বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৩

বাস্তিল দুর্গের পতন কী অত্যাসন্ন?


অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বেলারুশ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। তার সফর নাকি আরও একটু দীর্ঘ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নবগঠিত গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের কারণে তিনি বোধ হয় কিছুটা হলেও সফরসূচী সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরেছেন। বিমানবন্দরে তিনি মন্ত্রীদের এই বলে ভর্ৎসনা করে বলেছেন যে, ‘কী হারু পার্টি আপনারা কেমন আছেন? বিমানমন্ত্রী ফারুক খান (কম খান ) ও নাকি নেত্রীর তোপের হাত থেকে রক্ষা পাননি। নেত্রী নাকি বিমানের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে তাকেও ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘আপনি কি করেন?’ সেখানে পাদুকা খানের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, কোন মন্ত্রী  আবার মুখ ফসকে বলে ফেলেননি যে, হে মহান হারু নেত্রী আপনি ভাল আছেন তো? কারণ, হারু পার্টির সর্বাধিনায়ক বলে কথা !!
গত ১৫ জুন দেশের ৪ টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। খুলনা, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশালে সরকারি দলের প্রার্থীরা বিরোধী দলীয় প্রার্র্থীদের কাছে গোহারা হেরেছেন। সেসময় অবশ্য প্রধানমন্ত্রী দেশেই ছিলেন। সেই নির্বাচনের পরাজয়ের ব্যাপারে তিনি নিজেই মুল্যায়ন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় তারা নির্বাচনে হারলেও এ নির্বাচনে সরকার ও গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্য হবুচন্দ্রীয় মন্তব্য না বলে কোন উপায় আছে? কারণ, রাজা হবুচন্দ্র একবার ঘোষণা করেছিলেন যে, তার রাজ্যে কোন দ্রব্যের মূল্য দু’ধরনের হতে পারবে না। সে মতে ধান ও চালের মূল্য বরাবর একই থাকতে হবে। তিনি রাজ্যের দ্রব্যমূল্য দেখভাল করার জন্য খোদ প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। দিন শেষে যখন তিনি রাজার কাছে রাজ্যের বাজার দরের হালহকিত পেশ করতেন তখন মন্ত্রীবর অবলীলায় বলতেন ‘পানীয় জল, দুধ আর  ঘিয়ের মূল্য সমান আছে মহারাজ’! রাজা তার আলুলায়িত গোঁফে হাত বুলিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলতেন তথাস্ত মন্ত্রীবর, তথাস্ত !!
প্রধানমন্ত্রীকে বোধ হয় সেই হবুচন্দ্রীয় রোগই পেয়ে বসেছে বলেই মনে হয়। তাই নির্বাচনে তারা বিজয়ী না বিজিত হয়েছেন তা ঠাহর করতে পারছেন না। তাই দেশের ৪টি সিটি নির্বাচনে আমছালা সব হারানোর পর প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে কি আত্মতৃপ্তির ঢেকুর! হেরে যাওয়ার পরও নাকি সরকারের বিজয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের মর্মার্থ এমনই দাঁড়ায় যে যারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন তারা অবশ্যই পরাজিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বোধ হয় বোঝাতে চেয়েছেন একটা নির্বাচন হওয়ার দরকার ছিল তা হয়েছে। আর যে তিনি দয়াপরবশ হয়ে নির্বাচন দিয়েছেন এটাই বড় কথা। কারণ, নির্বাচনই তার সবচেয়ে বড় ভয়। অবশ্য এ দাবিটা একেবারে অনুমান নির্ভর নয় বরং খোদ প্রধানমন্ত্রীই বলেছিলেন, বিরোধী দল কেয়ারটেকার চাইলে দেশে কোন নির্বাচনই হবে না।
প্রজাদের প্রতি রাজা হবুচন্দ্রের আরেকটি ফরমান ছিল যে, তার রাজ্যে কেউই কাঁদতে পারবে না। কারো জীবনে যতই বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটুক না কেন! এমন কি পিতা-মাতার মত ঘনিষ্ঠজনের প্রয়াণ ঘটলেও সন্তানদের অবলীলায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে হবে। তার রাজ্যে বিষাদের কোন স্থান নেই বরং শুধু  থাকবে হর্ষ আর হর্ষ! তাই রাজার ফরমান জারীর পর দেখা গেছে পাঠশালায় পন্ডিত মশায়ের বেদম প্রহার খেয়ে শিষ্যরা অবলীলায় হেসেছে। বুড়ো-বুড়ি হাতাহাতি আর চুলোচুলি করলেও এক অজানা কষ্ট চাপিয়ে রেখে বাধ্য হয়েই তাদেরকে হাসতে হয়েছে। মাগী-মিনসে মিলে লংকাকা- ঘটালেও বক্রমুখেও হা হা করতে হয়েছে। দুর্জধনের  বস্ত্র হরণের পরও তাকে নগ্নদেহে নর্তন-কুর্দন করতে দেখা গেছে। হবুচন্দ্রের রাজ্য বলে কথা!
ব্যাপারটা যদি এখানেই শেষ হতো তাহলে অবশ্য আমাদের বলার কিছু ছিল না। কিন্তু হালে আমাদের দেশের পালেও হাওয়া লেগেছে সে হবুচন্দ্রীয় শাসনের। সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, হত্যা, গুম, নৈরাজ্য, গণগ্রেফতার এমন কি নির্বিচারে গণহত্যার মত ঘটনা ঘটলেও শেখ হাসিনার ফরমানমত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তো দূরের কথা বরং আর্তনাদ-আহাজারী করারও সুযোগ নেই। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত, মেস-ছাত্রাবাস ও রাস্তা-ঘাট থেকে আস্ত মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে লম্বা করা হচ্ছে। কিন্তু ভিকটিম বা তার নিকটাত্মীয়দের কাঁদারও অধিকার দেয়া হচ্ছে না। নিরীহ পথচারীকে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে প্রজনন ক্ষমতাহীন করে ফেলা হয়েছে কিন্তু ভিকটিম অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করার তো সুযোগ পাননি বরং তিনি দীর্ঘ তিন বছর জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সরকার তো বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে গরু-ছাগলের মত আচরণ করছে। আর জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী হলে তো কোন কথাই নেই। সরকার তাদের শীর্ষ নেতাদের ধরে ধরে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেবে, নেতাকর্মীদের পুলিশী হেফাজতে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে ডা-াবেড়ি পরানো হবে কিন্তু তারা প্রতিবাদ তো দূরের কথা ঘরের মধ্যে কাঁদলেও কথিত গোপন বৈঠকের নামে নির্মম নির্যাতন চালানো হবে। শিবির সভাপতি দেলাওয়ার হোসেনকে তো তারা পিটিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে। তারপরও কারো কাঁদার অধিকার নেই। আর কেউ যদি কাকতালীয়ভাবে কেঁদেই ফেলে তাহলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তথা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে শুধু তার বিচারই করা হবে না বরং সবার আগে তার হাড্ডি-গুড্ডী গুড়ো করার আয়োজন করা হবে। কারণ, আওয়ামী রাজ্য বলে কথা!
দেশের ৪টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের হেরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী এ পরাজয়কে সরকার ও গণতন্ত্রের বিজয় বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বোধ হয় তার বা তার সরকারের অনেকটা টনক নড়েছে বলেই দৃশ্যত মনে হচ্ছে। কারণ, তারা এ নির্বাচনে কোনভাবেই হেরে যেতে চায়নি বরং যেকোন মূল্যে জেতার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল। প্রবাসের এক খয়ের খাঁ তো গাজীপুর নির্বাচনকে স্ট্যালিনগ্রাদের সাথে তুলনা করে এ নির্বাচনে সরকারের ঘুরে দাঁড়ানোর আগাম পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মানবাহিনী একের পর এক সোভিয়েত এলাকা দখলের পর পর স্ট্যালিনগ্রাদে এসে লালফৌজের প্রবল ও পরাক্রমী প্রতিরোধের মুখে পড়ে। সাড়ে পাঁচ মাস অবরুদ্ধ থাকার পর নাৎসীবাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়। এতে তাদের আনুমানিক ৮ লাখ সৈন্য প্রাণ হারায়। স্ট্যালিনগ্রাদের মহাবীরত্বপূর্ণ সোভিয়েত প্রতিরোধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আওয়ামী লীগও মনে করেছিল যে, গাজীপুর সিটিকে যেকোন মূল্যে করায়ত্বে রাখতে পারলে তা স্ট্যালিনগ্রাদের মহাবিজয়ের সমতুল্য হবে। কিন্তু সরকারের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে ভোটাররা। তাই তারা আগের পরাজয়কে দৃশ্যত স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলেও গাজীপুর পরাজয়ের পর সরকারের গো-হারানোর অবস্থা বলেই মনে হচ্ছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে গো-খোয়া গেলে নাকি ব্যক্তি বিশেষে প্রলাপ বকতে থাকে। গাজীপুর নির্বাচনে পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী যে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন তাতে তাই মনে হয়েছে। তিনি পরাজয়ের নতুন মূল্যায়ন জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী  গত ১৩ জুলাই গণভবনে এক অনুষ্ঠানে নির্বাচনে পরাজয় সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা রীতিমত আঁৎকে ওঠার মত। সে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের একটা ক্যান্ডিডেটের বিরুদ্ধে তো কেউ কোন দিন দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। যারা দুর্নীতি করেনি, যারা ক্লিন ইমেজের, তারা জিততে পারেননি’। তিনি বলেছেন, তাহলে আমরা এই উন্নয়ন কেন করছি? কার জন্য করছি? যদি দুর্নীতিবাজরাই জিতে আসে তাহলে এই জেতার রহস্য কি?
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের মাধ্যমে জনগণকে সরকারের প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে এবং গণরায়ের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়েছে। দেশের মানুষ যাকে প্রার্থীদের মধ্যে যোগ্য মনে করেছে তাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। তিনি নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীকে দুর্নীতিমুক্ত ও ক্লীন ইমেজের বলে দাবি করেছেন কিন্তু দেশের মানুষ তাদের মনোনীত প্রার্থীকে সেরকম মনে করেনি। যদি করতো তাহলে অবশ্যই তাদেরকে নির্বাচিত করতেন। প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে দলীয় নেতাদের সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ও জনগণের মূল্যায়ন এক নয়। কারণ, দই কিন্তু গয়লার কাছে কখনোই টক হয় না। বিষয়টি ভোক্তাদেরই পরখ করে দেখতে হয়। তাই জনগণ তাদের দলের নেতাদের পরখ করে যা পেয়েছে, সেমতে সিদ্ধান্তও নিয়েছে তারা ব্যালটের মাধ্যমে।
তিনি তার বক্তব্যে খেদোক্তি করে বলেছেন,‘ শোনলাম জাতীয় ইস্যুর জন্য হেরে গেছি। জাতীয় ইস্যু কি? আমরা খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারছি কি না? জাতীয় ইস্যুর জন্যই যদি হারবো; তাহলে, আমার প্রশ্ন জাতীয় ইস্যু হয়ে গেল দুর্নীতি? আমাদের সরকার নাকি দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতি করে তো এতো উন্নয়ন সম্ভব নয়’।
 একথা সর্বজনবিদিত যে, সিটি নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা হেরেছেন জাতীয় ইস্যুতেই। সরকারি দলের প্রার্থীদের সুনাম, সুখ্যাতি বা ক্লিন ইমেজ নির্বাচনে কোন গুরুত্ব পায়নি। জনগণ যাকে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থী মনে করেছে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার বিরুদ্ধেই অবস্থান গ্রহণ করেছে। তাকে তারা শুধু ভোট দান থেকে বিরত থেকেই ক্ষান্ত হয়নি বরং যার যে ধরনের সামর্থ আছে তা নিয়ে আওয়ামী সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজিত করার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেসব বিষয়কে জাতীয় ইস্যু হিসাবে চিত্রিত করেছেন এবং সেসব বিষয়ে বায়বীয় সাফল্য দাবি করেছেন। দেশের মানুষ তার সাথে একমত নয়। এখানেই সরকারের সাথে জনগণের চিন্তা-চেতনার পার্থক্য। এই তফাৎটাই সরকারকে গণবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। যার মাসুল দিতে হয়েছে সদ্য সমাপ্ত সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি করেছেন। কিন্তু দেশের উন্নয়ন তো মূলত প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মন্ত্রীদের বক্তব্যের ফুলঝুড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ। দেশের মানুষ তো অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সরকারের উন্নয়নের কোন খোঁজ-খবর পান না। আর প্রধানমন্ত্রীর ন্যূনতম যদি কোন সৌজন্য বোধ থাকতো তাহলে তো অন্তত দুর্নীতির কথা মুখে আনতেন না। কারণ, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির কথা শুধু দেশে নয় বরং বহির্বিশ্বেও আমাদের মাথাকে নিচু করে দিয়েছে। এ মহাকেলেঙ্কারির সাথে সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাসহ রাঘব-বোয়ালরা জড়িত হলেও প্রধানমন্ত্রী অভিযুক্তদের দেশপ্রেমিক হিসাবে সাফাই গেয়েছেন। দুদকের কাছেও ক্লিন ইমেজ সার্টিফিকেট আদায় করা হয়েছে। কিন্তু হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বসংস্থা সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনেছে। আর সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তো পদ্মা সেতু না হওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীকেই দায়ী করেছে।
এ সরকারের আমলেই দেশের সর্ববৃহৎ শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। দেশের শেয়ার মার্কেট থেকে লক্ষকোটি টাকা লোপাট করেছে সরকারি দলের রাঘব বোয়ালরা। এতে প্রায় ৩৫ লাখ বিনিয়োগকারী সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পুঁজি হারিয়ে আমানতকারীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে অর্থমন্ত্রী তাদের ফটকাবাজ বলে গালমন্দও করেছেন। অথচ সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির ব্যাপারে এই সরকারি দলের লোকজনকেই দায়ী করেছে। প্রধানমন্ত্রী হল-মার্ক ও ডেসটিনি কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ এনেছেন। কিন্তু হল-মার্কের কেলেংকারী নিয়ে তো অর্থমন্ত্রী রীতিমত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে বলেছিলেন ৪ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি নাকি তেমন কিছুই না। তিনি খোয়া যাওয়া টাকা উদ্ধারের পরিবর্তে হল-মার্ককে আরও ঋণদেয়ারও প্রস্তাব করেছিলেন। আর ডেসটিনি ইস্যুতো শূন্যে মিলিয়ে গেছে। কেন গেছে তা এখন রহস্য হয়েই আছে।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে শুধুমাত্র দুর্নীতি কেন্দ্রীকই করে ফেলেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের বিগত সাড়ে চার বছরের শাসনামলে অপশাসন, দুঃশাসন, নিষ্ঠুরভাবে বিরোধী দল দমন, অতিমাত্রায় ভারতপ্রেমী পররাষ্ট্রনীতি, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং অতিমাত্রায় ধর্ম ও ধর্মীয় মুল্যবোধ বিদ্বেষের কারণে যে মারাত্মকভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে একথা হয়তো সরকার বা সরকার প্রধানের উপলব্ধিতে নেই অথবা থাকলে তা স্বীকার করার মত সৎসাহস নেই। সরকার হয়তো মনে করেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধুয়া তুলে কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে প্রহসন করে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলাতে পারলেই সরকারের জনপ্রিয়তার জোয়ার উঠবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। সরকার ফাঁসি ফাঁসি খেলতে গিয়ে নিজেদেরকেই ফাঁসিয়েছে। তারা মনে করেছিল যে, হেফাজতী মোল্লাদের ডা-া মেরে ঠা-া করতে পারলেই দেশকে রামরাজ্যে পরিণত করা সম্ভব হবে। কিন্তু এতেও তারা সফল হয়নি বরং জনগণ সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনে সরকারের প্রতি যে বার্তা পাঠিয়েছে তাতে দেখা গেছে সরকার জামায়াতের মুখোমুখী না হওয়ার সনাতনী অবস্থান থেকে সরে এসে গওহর রিজভীর মাধ্যমে জামায়াত নেতাদের সাথে বৈঠকে বসতে বাধ্য হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে যে, আগামী নির্বাচনে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হেফাজতে ইসলামের মত অরাজনৈতিক সংগঠনকে সংসদের ৫০ আসন ছেড়ে দিয়ে জোট গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে সরকারের নৈতিক ও আদর্শিক পরাজয় ঘটেছে বলেই মনে হয়। এখন অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার জামায়াতের সাথেও নির্বাচনী সমঝোতা করতেও প্রস্তুত আছে।
মূলত গণবিরোধিতায় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন। তাদের মতে জনগণকে তাদের জন্য সবকিছুই করতে হবে। কিন্তু তারা জনগণের জন্য কিছুই করবে না। দেশে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দেয়া হলেও আওয়ামী শাসনামলে সুশাসন ও ন্যায়বিচার সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আওয়ামী শাসনে যে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন থাকে না তা মরহুম শেখ মুজিবের ভাগিনা যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বক্তব্য থেকে পরিষ্কার। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আইনের শাসন চাইনা, আমরা বঙ্গবন্ধুর শাসন চাই’। যে আদালতের রায়ের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশে এক মারাত্ম্ক রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে সে আদালত সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘লোয়ার কোর্ট বলেন, হাইকোর্ট বলেন-আজ খুনীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হলো কোর্ট। যখনী তারা কোর্টে যাচ্ছে, জামিন হয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, যে উকিল তার জন্য জামিন চাচ্ছে সে উকিলকেও ধরা উচিত, যে কোর্ট জামিন দিচ্ছে তারও জবাবদিহি করা উচিত’। তিনি অতিসম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পর্কে বলেছেন, ‘শুধু আইন নয় জনমত দেখে বিচার করতে হবে’।
প্রায় সোয়া দু’শ বছর আগে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসের উপকন্ঠে বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটেছিল। অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য মুক্তিকামী মানুষেরা ওই দুর্গে হামলা চালায়। সেখানে হতাহতের ঘটনা খুব একটা ঘটেনি। সেখান থেকে মাত্র ৭ জন বন্দীকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এর তাৎপর্য ছিল বিশাল। এর মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন হয়। মূলত সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে তাদের দুর্গেরও বেহাল অবস্থা হয়েছে। ফলে তারা এখন সব কিছুকেই তাদের প্রতিপক্ষ মনে করছে। এমন কি দেশের মানুষও তাদের তোপের মুখ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে ধোয়া তুলসী পাতা মনে করলেও তাদের সম্পর্কে দেশের মানুষের একটা আলাদা মুল্যায়ন আছে। আর তারা সে মূল্যায়নের ভিত্তিতেই অতীতে আওয়ামী লীগের  সাথে যে আচরণ করেছে, এখনও করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। আর প্রধানমন্ত্রী যতই জনগণ সম্পর্কে বেফাঁস মন্তব্য করবেন ততই বাস্তিল দুর্গের পতনও ত্বরান্বিত হবে। তা কেউ ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads