৎপরতা সমন্বয়ে বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বলে জনাব বাবুনগরী নাকি জানিয়েছেন। আবার তার কথিত স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ঐ দিন রাত দু’টা থেকে আড়াইটার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের সমাবেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। পরে তারা ফাঁকা আওয়াজ করলে হেফাজত কর্মীরা পালিয়ে যান। জবানবন্দীতে জুনায়েদ বাবুনগরী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঐদিন কোনও প্রাণহানি ঘটায়নি বা কেউ আহত হয়েছেন বলে তিনি শোনেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর কথিত এই জবানবন্দীর সত্যতা নিয়ে দেশব্যাপী নানা গুঞ্জরণের সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে তার আইনজীবী জনাব সানাউল্লাহ এই জবানবন্দীকে মিথ্যাচার বলে আখ্যায়িত করেছেন। হেফাজতের তরফ থেকেও এর প্রতিবাদ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর চরম নির্যাতন করে তাদের লিখিত ও পছন্দসহ জবানবন্দীতে তার স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে অথবা তার নামে এই জবানবন্দী চালিয়ে দেয়া হয়েছে। হেফাজতের আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী এক বিবৃতিতে ১৬৪ ধারায় প্রদত্ত জনাব বাবুনগরীর কথিত জবানবন্দীর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন যে, সরকার তাকে রিমান্ডে নিয়ে জোর করেই এমন বিভ্রান্তিমূলক স্বীকারোক্তি আদায় করেছেন। তিনি সরকারের প্রতি দমন-পীড়ন ও ওলামা কেরামের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হামলা মামলা বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানান। জনাব বাবুনগরীর কথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীটি আমরা গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখেছি এবং এর মধ্যে পুলিশ বাহিনীও শুরু থেকে সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য সিনিয়র নেতারা যে সমস্ত কথা বার্তা বলেছেন, তার প্রতিফলন পাওয়া যায়। মতিঝিল ও পল্টন এলাকায় সংঘর্ষ চলাকালে যে সমস্ত বিবরণ ঐ সময়ের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং দেশের মানুষ টিভি চ্যানেলসমূহে দেখেছেন তার সাথে জবানবন্দীর বিবরণীর মিল নেই। বেশকিছু পত্র-পত্রিকায় ৬ এবং ৭ মে সংঘর্ষ চলাকালে আওয়ামী লীগ ওলামা লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের নেতাকর্মীদের সশস্ত্রভাবে সংঘর্ষকালে হেফাজত কর্মীদের ওপর হামলা করতে দেখা গেছে এবং তাদের হামলায় হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী হতাহত হয়েছেন তার বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাসমূহে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে তাদের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে। কথিত জবানবন্দীতে এর যেমন উল্লেখ নেই তেমনি পুলিশ যে নির্মমভাবে তাদের ওপর গুলীবর্ষণ করেছে, কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে এবং বেধড়ক লাঠিপেটা করেছে তারও উল্লেখ নেই। গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে ১০-১২ হাজার পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি তাদের উচ্ছেদ করার জন্য যে নির্মমতার আশ্রয় নিয়েছিল কথিত জবানবন্দীতে তাকে অত্যন্ত সহজভাবে দেখানো হয়েছে। এতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, সরকার ও পুলিশ বাহিনী তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই তাকে তাদের তৈরি করা জবানবন্দীতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছেন।
এই জবানবন্দী নিয়ে আরও অনেক প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন যে, আইনের দৃষ্টিতে এই জবানবন্দীর কোন মূল্য নেই। শেখ হাসিনা বিগত কেয়ারটেকার আমলে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং তার দলের সাধারণ সম্পাদকসহ বহু সিনিয়র নেতাও গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে গিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বাসে অগ্নিসংযোগ করে ১১ জন লোককে হত্যার নির্দেশ দেয়ার ব্যাপারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, জান বাঁচানো ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তার দলের নেতৃবৃন্দকে এই জবানবন্দী দেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এখন জনাব বাবুনগরীরও রিমান্ডে দেয়া এই জবানবন্দী সম্পর্কেও অনুরূপ প্রশ্ন উঠতে পারে বলে আমরা মনে করি। দ্বিতীয়ত : জনাব বাবুনগরী যে জবানবন্দী দিয়েছেন তা দিয়েছেন একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এবং সেখানে কোনও সাংবাদিক বা অন্য কেউ ছিলেন না। এই অবস্থায় জবানবন্দীটি পত্র-পত্রিকায় কিভাবে আসলো এবং যে ভার্সানটি প্রকাশিত হয়েছি তা কতটুকু সত্য এ প্রশ্নটিও ওঠা অস্বাভাবিক নয়। আবার যে পদ্ধতিতে রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তা ছিল অত্যন্ত নির্মম এবং নির্যাতনমূলক। রিমান্ড সম্পর্কে উচ্চ আদালতের দেয়া কোনও দিক নির্দেশনাই সরকার বা পুলিশ বাহিনী মানেনি। এই অবস্থায় পুরো জবানবন্দীটির সত্যতাই প্রশ্নবিদ্ধ বলে আমরা মনে করি। সরকার আলেম সমাজের একটি সংগঠনের এই শীর্ষ নেতাকে রিমান্ডে নির্যাতন করে যে নৃশংস আচরণ করেছেন তার নিন্দা করার ভাষা আমাদের নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads