বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০১৩

পাল্টে যাচ্ছে রাজনীতির হিসাব-নিকাশ


গণমাধ্যমের শিরোনাম বা টেলিভিশনের টকশোতে হেফাজত নিয়ে জমজমাট আলোচনা বা হেফাজতের কোনো শীর্ষ নেতাকে আর টিভির পর্দায় দেখা না গেলেও দেশের সাধারণ মানুষের মুখে কিন্তু হেফাজতের আলোচনা সব সময়ই চলছে।
সম্প্রতি চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সব ক’টিতে মেয়র প্রার্থীসহ অন্যান্য পদে বর্তমান মতাসীন মহাজোট সমর্থক প্রার্থীদের ভরাডুবির পর আবারো গণমাধ্যমের শিরোনামে আসতে শুরু করেছে হেফাজতে ইসলাম। আসন্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারাভিযানসহ সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে খবরাখবরের শিরোনামেও হরহামেশাই উঠে আসছে হেফাজতের নাম। হেফাজতকে নিজ পক্ষে টানার জন্য প্রার্থীদের কসরতেরও যেন শেষ নেই।
রাতের আঁধারে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদের তাড়িয়ে দেয়াকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সফলতা হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। বোদ্ধা মহলের অনেকেই মনে করেন, এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসুল্লিদের হৃদয় থেকে আওয়ামী লীগ ও বাম জোট যোজন যোজন মাইল দূরে সরে গেছে। তাৎণিকভাবে সেই উপলব্ধি না এলেও এখন মহাজোটের শীর্ষ নেতারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এক দিকে মাসের পর মাস পাহারা দিয়ে শাহবাগে আন্দোলন করতে দেয়া, অন্য দিকে মাত্র এক রাতও সাধারণ মুসুল্লিদের উপস্থিতি বরদাশত না করার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এখন দেশবাসীও উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন; কিন্তু শুধু কি এটিই শেষ কথা। হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন ও সরকারের দমননীতির মধ্য দিয়ে অনেক দিন ধরে অস্পষ্ট থাকা আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেশবাসীর কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল, যা আগামীর ভোটের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে থাকবে।
ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ কয়েকটি দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামা হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতারা তাদের প্রায় প্রতিটি জনসভায় জোর গলায় বলে আসছিলেন, তারা কোনো রাজনৈতিক দাবিতে আন্দোলন করছেন না। কাউকে মতায় বসানো বা মতা থেকে নামানো তাদের উদ্দেশ্য নয়। তারা স্রেফ ইসলাম অবমাননাকারী নাস্তিকদের শাস্তিসহ ইসলাম রার স্বার্থে তাদের দেয়া সুনির্দিষ্ট দাবি মেনে নেয়ার দাবি করছেন। ৫ মে মতিঝিলে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসমুদ্রকে সামনে রেখেও হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই একাধিকবার বলেছেন, কাউকে মতায় বসানো বা মতা থেকে নামানোর কোনো অভিপ্রায় তাদের নেই; কিন্তু অহিংস বাণীও শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্ঘাতের হাত থেকে রা করতে পারেনি। এমনকি মধ্যরাতে তপ্ত বুলেটের মুখে মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে যায় হেফাজতের লাখো নেতাকর্মীর উপস্থিতি।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশের কওমি মাদরাসার লাখো শিক ও শিার্থীসহ দেশের ধর্মপ্রাণ কোটি কোটি মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় বাধা না পেরিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা গুটিকয়েক নাস্তিকের শাস্তি দাবি করায় লাখো মানুষকে বুলেটের মুখে সরে যেতে হয়, সেখানে ইসলামি রাষ্ট্র ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে মাঠে নেমে কিভাবে সঙ্ঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে চলবে?
পঞ্চাশের দশকে জন্মলাভের পর থেকেই এবং পরে এর সাথে যোগ হওয়া ইসলামি শক্তির সাথে কওমি ও আলিয়া মাদরাসাসহ অন্যান্য শান্তিপ্রিয় মুসলমানের বিরোধের যে যৌক্তিক মীমাংসা মহাজোট সরকার হেফাজত দমনের মধ্য দিয়ে করে দিলো, অদূর ভবিষ্যতেই এর ফল দেখা যাবে বলেই অনেকের ধারণা।
এ ছাড়া আরেকটি বৈপ্লবিক ঘটনার জন্ম হলো হেফাজত আন্দোলন ও তা দমনের মধ্য দিয়ে। সেটি হলো শুধুই ধর্মকর্ম নিয়ে থাকা বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী ইসলামি গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় করা। এমনও শোনা যায় কওমি ও আলিয়া মাদরাসাকেন্দ্রিক লাখ লাখ শিক্ষক ও শিার্থী তাদের নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে এতই সীমাবদ্ধ ছিলেন যে তারা তাদের ভোটটি পর্যন্ত দিতেন না। অথচ তাদেরকেই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মূল চালকের ভূমিকায় দেখা গেল। এখন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আলোচনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে চলে গেছেন তারা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার হলো। আর সেটি হচ্ছে বিভিন্ন সময় মতাসীনদের তোষামোদী করে একশ্রেণীর নামসর্বস্ব ও লেবাসধারী আলেম নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়ে আসছে। তাদের বাহ্যিক বেশভূষা আর সামাজিক অবস্থানের কারণে সমাজে তাদের একটি শক্ত অবস্থান গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এদের আসল চেহারা এখন দেশের সাধারণ মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। তাই তো লাখ লাখ লোকের ইমামতি করানো স্বনামধন্য আলেমের বারবার আহ্বান এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পরও তার ডাকে সামান্য কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানও হাজির হয়নি মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। অথচ হেফাজতের ডাকে সারা দেশ েেথকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মতিঝিলে এসেছিলেন লাখ লাখ মানুষ।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের সাথে আওয়ামী লীগের ইসলামবিরোধী কোনো আইন পাস না করাসহ ইসলামবিরোধী কিছু না করার অঙ্গীকার ছিল নিছক রাজনৈতিক। পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ও বাম সমর্থক মহাজোট সরকার যে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নয়; বরং গুটিকয়েক ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশের মানুষ এখন যে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নতুন হিসাব-নিকাশ কষবেন না, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারেন?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads