আবহমান কাল থেকেই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্র্রীতি বিশ্ববাসীকে
মুগ্ধ করেছে। ২০০১ সালের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮৫.৭ শতাংশ মুসলিম, ৯.২ শতাংশ হিন্দু, ০.৭ শতাংশ বৌদ্ধ, ০.৩ শতাংশ খ্রিষ্টান
ও ০.১ শতাংশ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। তারা যুগ যুগ ধরে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে।
প্রায় ১৪০০ বছর আগে রাসূল সা: বলেছিলেন, যেখানে সংখ্যাগুরুরা হবে
মুসলমান সেখানকার সংখ্যালঘুরা (অমুসলিমরা) মুসলমানদের জন্য আমানত।
আমরা আজো সেই মহান আদর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি। আমাদের ৫৬ হাজার
বর্গমাইলের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় দাঙ্গা
হয়নি বলা যায়। অথচ বিগত অর্ধশতাব্দীতে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতে সাম্প্র্রদায়িক ছোট-বড়
দাঙ্গা হয়েছে ২৬ হাজারবারেরও বেশি। মুসলমানেরা ১৪০০ বছর ধরে পুরো আরবে শাসনকার্য
পরিচালনা করে আসছে। আরব জগতে এখনো এক কোটি ৪০ লাখ লোক কপটিক খ্রিষ্টান। যখন এই
মুসলমানেরা ভারত শাসন করেছিল ৭০০ বছর ধরে, তখনো অমুসলিমদের জোর করে
ইসলামে আনা হয়নি, অত্যাচার করা হয়নি তাদের ওপর। মুসলমানেরা যদি অমুসলিমদের সাথে
সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি বজায় না রাখত তাহলে ১৯৩৪ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত
যেখানে খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৭ শতাংশ, সেখানে ইসলাম
ধর্মের অনুসারীদের তার চেয়ে কম, ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটত না। হুমকি-ধমকি দিয়ে অনুসারী বৃদ্ধি করা ইসলামি
শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আমাদের এই বাংলাদেশে হিন্দুসহ সব সংখ্যালঘু
সম্প্র্রদায়ের নিরাপত্তার গ্যারান্টি মূলত ইসলামের মানবিক আদর্শ। কুরআনই
মুসলিমদের প্রতিদিন মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘ইসলামে কোনো জবরদস্তি নেই’; অর্থাৎ বল
প্রয়োগ করে বিধর্মীদের ওপর ইসলাম চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কেউ চাপিয়ে দিলে সেটা
হবে জঘন্য অন্যায়।
২০০৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সব জাতীয় দৈনিকে প্রশাসনের
উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। ৪১১ জন কর্মকর্তাকে উপসচিব
পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে সংখ্যালঘু কর্মকর্তা ৬২ জন। অর্থাৎ তাদের শতকরা হার ১৭.৭৬
শতাংশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ সংখ্যালঘু। দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের
গুরুত্বপূর্ণ পদে সংখ্যালঘুদের পদোন্নতির হার জনসংখ্যার অনুপাতের চেয়ে বেশি। যদি
বাংলাদেশের যেকোনো অফিসের নিম্নপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিসংখ্যান নেয়া
যায়, তাহলে এ হার এরও বেশি পাওয়া যাবে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানেরা
মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ সরকারিভাবে, ৩৫ শতাংশ বেসরকারিভাবে। তবুও
সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে তো দূরের কথা, সরকারি নিম্নপর্যায়ের পদেও
তাদের জন্য ২ শতাংশের বেশি কোটা সংরক্ষিত নেই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের গড়
অর্থনৈতিক অবস্থা সংখ্যাগুরু মুসলমানদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রেই উন্নত। এ ক্ষেত্রে
শ্রীলঙ্কার কথা বলা যেতে পারে। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা সংখ্যাগুরুদের তুলনায়
অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমৃদ্ধ ছিলেন; কিন্তু সরকারের বিভিন্ন বৈরী নীতি ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের নির্যাতনের
কারণে তারা আজ নানা সঙ্কটে বিপন্ন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ব্যবসায়-বাণিজ্যে
সংখ্যাগুরু মুসলমানদের তুলনায় পিছিয়ে নেই। ভারতের গুজরাটের মুসলমানদের ব্যবসায়-বাণিজ্য
ছিল জমজমাট। তা যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে সেটা বাংলাদেশে অকল্পনীয়। সংখ্যাগুরুরা
বৈরী হলে কি সংখ্যালঘুরা ব্যবসায়-বাণিজ্যে এতটা অগ্রসর হতে পারতেন আমাদের দেশে? ভারতের অন্ধ্র
প্রদেশের সরকার চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য মাত্র ৫ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা
ঘোষণা করার সাথে সাথে সেখানকার আদালত পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে লেগে আছে। এমন অবস্থা
বাংলাদেশে কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা মিডিয়াতেও তাদের জনসংখ্যার
অনুপাতে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। বাংলাদেশে সরকারি অর্থায়নে মসজিদভিত্তিক শিশু ও
গণশিক্ষার পাশাপাশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত
করার জন্য মন্দিরভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠাগার চালু রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক ও
যুক্তিসঙ্গত। হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের স্থায়ী আমানত নয় কোটি টাকা থেকে ১২
কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ট্রাস্টের স্থায়ী কমপ্লেক্স নিজস্ব জায়গায়
নির্মাণের জন্য সরকার সাত কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। দেবোত্তর সম্পত্তি
চিহ্নিত করে তা ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে সরকার সেল গঠন করেছে। হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ
ট্রাস্টের সদস্যদের জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য করা হয়েছে। প্রাচীন কালের
বৌদ্ধধর্মগুরু জ্ঞানতাপস অতীশ দীপঙ্করের নামে বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। গঠন করা
হয়েছে খ্রিষ্টানধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের
যোগ্যপ্রার্থীদের চাকরি ও পদোন্নতি এবং যোগ্য স্থানে পদায়নের ব্যবস্থা করা
হয়েছে। তাদের উদ্যোগে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার
সুযোগ দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর দুর্গাপূজার মণ্ডপের সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার, তা বৃদ্ধি পেয়ে
বর্তমানে ২০ হাজারেরও বেশি। আগে দুর্গাপূজায় অর্থবরাদ্দ দেয়া হতো সাড়ে তিন কোটি
টাকা, বর্তমানে তা ১০ কোটি টাকারও বেশি। ভারতের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে
আওরঙ্গজেব ছিলেন সর্বাপেক্ষা ধর্মপরায়ণ সম্রাট। তিনি ‘জিন্দা পীর’ রূপে পরিচিত। তিনিই ভারতের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা বেশি অনুদান মঞ্জুর
করেছিলেন হিন্দুদের মন্দির সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য। সাম্প্র্রদায়িক
সম্প্র্রীতি আছে বলেই বাংলাদেশের একজন হিন্দু উচ্চ আদালতে কুরআন সংশোধনের মতো
ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবিতে মামলা করার পরও গত ৬ এপ্রিল শীর্ষস্থানীয় আলেমরা মহাসমাবেশের
আয়োজন করে সেখানে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এই দেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ সব
ধর্মাবলম্বীর স্বাধীনভাবে নিজ ধর্ম পালন করার অধিকার রয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি
উপজেলার নানুপুর মাদরাসার সীমানা দেয়ালের পাশেই বৌদ্ধমন্দির। প্রায় অর্ধশতাব্দী
ধরে চলছে দুই সম্প্রদায়ের সম্প্র্রীতিময় সহাবস্থান। মাদরাসার মহাপরিচালক মাওলানা
জমিরুদ্দীন যখন মারা যান, তখন নানুপুরের এ বৌদ্ধপল্লীর ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠেছিল।
এ দেশে ইসলাম এসেছে একটি ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে; কোনো রাজনৈতিক
ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাত ধরে কিংবা তরবারির জোরে নয়। এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, অন্য দিকে তারা
অন্য ধর্মের প্রতি উদার ধর্মীয়, ভাষাগত কিংবা নৃতাত্ত্বিক সংখ্যাগুরু সম্প্র্রদায় সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর তখনই জোরজবরদস্তি, হত্যা-জুলুম চালায় যখন সংখ্যাগুরু
জনগোষ্ঠীর মাঝে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি বা পরকালের বিচারের অনুভূতি থাকে না।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশ যেভাবে
চলছে, তাতে ২০ বছর পর দেশে কোনো হিন্দুর অস্তিত্ব থাকবে না। তিনি বলেছেন, হিন্দুদের মন্দির
ও সম্পত্তির ওপর যে চোরাগোপ্তা হামলা চলছে, সেগুলো অনুশীলনমাত্র। তার মতে, হিন্দুদের
বিরুদ্ধে ‘ভয়ঙ্কর হামলা’ সামনের দিনগুলোতে
আসছে। তার তত্ত্ব অনুযায়ী তিনটি পন্থায় হিন্দুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে প্রথমত সবাইকে মেরে ফেলা হবে; দ্বিতীয়ত সবাই ধর্মান্তরিত
হয়ে যাবে; তৃতীয়ত সবাই দেশ ছেড়ে পালাবে। অথচ হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার
বাস্তবে কোনো কারণ নেই। কারণ বাংলাদেশে মুসলমানেরা সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করার
জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠেনি। ড. মিজান যদি এমন কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে থাকেন, তবে সুনির্দিষ্ট
তথ্য দিয়ে হামলা রোধে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে তার ভূমিকা পালন
করছেন না কেন? আমি মনে করি, এমন কথা বলে তার মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি
করেছেন। মুসলমান জনগোষ্ঠীকে চরমভাবে অপমান ও হেয় করেছেন।
আমরা মুসলমানেরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে নিয়ে সুখে-দুঃখে আছি, এটাই বাস্তবতা।
যে দেশের হিন্দুর দুঃখে মুসলমান এবং মুসলমানদের বেদনায় হিন্দুরা কাঁদে, যে মুসলমানেরা
মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মন্দিরগুলো হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিল, সেই স্বাধীন দেশে
আজ পুলিশকে পোড়া মন্দির পাহারা দিতে হয়। বাস্তবতা হলো, কিছু মন্দির আমরা
রক্ষা করতে পারলাম না। এসব হামলায় জড়িতদের নাকি শনাক্ত করাও যাচ্ছে না। ফলে
বিচার ও সাজা ভোগ করা দূরে থাক, হামলাকারীরা ধরা পর্যন্ত পড়ছে না। এটা বড়ই বিস্ময় ও দুঃখের বিষয়।
মিসরে ইসলামের প্রাথমিক যুগের আমর যখন মিসরের গভর্নর ছিলেন, তখন তার এক
সেনাপতি সকালে পাখি শিকার করতে গিয়ে দেখতে পেলেন, অমুসলিমদের একটি মূর্তির নাকের
ওপর একটি পাখি বসে আছে। তিনি ভাবলেন, আমরা মুসলমানেরা এখানে
সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই অমুসলিমদের মূর্তিও রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। এই যে পাখিটি
বসে আছে, এটি পায়খানা করলে মূর্তির অসম্মান হবে। তাই একটি তীর ছোড়া হলো পাখি
তাড়ানোর জন্য। তীরটি গিয়ে মূর্তির নাকে লেগে নাকটি ভেঙে গেল। যখন মূর্তির
অনুসারীরা তা দেখল, তখন মুসলমানদের দোষারোপ করল এবং এই সিদ্ধান্ত নিলো যে, মূর্তির নাকের
পরিবর্তে মুসলিম গভর্নর আমরের নাক কাটতে হবে। গভর্নর বললেন, আমি মূর্তি
রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ, তখন আমার নাক কাটার জন্য
প্রস্তুত একজন অমুসলিম তার নাক কেটে দেয়ার জন্য সামনে এগোতে লাগলেন। তখনই
পূর্বোক্ত সেনাপতি দৌড়ে এসে বললেন, দেখো, তোমরা আমার নাক
কেটে নাও, কারণ আমিই এই মূর্তির নাক ভেঙেছি। তিনি ঘটনা খুলে বলে বোঝালেন আমরা
জানতাম না, মুসলমানেরা আমাদের প্রতি এতটাই সুবিচার করতে পারে।’ এই হলো মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আর আজ যদি সরকার এ দেশে
সংখ্যালঘুদের মন্দির রক্ষায় ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটা হবে ইসলাম
নির্দেশিত একটি দায়িত্বের প্রতি অবহেলা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন