শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৩

গাজীপুরের নির্বাচন : সরকারের কি বোধোদয় হবে?


আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত গাজীপুর সিটি করপোরেশন ৬ জুলাই নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোটপ্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নানের বিপুল ভোটে জয় লাভ আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের অনাস্থা হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এ নির্বাচনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের পরিবর্তে জাতীয় নির্বাচনের এক আবহ সৃষ্টি হয়েছিল এবং দুই জোটই তাদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাপকাঠি হিসেবে নিয়েছিল। ফলে নির্বাচনে বিজয় লাভের জন্য উভয় জোটই মরিয়া ছিল। সরকারের অবস্থানের কারণে ১৪ দলীয় জোট প্রশাসনিক সব সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়েছিল। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এনবিআরের দলবাজ চেয়ারম্যানকে দিয়ে অধ্যাপক এম এ মান্নানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা, মালামাল ক্রোক করার ঘোষণা এবং আগামীতে এমন তৎপরতা অব্যাহত রাখার হুমকি কোনো কিছুই জনগণ আমলে নেয়নি। এ ছাড়াও ১৪ দলীয় জোটপ্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় অতিক্রমের পর প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমকে জোর করে বসিয়ে দেয়া, নির্বাচনী মাঠে তোফায়েল আহমেদসহ অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা নিয়োগ, প্রশাসনের মাধ্যমে নিজেদের অনুগত কর্মকর্তাদের নির্বাচনী কাজে নিয়োগসহ সম্ভব সব তৎপরতা অবলম্বন করেও জনতার সতর্ক পাহারার কারণে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। এবারের নির্বাচনে স্থানীয় উন্নয়নের পাশাপাশি ১৮ দলীয় জোটের জোরালো দাবি ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন; সরকারের চরম দমনপীড়ন; পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ার কেলেঙ্কারিসহ সীমাহীন দুর্নীতি; মিডিয়ার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি বন্ধ; আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থী জনগোষ্ঠীর ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন, ৬ মে হেফাজতে ইসলামের ওপর রাতের আঁধারে হত্যাযজ্ঞ; প্রশাসন ও বিচারালয়সহ সব ক্ষেত্রে দলীয়করণ, যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে আলেম-ওলামা ও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা ইত্যাদি বিষয়ে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান। পক্ষান্তরে ১৪ দলীয় জোটেরও স্থানীয় উন্নয়নের পাশাপাশি মৌলিক দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। বর্তমান সরকার বিরোধী দলের সব আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত হিসেবে দেখে থাকে। দেশবাসী অধীর আগ্রহে এ নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং নির্বাচনী এ রায়ের মাধ্যমে জনগণ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে বিরোধী দলের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করেছে। নবনির্বাচিত মেয়র অধ্যাপক এম এ মান্নান বিজয় লাভের পর এক প্রতিক্রিয়ায় জানান, জনগণ দুঃশাসনের জবাব দিয়েছে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য কৌশল নির্ধারণের কথা বলেছেন। দলবাজ ও বাম বুদ্ধিজীবী এবং তোষামোদকারীরা আওয়ামী লীগের পরাজয় না দেখে গণতন্ত্রের বিজয় দেখছে। ৯০ শতাংশ গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ কেয়ারটেকার সরকারের পক্ষে এবং রাজনীতিতে কোনো সঙ্ঘাত দেখতে চায় না। বাম রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরাই নেত্রীকে শোধরানোর সব পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে। একজন অনুসন্ধিৎসুর দৃষ্টিতে সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস অর্থাৎ নির্বাচনে পরাজয়ের কারণগুলো নিম্নরূপ: ০১. আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হিসেবে যতখানি পারঙ্গম সরকার পরিচালনায় ততখানিই ব্যর্থ। নির্বাচিত হওয়ার পর সরকার আর কোনো দলের থাকে না সরকার হয়ে পড়ে সমগ্র জনগোষ্ঠীর। কিন্তু আওয়ামী লীগ সঙ্কীর্ণ দলীয় গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ না করে আরো বিভক্তি আনয়নের চেষ্টা করেছে। ০২. মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য ইতিবাচক কাজের চেয়ে নেতিবাচক কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী। ০৩. কেয়ারটেকার সরকারের কোনো বিকল্প নেই এবং এ দাবি এখন গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকারের একগুঁয়েমির কারণে জনগণ চরমভাবে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। ৪. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে আলেম-ওলামা, ইসলামি ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিচারকে জনগণ প্রহসন হিসেবেই দেখছে। এর আগেও আওয়ামী লীগ দুই টার্ম ক্ষমতায় থাকার পর কোনো বিচার না করে ৪২ বছর পর আজ বিচার করতে চাওয়া, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবেই জনগণ বিষয়টিকে দেখছে। তাই বিশ্ববরেণ্য আলেম আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হলে সমগ্র দেশবাসী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং একদিনে ৬৬ জনসহ দেড় শতাধিক মানুষ শাহাদত বরণ করে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে জরুরি অবস্থা ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থায় এ গণহত্যা নজিরবিহীন এবং হয়তো বিশ্বে এটাই একমাত্র ঘটনা। ০৫. আওয়ামী লীগের কাঁধে এখন নাস্তিক্যবাদী বামপন্থীরা। আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বলতে এখন বামদের বোঝায় এবং মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণও অনেকখানি তাদের হাতে। জামায়াত-শিবির ও হেফাজতে ইসলামের বিরোধিতা করতে যেয়ে তারা চরম সীমালঙ্ঘন করে ফেলে এবং নানাভাবে ইসলামেরই বিরোধিতা করে। নাস্তিক ব্লগারদের চরম ধর্মবিদ্বেষী আচরণের প্রতিবাদে ইসলামপ্রিয় জনগণ ফুঁসে উঠলে সরকার নাস্তিকদেরই পক্ষাবলম্বন করে। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ মাসের পর মাস সরকারের প্রশ্রয়ে চলে আসছে সেখানে হেফাজতের নিরীহ আলেম-ওলামা ও মাদরাসা ছাত্রদের একটি রাতও কাটানোর সুযোগ না নিয়ে নির্মমভাবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াকে জনগণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি এবং সে রাতে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়াতে সরকারের কোনো কথায় ধর্মপ্রাণ মানুষ আর বিশ্বাস করতে পারছে না। ০৬. শেয়ারমার্কেট, পদ্মা সেতু, ডেসটিনি, হলমার্ক, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্টসহ সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এর সাথে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের দখল ও টেন্ডারবাজিতে জনগণ ত্যক্ত-বিরক্ত। ০৭. প্রশাসনসহ সর্বস্তরে দলীয়করণের ফলে দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন করতে যেয়ে সীমাহীন বাড়াবাড়ি বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের চরম দমন-পীড়ন জনগণকে বেশি ক্ষুব্ধ করেছে। বিরোধী দলের অফিস থেকে একযোগে ১৫৪ জন নেতৃবৃন্দকে আটক, ডাণ্ডাবেড়ি পরানো, রিমান্ডে চরম নিপীড়ন দেশ-বিদেশে সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করার সাথে সাথে জনগণও চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছে। ০৮. গণতন্ত্রে বিরোধী দলের উপস্থিতি অপরিহার্য। কিন্তু বিরোধী দলকে শত্রু বিবেচনা করে তাদের ন্যূনতম অধিকারও স্বীকার করা হয়নি। তাদের সভা-সমাবেশে বাধা, মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি, জুলুম-নির্যাতন বিশেষ করে জামায়াত-শিবির একটি বৈধ দল হওয়া সত্ত্বেও তাদের সাথে একটি নিষিদ্ধ দলের মতো আচরণ করে তাদের অফিসসহ সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং কেন্দ্র, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব নেতা হয় জেলে অথবা আত্মগোপনে রয়েছেন। কে সন্ত্রাসী আর কে নয়, জনগণ তা ভালো করেই জানে। মিডিয়ার এত বিরূপ প্রচারণা এবং সরকারের চরম দমন-পীড়নের মধ্যেও জামায়াত স্থানীয় নির্বাচনে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো করছে। এতে জামায়াতের প্রতি জনগণের সহানুভূতি বেড়েছে বলেই প্রমাণ হচ্ছে। ০৯. নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাকে স্রেফ ঈর্ষা ও বিদ্বেষের ফল বলে জনগণ বিশ্বাস করে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট বিপুলসংখ্যক দরিদ্র ও নারীকর্মী কোনোভাবেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। একটি সফল ব্যাংককে নিয়ে সরকারের এ ধরনের অনৈতিক আচরণ জনগণকে ক্ষুব্ধই করেছে। ১০. বিচর বিভাগ, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বক্ষেত্রে মেধার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়ায় যোগ্যরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন সাথে সাথে সর্বস্তরে ক্ষোভও বাড়ছে। দলবাজেরা দলীয় আনুগত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে প্রায়ই বাড়াবাড়ি করে থাকেন। ১১. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ নাগরিকদের গুম করার ঘটনা দেশে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিএনপির চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মী এবং ছাত্রশিবিরের আটজন নেতাকে গুম করার পরিপ্রক্ষিতে দেশে বেশ আন্দোলন-সংগ্রাম ও হরতালের মতো কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার নির্বিকার। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সুযোগ মতো ঠিকই জনগণ জবাব দিয়েছে। ১২. সরকারের শেষ মুহূর্তে মিডিয়া দলন জনগণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। মাহমুদুর রহমান তার সাহসী কলমের জন্য জনগণের বিরাট অংশের কাছে জাতীয় বীরের মর্যাদা লাভ করেছেন। দিগন্ত টেলিভিশন ও ইসলামিক টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়াতে সরকারের প্রতি ক্ষোভে-দুঃখে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ টেলিভিশন দেখাই ছেড়ে দিয়েছেন। রমজান মাস। ধর্মপ্রাণ মানুষ এ দু’টি টেলিভিশনে পবিত্র মাসে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। এ দু’টি টিভি বন্ধ করে দেয়াকে সরকারের চরম ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব বলে ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বাস করেন এবং আরো বিশ্বাস করেন যে, বর্তমান তথ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় দু’টি টিভি চ্যানেল ও আমার দেশ পত্রিকা পুনঃপ্রচার সম্ভব নয়। পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের সাথে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক সমাজের এক বিরাট অংশ তাদের রুটি-রুজির জন্য প্রেস কাবে প্রতিনিয়ত আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, যা প্রচারমাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি কাড়ছে। ব্যালটকেই মানুষ ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। ১৪ দলীয় জোটের পরাজয় নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের অনাস্থা স্বীকার করে নিয়ে ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আগামী নির্বাচনে ভালো করার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। সরকার কি পারবে গণদাবিতে পরিণত কেয়ারটেকার দাবি মেনে নিয়ে বিরোধী দলের সাথে সমঝোতা করতে এবং ইসলামপন্থীদের আস্থায় আনতে বিচার বিচার খেলা বন্ধ করতে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads