ধূমকেতু : ’৯১-এ ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদ শেষে ’৯৬ সালে বিএনপি তার সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। তখন বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন বিএনপিকে বিরোধী দলবিহীন ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন এবং সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি স্থাপন করতে হয়। সঙ্গত কারণেই সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়ার কথা। ’৯৬-এ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর মেয়াদ শেষে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসে। মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে যে কোনো উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের অনুকূলে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এ নিয়ে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল ‘নীলনকশা’র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। সংকটের সুরাহা যখন কোনোভাবেই হচ্ছিল না তখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং তাদের স্বাগত জানায়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় জোট তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় লাভ করে। তাদের সরকারের মেয়াদ এখন শেষ প্রান্তে। স্বাগত জানানো (আওয়ামী লীগ বরাবরই দাবি করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি তাদের আন্দোলন ও দর্শনের ফসল) যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিল ১৪ দল, এখন তারাই মনে করছে এ পদ্ধতি অগণতান্ত্রিক। ফলে কোর্টের রায় উল্লেখ করে সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অতি দ্রুত তা বাতিল করে।
মহাজোট সরকারের বক্তব্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যারা পরিচালনা করেন তারা অনির্বাচিত। তাদের দ্বারা নির্বাচন করা গণতান্ত্রিক ধারার পরিপন্থী। কাজেই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী নির্বাচন হবে তাদের নিয়ন্ত্রিত সরকারের অধীনে। তাদের এই ব্যাখ্যা গণতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক দেশে স্বীকৃত ব্যবস্থা হলেও বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন শুধু কঠিনই নয়, অসম্ভবও বটে। এ বাস্তবতায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের দাবি, যে নামেই হোক নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। তারা মনে করছে, বর্তমান সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।
চিন্তাশীল মানুষ মনে করছে, একদিকে বিরোধীদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ হাজার হাজার কর্মীকে মামলা দিয়ে জেলে ঢোকানো, মিটিং মিছিল করতে না দেয়াসহ দলন-পীড়নে কোণঠাসা করে ফেলা, অন্যদিকে নির্বাচনের আহ্বান তাদের কাছে প্রহসন মনে হওয়া স্বাভাবিক। অনেকেই বিভিন্ন টকশোতে বলছেন, গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নির্বাচিত সরকারের অধীনে কোনো না কোনো সময় নির্বাচন শুরু করতেই হবে। তারা উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট মিন্স্টার সিস্টেম টেনে আনছেন। তারা এ বাস্তবতা উপলব্ধি করছেন না, ওয়েস্ট মিন্স্টার সিস্টেমে নির্বাচন করতে হলে বিরোধীদলের আস্থা অর্জন, সরকার ও বিরোধীদলের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহাবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে বিরোধীদলের ওপর দমন-পীড়ন করে তিক্ত সম্পর্ক সৃষ্টি করা হয় না। সেখানে সরকার ও বিরোধীদলের মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও পারস্পরিক সহাবস্থান ও বিরোধীদলের রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয় না। তাদের মাথায় গুটিকয় ব্যক্তির উন্নতির স্বার্থচিন্তা থাকে না, থাকে দেশের উন্নতির চিন্তা। মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তাকে দেশপ্রেমিক বলা হয় না বা দফতরবিহীন হয়েও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে দেখা যায় না। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার আগে দলকে নয়, দেশকে প্রাধান্য দেয়। আমাদের দেশের সরকার ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এ চিন্তার অনুশীলন অতীতেও হয়নি এখনও হচ্ছে না। এ কারণেই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান জরুরি।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য লেভেল প্লেইং ফিল্ডের বিকল্প নেই। শুধু নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারই যথেষ্ট নয়, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে সংস্কার প্রয়োজন। এই উদ্যোগ ও মানসিকতা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সে সরকার প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে দলীয়করণ করে। প্রশাসনকে প্রশাসনের মতো চলতে দেয় না। দলয়ী আনুগত্যের নিরিখে প্রশাসন পরিচালনা করা হয়। দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন দলের প্রতি অনুগত কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়। সরকারের প্রশ্রয়ে প্রশাসনের একশ্রেণীর কর্মকর্তাও ভোল পাল্টে সরকারের দলীয় লোক বলে পরিচয় দিতে উঠে পড়ে লাগে। সরকারও প্রশাসন যন্ত্রকে দলের মতো পরিচালনা করতে শুরু করে। ক্ষমতা ছাড়ার সময় তাদের এ বিশ্বাস থাকে, অনুগত কর্মকর্তারা নির্বাচনে তাদের সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এ ধারণা যে ভুল, অতীতে তা বহুবার দেখা গেছে। যখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে তাদের সাজানো প্রশাসন ভেঙে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় বা রাষ্ট্রের প্রকৃত ইন্সট্রুমেন্টে পরিণত করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসে বিগত যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে সেগুলো সুষ্ঠু ও দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে প্রশাসন দলীয়করণ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরপরই কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজেদের আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে জাহির করার তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। অন্যদিকে নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, দলীয় আনুগত্যে যারা উচ্চপদে আসীন হয়েছেন, তারা এখন আতঙ্কে। কেউ কেউ ভোল পাল্টে নিরপেক্ষ সাজার চেষ্টা করছেন। তাদের এই আতঙ্ক ও ভোল পাল্টানো থেকেই বোঝা যায়, প্রশাসন ব্যাপকহারে দলীয়করণ হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার এবং প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন সংস্কারের মাধ্যমে লেভেল প্লেইং ফিল্ড সৃষ্টি ছাড়া জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নজির এখনও সৃষ্টি হয়নি। সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিবেশ ও পরিস্থিতির লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। যদি তাই হতো তবে মহাজোট সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগ ’৯৬ এবং ২০০৬ সালে তৎকালীন বিএনপি ও জোট সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতো। তারা জানতো, তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সাজানো প্রশাসন দিয়ে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়েছিল বলেই সেসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামী লীগ ও পরবর্তীতে মহাজোট বিজয়ী হয়েছিল।
প্রধান দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক এমন কোনো আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপিত হয়নি যে, একে অন্যের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। ক্ষমতাসীন সরকার যতোই বলুক, তাদের অধীনে নির্বাচন হলে প্রশাসনের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার করা হবে না, তারা রুটিন ওয়ার্ক করবেন, তাদের এ কথা সচেতন মহলে বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কথা নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করছে, বর্তমান প্রশাসন যেভাবে দলীয়করণ এবং নির্দেশনামূলক অবস্থায় রয়েছে, তাতে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তারের প্রয়োজন নেই। প্রশাসন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তাদের পক্ষে কাজ করবে। দলের প্রতি আনুগত্যের বাইরে দলীয় কর্মকর্তাদের কাজ না করাই স্বাভাবিক। এ বাস্তবতায় নির্দলীয় ও দলীয়করণমুক্ত প্রশাসন ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।
১১ মে প্রথম আলো একটি জনমত জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। একই সাথে জনমত জরিপের পটভূমিও ব্যাখ্যা করে পত্রিকাটি। পটভূমি প্রসঙ্গে বলা হয়, নানা দাবিতে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মুহুর্মুহু হরতাল ও অবরোধ এবং বিভিন্ন পক্ষের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় গত কয়েক মাসে দেশে প্রবল অস্থিরতা ও সংশয় ছড়িয়ে পড়ে। গত এপ্রিল মাসের ৯ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি কোয়েস্ট এ জরিপ পরিচালনা করে। জনমত জরিপের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে সবাই কি ভাবছে তা নীতিনির্ধারক, গবেষক, বিশ্লেষক ও পাঠকদের জানানো প্রথম আলোর উদ্দেশ্য। প্রথম আলোর জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ নির্দলীয় অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন চায়। এ দাবির পক্ষে মানুষের সংখ্যা এখন ৯০ শতাংশ। জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধাযক সরকারের পক্ষে। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বাধা কোথায়?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন