এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মা সেতুর দরপত্র মূল্যায়নে বাংলাদেশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরানুযায়ী গত ৪ঠা জুলাই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালক জুয়ান মিরান্ডার ঢাকা সফরকালে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়ায় সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের ব্যাপারে এডিবি’র অবস্থান প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দরপত্র মূল্যায়নে এডিবি’র অস্বীকৃতির কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, প্রস্তাবিত সেতুর দরপত্র মূল্যায়ন বাংলাদেশ সরকারকেই করতে হবে এবং এ ব্যাপারে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কোনও প্রকার সহায়তা করতে অপারগ। উল্লেখ্য যে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের দফতরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
বলা বাহুল্য, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি পদ্মা সেতু প্রকল্পের চারটি প্রাক-যোগ্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূল সেতুর দরপত্র আহ্বান করছে এবং এ সংক্রান্ত কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব পেশ করার জন্য তাদের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে। এর আগে গত এপ্রিল মাসে অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন যে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পের দরপত্র মূল্যায়নে রাজি হচ্ছে। অবশ্য ৪ঠা জুন তার উপরোক্ত তথ্যের ভিত্তি সম্পর্কে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি তার জবাব এড়িয়ে যান এবং বলেন যে, এ ব্যাপারে সম্ভাব্য বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তিনি কারুর নাম উল্লেখ করতে চান না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে এই সেতু নির্মাণে এবং এ সংক্রান্ত দরপত্র প্রস্তাব মূল্যায়নের বিস্তারিত বিবরণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে তিনি জানান। পদ্মা সেতু প্রকল্পটি নিয়ে শুরু থেকেই এই সরকার দেশ-বিদেশে যেসব কেলেঙ্কারির সাথে জড়িয়ে পড়েছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই কলংক এবং দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নন কতিপয় শর্ত পূরণ সাপেক্ষে ২০১২ সালে প্রথমে বাংলাদেশ সরকারের সাথে তাদের সম্পাদিত অর্থায়ন চুক্তি স্থগিত করে এবং শর্তপূরণ করার জন্য সময় বেঁধে দেয়। এ শর্তাবলীর মধ্যে সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এবং মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের দুর্নীতির তদন্ত এবং তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকার বিশ্বব্যাংকের শর্তাবলী মেনে নিয়েও তা কার্যকর না করায় বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন চুক্তি বাতিল করে দেয় এবং তার সাথে সাথে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাইকাও অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। সরকার দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করায় সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হয় এবং সরকার ও তার দুর্নীতিপ্রীতির জন্য নিন্দিত হন। এক পর্যায়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন এবং তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে চাঁদা গ্রহণও শুরু করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পদ্মা সেতুর জন্য চাঁদা সংগ্রহ করে নিজেদের মধ্যে তা ভাগাভাগি করতে গিয়ে আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং দুই পক্ষের সশস্ত্র সংঘর্ষে এক ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়। দেশের আরো বেশ কিছু স্থানে এ ধরনের চাঁদাবাজি ও তা আত্মসাতের ঘটনা দেশবাসীর সামনে এটা পরিষ্কার করে দেয় যে, প্রকৃতপক্ষে সেতু নির্মাণ নয়, সেতু প্রকল্পের ন্যায় বৃহৎ ও ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে অর্থ আত্মসাৎই সরকারের উদ্দেশ্য। কিন্তু এরপরও সরকার নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিতর্কিত পদ্ধতিতে নির্ণীত প্রাক-যোগ্যতাসম্পন্ন চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করেছেন। যে ঠিকাদারদের নির্বাচনে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ায় বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করেছে, তাদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বানের বিষয়টিকে আমরা অনৈতিক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অসদাচরণ বলে মনে করি। দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ এবং প্রকৌশলীরা পদ্মা সেতুর ন্যায় একটি বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সরকারের সামর্থ্য নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন যে, সেতু নির্মাণই বড় কথা নয়, তা যথাযথ মান ও স্পেসিফিকেশন বজায় রাখাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ কাজে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা নেই। শুধু তাই নয়, টেন্ডার ডকুমেন্ট বিশেষ করে তার কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়ন করার মতো বিশেষজ্ঞও বাংলাদেশ সরকারের কাছে নেই। তাদের এই মন্তব্যের সাথে আমরা একমত। অর্থমন্ত্রী জনাব মুহিত এপ্রিল মাসে দরপত্র মূল্যায়নে এডিবি’র সহযোগিতার কথা বলে এক্ষেত্রে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করেছেন বলেই মনে হয়। এডিবি’র দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মহাপরিচালক দরপত্র মূল্যায়নে তার সংস্থার অপারগতার যে কথা বলেছেন তা আমাদের অর্থমন্ত্রীর কথাবার্তার বিশ্বাসযোগ্যতাকেই ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে হয়। এটা দায়িত্বশীল ব্যক্তির দায়িত্বহীন আচরণ এবং বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সিনিয়র একজন মন্ত্রীর জন্য তা শোভনীয় হতে পারে না। যে সরকারের একটা দরপত্র মূল্যায়নের সামর্থ্য নেই সেই সরকার রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য সেতু নির্মাণে অগ্রসর না হওয়াই শ্রেয় বলে আমরা মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন