বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৩

পাঙ্গাশের মগজ আর তেঁতুলের গুল আমাদের সর্বনাশার মূল


মেয়েদের মগজের ওজন একটা পাঙ্গাশ মাছের মগজের ওজনের কাছাকাছি। নিজের স্টাইলে হিউমার ছড়িয়ে এই ধরনের একটি তথ্য জানিয়েছিলেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার কোনো একটি উপন্যাসে। তার পরও মেয়েদের কাছে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি; বরং বলা যায় একপর্যায়ে এই মেয়েরাই হুমায়ূন আহমেদকে তার জনপ্রিয়তার বর্তমান উচ্চতায় ঠেলে দেন। বেশি ওজনওয়ালা মগজের গুরুগম্ভীর পুরুষগণও তার এই শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কাজেই তেঁতুলতত্ত্বটি মাওলানা শফীর মতো কোনো পুরুষ না বলে হুমায়ূন আহমেদের মতো কোনো পুরুষ কায়দা করে কোথাও লিখে দিলে মনে হয় কোনো সমস্যা হতো না। কারণ আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক সার্ভে থেকে মাওলানা শফীর তেঁতুলতত্ত্বের অনুরূপ কিছু সিদ্ধান্ত বেরিয়ে এসেছে। তা ছাড়া মৌলবাদী, যৌগবাদী উভয় কিসিমের পুরুষদের সম্পর্কে এই ধরনের কথা এ দেশের চরম বিতর্কিত এক লেখিকা উঠতে-বসতে বলেছেন। তাই মাওলানা শফীর তেঁতুলতত্ত্বকে বেশ আগ্রহভরেই সমর্থন জানিয়েছেন সেই নারীবাদী লেখিকা। মাওলানা শফী, নারীবাদী লেখিকা কিংবা আমেরিকান সার্ভে একই ধরনের কথা বললেও আওয়ামী শিবিরে এর মাত্রাধিক প্রতিক্রিয়া অনেককেই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। মেয়েদের সম্পর্কে এই ধরনের তুলনায় রুচিশীল কোনো মানুষ স্বস্তি বোধ করে না। এই ধরনের তুলনা ধর্মীয় হেদায়াতের নামে হোক কিংবা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা বা লালনের নামে হোক, দু’টিই কর্ণকুহরে সম ধরনের বেদনা সৃষ্টি করার কথা। তবে জাতির জন্য বিপদ কিংবা আপদটি এখান থেকেই শুরু। আমাদের লোকসাহিত্য ও বাণিজ্যিক সিনেমায় এই ধরনের চরম অবমাননাকর তুলনা ও মন্তব্য অজস্র্র রয়েছে। ‘নারীসমাজের ভোকাল অংশ এগুলো নিয়ে কখনো আপত্তি উঠাননি। কারণ তেঁতুলের চেয়েও টক ও ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর তুলনা রয়েছে, যা লিখলে রোজা রমজানের দিনে অনেকের রোজা হুমকিতে পড়ে যেতে পারে। কাজেই মাওলানা শফীর তেঁতুলতত্ত্বটি নিয়ে যতটুকু রাগা উচিত ছিল আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী ঘরানার নারীসমাজের তার চেয়েও অনেক বেশি রেগে গেছেন। কারণ হেফাজতে ইসলাম যদি আওয়ামী লীগের পঞ্চাশ সিটের সমঝোতা প্রস্তাবটি মেনে নিত তবে মাওলানা শফীর এই তেঁতুলতত্ত্ব কিংবা হেফাজতের তেরো দফা দাবির কোনোটিই এতটুকু টক টক লাগত না। হেফাজতের সাথে কাঁধে কাঁধ মেলানোর জন্য মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ শাসনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কাজেই এখন এই তেঁতুলতত্ত্বটি নিয়ে এত সমালোচনা, এত উপসম্পাদকীয় বেরিয়ে আসার কারণটি সহজেই অনুমেয়। তেঁতুলতত্ত্বটি নিয়ে সবচেয়ে নোংরা মন্তব্যটি এসেছে বরাবরের মতোই প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে। বর্তমান আওয়ামী লীগকে নিয়ে সবচেয়ে বেকায়দার বিষয়টি হলো, তারা যেভাবে কারো প্রতি ভালোবাসার কথা বলবে, কারো প্রতি যে ভঙ্গিতে ঘৃণা প্রকাশ করবে, কারো প্রতি মুখ ভ্যাঙচাবে সারা দেশ ও জাতিকে হুবহু সেভাবেই করতে হবে। তেঁতুলতত্ত্ব নিয়ে তাদের ফ্রিকোয়েন্সিতে হইচই না করায় বিরোধীদলীয় নেত্রীকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাওলানা শফীর তেঁতুল বানিয়ে ফেলেছেন। এই প্রধানমন্ত্রীই আবার বিরোধীদলীয় নারী সংসদ সদস্যদের ‘অশ্লীল’ মন্তব্য নিয়ে ‘ছি-ছি-ছি’ উচ্চারণ করেছেন। নিজের দলীয় সংসদ সদস্য কিংবা নিজের কথার অশ্লীল অংশটুকু তার সেন্সরে অবশ্য ধরা পড়েনি। এ ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়ার একটুও দোষ নেই। রংপুর মেডিক্যালের ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ডা: ইমরান এইচ সরকারকে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু বানানোর প্রজেক্টের বাই প্রডাক্ট হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছেন মাওলানা শফী। এই কৃতিত্বের পুরোটাই আওয়ামী লীগের হাইব্রিড ও লালব্রিড নেতৃত্বের। চিকনা বুদ্ধির হাইব্রিড নেতৃত্ব ভাবছেন এই কৌশলে হেফাজতকে ধরাশায়ী করে ফেলবে। কিন্তু কতটুকু ওপরে তুলবেন তা ঠাহর করতে পারছেন না। আসল কথাটি হলো, সব ক্ষেত্রে আমাদের মগজে পচন ধরেছে। তবে কিছুটা স্বস্তির কথা হলো, এত উসকানির পরেও বেগম খালেদা জিয়া তার স্বভাবসুলভ সংযম ও নীরবতা বজায় রেখেছেন। এই নীরবতার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর শুধু চূড়ান্ত বিজয়ই অর্জন করেননি, নারীসমাজকেও জনমের তরে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এটা নিয়ে বেগম জিয়ার মুখ থেকে যেকোনো জবাব নারীসমাজের জন্য চরম অবমাননাকর হতো। হুমায়ূন আহমেদ ঠাট্টার ছলে যে কথাটি উল্লেখ করেছিলেন তা আরো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যেত। যে মরাল ব্রিগেড মাওলানা শফীর কথাটি স্মরণ হওয়া মাত্রই ‘ছি-ছি-ছি’ উচ্চারণ করছেন তাদের কানেও এক ভদ্রমহিলা সম্পর্কে অন্য ভদ্রমহিলার এই কুৎসিত ইঙ্গিতটি খারাপ লাগছে না। হায়রে সেলুকাস ! কী বিচিত্র এই সেন্সর! আরো বিচিত্র নারীর প্রতি এদের দরদ। সামান্য এই তেঁতুলতত্ত্ব দেখিয়ে দিয়েছে যে আমরা কেমন ভয়ঙ্করভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। বিষয়টি একান্তই নারী-পুরুষের রসায়ন হলেও বিভাজনটি নারী-পুরুষের বিভেদ রেখা বরাবর সৃষ্টি হয়নি; বরং বিভাজনটি রাজনৈতিক ত্রুটিরেখা বরাবর হয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত একটি দল এখন ‘তেঁতুলতত্ত্বে’ মারাত্মকভাবে অবিশ্বাসী বা রীতিমতো অ্যালার্জিক হয়ে পড়েছেন। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ভের কথা শুনিয়েও তাদের এই অ্যালার্জিটি একটুও কমানো যাচেছ না। কাজেই তেঁতুলতত্ত্ব মুখে লালা নয়, মাথায় অনেক প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেই সব প্রশ্নের জবাব কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কি আসলেই টের পাচ্ছি যে এই মানসিকতা আমাদেরকে কোন সর্বনাশা বিভাজনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে? বিভিন্ন চেতনার আড়ালে, সংস্কৃতির ক্যাপসুলে কিংবা ধর্মীয় ভাবনার আড়ালে একটা মারাত্মক বিষ আমরা পান করে চলেছি। এক ভয়ঙ্কর গাড়িতে আমরা চড়ে বসেছি, যার কোনো ব্রেক কাজ করছে না। জানি না কারা এই বিভাজনটিতে ইন্ধন জোগাচ্ছে? আমাদের রাজনীতি, আমাদের সাহিত্য, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের বোধ, আমাদের ভাবনা কাদের ঘৃণা, কাদের ক্ষোভ বহন করছে ? এই ক্ষোভ, এই ঘৃণা এত তীব্র কেন ? তখন হংকংয়ের একটি জাহাজে সেইল করছি। জাহাজটিতে আমি ছাড়া বাদবাকি ক্রু ও অফিসারদের সবাই ছিলেন ইন্ডিয়ান। তার মধ্যে ক্যাপটেনই ছিলেন কলকাতার বাঙালি। চিফ কুকও ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের। বিদেশী জাহাজে বাঙালি কুক খুব কম পেয়েছি। কাজেই আমরা উভয় বাংলার বাঙালিরা যারপরনাই উৎফুল্ল। কিন্তু ইন্ডিয়ার অন্যান্য রাজ্যের অফিসার ও ক্রুরা সম পরিমাণে নাখোশ হয়ে পড়েছেন। চিফ কুকের বিরুদ্ধে বারবার এই রকম অভিযোগ পেয়ে ক্যাপটেন বেশ কাতর হয়ে পড়তেন। জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং বাঙালি হিসেবে আমার সাথে তার এই হতাশা শেয়ার করতেন। তার বাস্তব উপলব্ধিটি ছিলÑ ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং ইন্ডিয়ান জাহাজের চিফ কুক; উভয়ের দশা হুবহু এক। তারা এক প্রদেশের মানুষকে খুশি করলে অন্য প্রদেশের মানুষ খেপে যায়। কাজেই বুঝতেই পারছেন, আলাদা হয়ে আপনারা বাংলাদেশীরা কতটুকু বাঁচা বেঁচে গেছেন। একই ধরনের কথা আমাকে বলেছেন আরেক সাউথ ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, আমি ছিলাম তখন তার সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। ভদ্রলোক ঐশ্বরিয়া রাইয়ের বাবার সাথে একই জাহাজে চাকরি করেছেন। একজন মানুষ বিখ্যাত হয়ে পড়লে আশপাশের কতজনকে কত ভাবেই না তার এই গর্বের অংশীদার করে ফেলে। ঐশ্বরিয়ার বাবা এক জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, তিনি ছিলেন থার্ড ইঞ্জিনিয়ার। পুতুলের মতো দেখতে ছোট্ট ঐশ্বরিয়াও বাবা-মায়ের সাথে সেই জাহাজটিতে সেইল করেছিলেন। এই ভদ্রলোক আলাপ প্রসঙ্গে একদিন জানান, সিঙ্গেল ইউনিটের ছোট্ট দেশটিকে এগিয়ে নেয়া তোমাদের জন্য কত না সহজ। আমাদের মতো বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশে তা সম্ভব নয়। কারণ কোনো পলিসি ইন্ডিয়ার এক অঞ্চলের জন্য উপযোগী মনে হলেও অন্য অঞ্চলের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ভাষার প্রাচীর, জাত-পাতের প্রাচীরসহ বহু সামাজিক ও ধর্মীয় ত্রুটিরেখা ইন্ডিয়াকে সত্যিই কাহিল করে রেখেছে। সব কিছু দেখে তার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল যে, আগামী বিশ-পঁচিশ বছরে ইন্ডিয়া আরো অনেক খণ্ডেবিখণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়বে। হিসাব করে দেখি, তার এই ভবিষ্যদ্বাণী থেকে আজ পনেরো-ষোলটি বছর পার হয়ে গেছে। বহু জাতিসত্তার দেশ ইন্ডিয়ার জন্য আজো তেমন কোনো হুমকি স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কিন্তু একক জাতিসত্তার যে দেশটি নিয়ে এত দিন স্বস্তিতে ছিলাম, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা অনেক খানি বেড়ে গেছে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নামে জঙ্গলের শাসন প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটি হলো আমাদের রাজনীতি। অনেক জ্ঞানীগুণী গলা কেটে গলাব্যথা কমানোর প্রেসক্রিপশন দিতে চান। মনে হয় তারাও কেন যেন সত্য কথাটি এড়িয়ে যেতে চান। জাতীয় মানসে আমাদের এই ধরনের দুর্বলতাগুলো নিয়ে লিখতে লিখতে সত্যিই কান্ত হয়ে পড়েছি। কাজেই এই চোখ খুঁজে বেড়ায় আমাদের শক্তি ও ভরসার জায়গাগুলো। কোথাও এই শক্তি ও ভরসার অস্তিত্ব টের পেলেই চোখটি ঝলসে ওঠে, মনটি পুলকিত হয়ে পড়ে। সেই শক্তির জায়গাগুলো পরিসরে অনেক ছোট হলেও তাকে তখন অনেক বড় করে দেখাতে ইচ্ছে হয়। এমনই একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বিজ্ঞ পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাচ্ছি। আশা করি খারাপ লাগবে না। গত ২৯ জুন সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুরের জুরং এলাকার ‘শেভরন-এর বলরুমে অনুষ্ঠিত হয় এ রকম একটি প্রীতিভোজ বা ডিনার পার্টি। আয়োজক সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশী মেরিনার্স কমিউনিটি। উপস্থিত সবাই বাংলাদেশী মেরিনার্স এবং তাদের পরিবারবর্গ। বাংলাদেশের বাইরে এত অধিকসংখ্যক মেরিনার্স পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে নেই। এখানে দিনাজপুরের এক সাগরবধূর সাথে পটুয়াখালী বা কক্সবাজারের সাগরবধূরা জলজ মিতালি পেতেছেন। আওয়ামী লীগের সমর্থকের সাথে বিএনপির সমর্থক লোনাপানির জুটি বেঁধে ফেলেছেন। বামপন্থী মানুষের সাথে ডানপন্থী ভাবনার মানুষগুলোও একই তালে বৈঠা বাইছেন। এখানে কারো অন্য কোনো পরিচয় বড় হয়ে ওঠেনি। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে, কৌতুকে, গানে, কবিতায়, আড্ডায়, খানাপিনায় সবাই বাংলাদেশী। সবাই বাংলাদেশী মেরিনার্স। হিন্দি সিনেমার স্টাইলে নাচ-গান বা ইন্ডিয়ান আইডল না এলে আমাদের উচ্চবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তের চিত্তগুলোও কেন যেন আজকাল ঠিকভাবে আমোদিত হয় না। আমাদের মন্ত্রীরাও নিজেদের পদমর্যাদা ভুলে গিয়ে শাহরুখ খানদের অনুষ্ঠানে গিয়ে মাটিতে বসে পড়েন। জাতীয় ব্যক্তিত্বরাও জাতির চিরায়ত বোধ-বিশ্বাস সংস্কৃতির ব্যাপারে বেখেয়াল হয়ে পড়েছেন। জাতীয় এক ক্রিকেটারের বিয়েতে ইন্ডিয়ান আইডল এসে আমোদিত করে গেছেন। এই খবর মিডিয়া ফলাও করে প্রকাশ করে অন্য অনেকের শখের লিস্টটিকে লম্বা করে দিয়েছেন। জাতির মরাল ব্রিগেড বা স্পর্শকাতর জায়গাগুলো থেকেও কোনো প্রশ্ন উত্থাপন হয়নি। যারা রাজনৈতিকভাবে ইন্ডিয়ার দালালির বিরোধিতা করেন তারাও সাংস্কৃতিক এই গোলামিকে সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন। একসময় ছিল যা কিছু বড় ও মহান তাই হতো বিলাতি। বিলাতি লাউ, বিলাতি বেগুনের সেই জায়গায় এসে গেছে আজ ইন্ডিয়ান শিল্পী, ইন্ডিয়ান আইডল, ইন্ডিয়ান ড্যান্সার। তামিল নাড়–র জনগণ হিন্দি কালচার ও ভাষার বিরুদ্ধে যতটুকু প্রতিরোধ সৃষ্টি করে সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারের ভাষাভাষীরা ততটুকু প্রতিরোধ শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশী মেরিনারদের বার্ষিক প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানটিতে যা দেখেছি তা না লিখলে কিছুটা অবিচার হবে। সাধ্য থাকার পরেও এই ধরনের সাধটি সহকর্মী মেরিনারদের জাগেনি বলে খুবই আনন্দিত হয়েছি। অর্থাৎ ইন্ডিয়ান আইডল কিংবা ড্যান্সারদের নিয়ে নিজেদের এবং পরিবারবর্গকে বছরে একবার আমোদিত করার সামর্থ্য এই বাঙালি মেরিনারের থাকলেও সচেতনভাবেই তা এড়িয়ে গেছেন। জাহাজের মানুষগুলো এমন সুবোধ হয়ে গেছে তা শুনলে অনেকেই অবাক হয়ে যেতে পারেন। আয়োজনটি বিদেশে হলেও সব কিছুতেই ছিল দেশের ছোঁয়া। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গল্পগুজবের স্টাইল, হাসিঠাট্টা, খানাপিনা সব কিছু ছিল একেবারে শতভাগ দেশীয়। দেশাত্মবোধক গান, পুরনো দিনের গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত,কবিতা আবৃত্তি, নাচ, ম্যাজিক শো পুরো অনুষ্ঠানটিকে সত্যিই ভিন্ন একটা আমেজ এনে দিয়েছে। শিশুদের কিচিরমিচির সিরিয়াস আলোচনা ও গানের অনুষ্ঠানে সামান্য ব্যাঘাত ঘটালেও সার্বিক বিনোদন বিবেচনায় তা-ও উতরে গেছে। এক পাগলের কথা মনে পড়ে। সে তার মাতাল সঙ্গীকে বলে, ‘তুমি খেয়েছ বিদেশী মদ। আর আমি খেয়েছি বাংলা মদ। তাই বলে মনে করো কি নেশা আমার কম হয়েছে?’ কাজেই বিদেশে বসে বিদেশী কোনো উপকরণ না নিয়েও আমাদের বিনোদন একটুও কম হয়নি। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছাব্বিশ ব্যাচের সুব্রত দাস ও আতাউল মাগরিবের নামাজের জন্য পনেরো মিনিট বিরতির ঘোষণা দেন। বাইশ ব্যাচের আলমগীর (আমাদের ইমিডিয়েট জুনিয়র ও নয়া দিগন্তের সাংবাদিক জসীমউদ্দীনের বড় ভাই ) এরই ফাঁকেই আমাদেরকে কিছু আধ্যাত্মিক কথা শুনিয়ে দিলেন। সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় ওর কথাগুলোকেও বেখাপ্পা লাগেনি। মনে হলো, জীবনমুখী এই ধর্মটিকে অহেতুক আমরা জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেই। মনের জন্য যেমন কিছু খোরাক দরকার, তেমনি আত্মার জন্যও কিছু খোরাক দরকার রয়েছে। এই আধ্যাত্মিক খোরাকটির বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়ে পড়েছেন, তারাও প্রকৃতির বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অনুষ্ঠানটিতে সবার স্পিরিট এক হলেও ছোট ছোট নির্দোষ বিভাজন হয়েছে। সবাই নিজ নিজ ব্যাচ, পাশাপাশি ব্যাচ অথবা জাহাজের প্রাক্তন সহকর্মীদের নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রুপে ভাগ হয়ে পড়েছেন। এই বিভাজনেরও অন্য মজা রয়েছে। পঁচিশ ব্যাচের উপস্থিতি অধিক হওয়ায় একটা পুরো টেবিলেও ওদের জায়গা সঙ্কুলান হচ্ছে না। শরীর থাকলেই নাকি মানুষ শরীর দেখায়। পঁচিশ ব্যাচের ওরাও মনে হয় তাদের এই মাংসল শরীরটি দেখাল। সে তুলনায় আমাদের ব্যাচের সবেধন মাত্র দু’জন। হারুন অর রশীদ আর আমি। বন্ধু হারুন অর রশীদ একজন নিভৃতচারী লেখক। বেশ কয়েকটি বই বাজারে এসেছে। আমরা দু’জন একটা টেবিলে অনেকটা এতিমের মতো বসে রইলাম। তা দেখে সতেরোতম ব্যাচের মাসুম ভাইসহ আরো কয়েকজন সিনিয়র ভাই এসে যোগ দিলেন। ফলে আমাদের দু’জনের এতিম ভাবটি অনেকটাই কেটে গেল। এই এতিম শব্দটি মনে বা কানে এলে অ্যাকাডেমির জুনিয়র লাইফের কথা স্মরণ হয়ে যায়। তখন সুর করে বলতে হতো, মেরিন অ্যাকাডেমিতে এলাম গো, ববিতা খালা, রোজিনা খালা, শাবানা খালা বাঁচাও গো। বয়সে কিছুটা বড় হলেও স্বপ্নের এই সব নায়িকাকে খালা ডাকতে এই মনটি কেন যেন সায় দিত না। কাজেই কতটুকু বেকায়দায় পড়ে স্বপ্নের নায়িকাদের খালা ডেকেছি তা সহজেই অনুমেয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, যুগ যুগ ধরে যারা এইভাবে স্বপ্নের নায়িকাদের খালা ডেকেছেন এবং যারা ডাকিয়েছেন পরবর্তী সময়ে সবাই পারস্পরিক বন্ধু হয়ে পড়েছেন। কাজেই কোথাও এরা একত্র হলে পার্টিগুলো এমন জমজমাট হয়ে পড়ে। সময়ের সাথে সাথে এই সব জুনিয়র-সিনিয়রদের বাইরের গেট আপ পরিবর্তন হলেও ভেতরেরটি তেমনই থেকে যায়। আঠারো ব্যাচের মোস্তাফিজ ভাই হঠাৎ করে আমাকে বলেন, ‘তোমার কোম্পানি আমাকে মিলিয়ন ডলার বেতন দিলেও সেখানে জয়েন করব না।’ বললাম, কেন কেন স্যার, আমাদের কোম্পানির ওপর এমন রাগ করলেন কেন ? মুচকি হেসে বললেনÑ দেখো, তোমার কোম্পানির ডাইরেক্টর এবং আমার দোস্তের মাথায় ইয়া বড় টাক। অন্য ডাইরেক্টরেরও একই অবস্থা। আজ অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে দেখি যে তোমার মাথায়ও সেই টাক উঁকি দিতে চাচ্ছে। কাজেই বলো, আমার মাথায় এখনো বিদ্যমান এই ডায়মন্ডের আঁশগুলো নিয়ে তোমাদের কোম্পানিতে যোগদান কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে ? তার এই ব্যাখ্যা শুনে অনেকক্ষণ হাসলাম। বললাম, এই কোম্পানিতে যোগ দেয়ার বিশ বছর আগে থেকেই এই উঁকি দেয়ার অবস্থাতেই আছি। চুল ছাঁটলেই তা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এই সব সমাবেশে গেলে সত্যিই নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অনেক সিনিয়রকে দেখে দারুণ হিংসা লাগে যে তাদের বয়সটি একটুও বাড়ছে না। আবার অনেক বছরের জুনিয়রকে দেখে ‘তুমি’ করে ডাকতে সঙ্কোচ লাগে। সতেরোতম ব্যাচের হাফিজ ভাই তেমনি একজন ভাগ্যবান। সঙ্গত কারণেই বন্ধুরা ‘নায়ক’ বলে সম্বোধন করেন। আজকের অনুষ্ঠানটিতে ভাই ও ভাবী চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান। তার বন্ধু কালাম ভাই জানালেন, জাহাজে থাকতে এই কণ্ঠ দিয়ে জাহাজের সবাইকে নাকি মাতোয়ারা করে রাখতেন। সত্যি, আকাশে যেকোনো বয়সের একটি চাঁদ, সাথে হালকা কিছু মেঘ আর নিচে যদি থাকত পুকুরের পানির মতো টলটলে সমুদ্র। এমন পরিবেশে হাফিজ ভাইয়ের মতো কোনো জীবন্তশিল্পীর দরাজ গলার গান যে কাউকে সাগরে টেনে নেবে। এই হাফিজ ভাইয়ের এক মামা বর্তমান সরকারের বড় কর্তা হয়েছেন। তার নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে কখনোই প্রশ্ন করিনি। লেখালেখির বদৌলতে আমার মত ও মতাদর্শ তার অজানা নয়। তার পরও আমাকে কিংবা আমার স্ত্রীকে দেখলে ভাই ও ভাবীর মুখের হাসিটি একটুও কমেনি; বরং বৃহত্তর ময়মনসিংহের একধরনের টাচ অনুভব করি। অ্যাকাডেমির জুনিয়র এবং শিল্পি পরিবারের টানটি বোনাস হিসেবে তো রয়েছেই। আজ ভয় হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক বিভাজন কি আমাদের এই দামি সামাজিক সম্পদ ও ভাবনাগুলোকে একদিন কেড়ে নেবে? জাতীয় ভাবনায় নতুন কিছু যোগ না করতে পারলেও আমাদের এখনো যা আছে তাকে হারানো তো ঠিক হবে না। পানি ছাড়া নৌকা চলবে না। তেমনি রাজনীতি ছাড়া একটি দেশ চলবে না। কিন্তু নৌকার বুকে পানি ওঠার মতো এই সর্বনাশা রাজনীতি যেন আমাদের বুকে চড়ে না বসে। আমাদের এই সম্পদ ও সুখগুলো যেন কেড়ে না নেয়। আজকে যে দুঃখজনক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে, তার বিরুদ্ধে এই সব সামাজিক জায়গা থেকেই প্রতিরোধটি রচনা করতে হবে। রাজনৈতিক ঘৃণা, ক্ষোভ, হতাশা প্রকাশের জন্য কিছু জায়গা বা স্পেস অবশ্যি বরাদ্দ রাখতে হবে। ঘৃণা ও ক্ষোভ সীমা অতিক্রম করলে সামাজিক এই জায়গাগুলো থেকে অ্যালার্মটি বাজিয়ে দিতে হবে। ব্যথার মূল কারণটি যথাযথভাবে নির্ণয় করতে হবে। যে দাঁতে ব্যথা হবে খুঁজে খুঁজে সেই দাঁতেই চিকিৎসাটি প্রয়োগ করতে হবে। দাঁতের এক পাটিতে ব্যথা হলে দুই পাটি দাঁত উপড়ে ফেলা কখনোই সুচিকিৎসা বলে গণ্য করা যাবে না। কাজেই মিথ্যার কোনো প্রলেপ নয়। সত্যের অনুধাবন এবং তার নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ ও উচ্চারণই পারবে এই সর্বনাশা বিভাজনটির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ রচনা করতে। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads