বাসায় ফেরার সাথে সাথে আমার ছোট মেয়েটি দৌড়ে কাছে এলো। হাত ধরে টিভি’র কাছে নিয়ে গেল। টিভির দিকে তাকিয়ে বললো, বাবা দেখ ঢাকার রাস্তায় কত্ত জুতা পড়ে আছে। একটু আগে দেখাচ্ছিল। এগুলো কাদের জুতো বাবা? নাকি সারা রাস্তায় জুতোর দোকান দিয়েছে আঙ্কেলরা? আরো কত কি? দৃশ্যটা আমি কর্মস্থলে গিয়ে টেলিভিশনে সকালেই দেখেছিলাম। এক সাথে এতো জুতো পড়ে থাকার দৃশ্য আর কখনও দেখা যায়নি। পানিতে ভেজা জুতাগুলো বেশ চকচক করছিল। ইলেকট্রিক মিডিয়ার পাশাপাশি প্রিন্ট মিডিয়াতেও স্থান পায় জুতোগুলো। শুধু তাই নয়। সমাবেশে আসা মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া জুতো নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশের স্বনামধন্য একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে। “দু’পাটি জুতার জন্য হাহাকার” শিরোনামে মন্তব্য কলামটি পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে বেশ। চমৎকার শিরোনাম পড়তে বাধ্য করলো আমাকেও। ব্যথিত হলাম গ্রামের মানুষ নিয়ে তাচ্ছিল্যভরা লেখাটি পড়ে। ৫ মে হেফাজতের সমাবেশে আসা গ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোকে নিয়ে লেখাটির কিছু অংশ পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরলাম-“জুতো ছাড়াই অনেকে বাড়ি ফিরে গেল। বড় শখের জুতো জোড়া। নিশ্চয়ই আরো অনেকদিন জুতো কেনা হবে না। নিশ্চয়ই অনেকদিন ৩০ টাকা দামের প্লাস্টিকের স্যান্ডেল পরে চলতে হবে। হারানো জুতো জোড়ার জন্য দুঃখ থাকবে বেশ কিছু দিন। টিভিতে ঢাকার রাস্তায় চোখ খুঁজে বেড়াবে জুতো জোড়া। সে কি কোনোদিন জানতেও পারবে না তার জুতো দু’পাটি কোথায় পড়ে আছে!”
মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মহেশ্বর চাঁদা গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দিনের মুখচ্ছবি। প্রতি বছর বালাম ধানের চাষ করেন তিনি। মেয়ে ঢাকাতে থাকে। মস্তবড় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। দেশ বিদেশে সুনাম আছে তার। মাটি ও মানুষ নিয়ে কাজও করে। কৃষকদের ইজ্জত দেয়। মাটির ঘরে বসে। মাটির সানকিতে তৃপ্তিসহকারে খায়। গ্রামে এলে আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সবাই ছুটে আসে তার কাছে। সেও ময়লা কাপড় পরা ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে মাটিমাখা মানুষগুলোর সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। এমন মেয়েকে ভেজালের এ দুনিয়ায় ভেজাল চাউল খেতে হবে- মেনে নিতে পারেনা কৃষক হেলাল উদ্দিন। তাই প্রতি বছর বালাম ধানের ঢেঁকিছাঁটা চাউল মেয়েকে দিয়ে আসেন। বর্ষার মওসুমে খাল-বিলের দেশীয় প্রজাতির সুস্বাদু মাছ মাটির ভাঁড়ে পানি ঢেলে যতœ করে ঢাকায় নিয়ে যান তার জন্য। রক্তের সম্পর্ক নেই তার সাথে। তবু সে মেয়ে এবং তার জন্য এতো কিছু। আসলে এমন অনেক কিছুই সম্ভব গ্রামের মানুষ দ্বারা। এরা শুধুই দিতে জানে, নিতে জানে না। লেখকের জন্ম হয়তো শহরে। ফলে ত্যাগের কোন দৃশ্যপট পারিবারিকভাবে অথবা সামাজিকভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আপনার। তাই নবী (সঃ)কে ভালোবেসে সামান্য স্যান্ডেল হারানোর বেদনা সমাবেশে আগুন্তুকদের তাড়া করে ফিরবে- এমনটি মনে হয়েছে আপনার। লেখকের উদ্দেশ্যে বলতে চাই। গ্রামের মানুষেরা লৌকিকতা বোঝে না। ওরা যা ত্যাগ তা অন্তরের অন্তরস্থল থেকে করে। সামান্য একজন মিডিয়ার মানুষের জন্য সৃষ্ট ভালোবাসার নজির যদি এমন হয়। তাহলে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ভালোবাসার নজির কেমন হতে পারে আন্দাজ করুন। সামান্য একজোড়া জুতো খুঁজে ফেরার কথা বলে লেখক তাদের ভালোবাসাকে খাটো করে দেখেছেন। অপমানিত করেছেন বাংলার খেটে খাওয়া মানুষদের।
আবারো ফিরে আসি হেলাল উদ্দিনের কথায়। হেলাল উদ্দিন শুধু ভালোবাসার টানে রক্ত সম্পর্কীয় মেয়ে না, এমনকি নিজ ধর্মেরও না এমন একজনের জন্য ভালোবাসার যে নজির স্থাপন করেছেন তা শুধু গ্রামেই মেলে। শহরের মানুষের মধ্যে এমনটি কদাচিৎ দেখা যায়। আসলে এমন ভালোবাসা শুধু গ্রামের হেলাল উদ্দিনদের দ্বারাই সম্ভব হয়। এরাই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসার মানুষের জন্য প্রিয় জিনিস ত্যাগ করতে জানে ওরা। ভালবাসার বিনিময়ে কিছু পেতে চায়না ওরা। ওদের ভালোবাসা নিখাঁদ ও নিঃস্বার্থ। যারা লোভী ও কাঙ্গাল শ্রেণীর- তারা ভালবাসে বিনিময়ে কিছু পাবার আশায়। মূলতঃ এ শ্রেণীই গ্রামীণ মানুষের নিঃস্বার্থ ভালবাসাকে ছোট করে দেখার হীনমন্যতা দেখায়।
গত ৫ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ইসলাম রক্ষার ডাকে গ্রামের অনেক মানুষ ঢাকা গিয়েছিলেন। নবীপ্রেমী এ মানুষগুলো সমাবেশে গিয়েছিলেন নাস্তিক-মুরতাদ ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে। ওরা নবী (সাঃ)কে খুব বেশি ভালোবাসে। ওদের এ ভালোবাসায় কোন খাঁদ নেই। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে কেউ কটূক্তি করবে, আর জীবন থাকতে তা মেনে নেবে- এমনটি ভাবতেই পারে না তারা। ইসলামের ওপর কোন আঘাত সহ্য করতে পারেনা ওরা। তাই নবী (সাঃ)কে নিয়ে কটূক্তি করায় অত্যন্ত মর্মাহত হয় তারা। প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে ছুটে আসেন অচেনা-অজানা এই ঢাকা শহরে। কিন্তু দাবি আদায় তো দূরের কথা। গলা ফাটিয়ে প্রতিবাদী শ্লোগান দেবার পর্যাপ্ত সময় পায়নি তারা। সরকার শাহবাগের মতো এদেরকেও সুযোগ করে দিলে হয়তো লাকির মতো একজন শ্লোগান যুবকও পাওয়া যেত। যাই হোক সরকারের ইচ্ছা না থাকায় তা আর সম্ভব হয়নি। রাতেই সমাবেশ প- করে দেয়া হয়। নবীপ্রেমী গ্রামের এ মুসলমানরা সেদিন অপারেশন শাপলার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। তবে প্রতিবাদ হিসেবে রেখে গেছে অসংখ্য পাদুকা। ওদের প্রতিবাদী জুতাগুলো কাদের জন্য? এদেশের নাস্তিক-মুরতাদ এবং ওদের দোসরদের জন্য? নাকি অভিযানে অংশ নেয়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য? নাকি যারা ওদেরকে এখানে জমায়েত করেছে তাদের জন্য? রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ভালোবাসায় জীবন উৎসর্গ করার নিয়তে বাড়ি থেকে বের হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে অনেকে জীবন দিয়েছেন সেদিন। অনেকে পাদুকা হারিয়ে ঘরে ফিরেছেন। শহুরে সভ্যদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশের প্রতিকৃতি রেখে যাওয়া জুতো নিয়ে ওদের কোন আফসোস নেই- এটা নিশ্চিত। তবে বিভীষিকাময় ঐ রাতে গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর ফেলে যাওয়া এ জুতো হয়তো স্বপ্নে চপেটাঘাত করবে অনেককে দীর্ঘদিন ধরে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন