মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০১৩

নৌকা ভিড়বে কোথায়?


দেখতে দেখতে দু’টি বন্দরই হাতছাড়া। চট্টগ্রামের পর হাতে ছিল মংলা, তাও চলে গেল। নৌকা ভেড়ানোর মতো পদ্মায় পানিপ্রবাহ থাকলে না হয় বলা যেত সেখানে দলের সমর্থক প্রার্থীকে অন্তত ভোটের খরায় পড়তে হবে না। অনেকে বলেন, স্থূলবুদ্ধির গ্যাস ও ক্যাশের ফল, ফরমালিনযুক্ত ছিল বলে স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়ে মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করবেÑ এটাই স্বাভাবিক! তা ছাড়া রাজা-বাদশার রাজশাহীতে শাহবাগী-চর্চায় ুব্ধ মানুষের খরচা খাতায় আনারসের নাম তো লেখাই ছিল। তাই বলা যায়, ‘আড়া থেকে বের হলো টিয়া, টোপর মাথায় দিয়া’ শ্লোকের ধাঁধায় ফেলে রাজশাহীর মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়নি। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসচেতন রাজশাহীবাসী চিনতে ভুল করেনি বলে ফলের মওসুমে ফরমালিন আনারসে তাদের রুচি হয়নি। আগের বার (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামী লীগের ঐকমত্যের সরকারের সময় ফারাক্কার পানির ভাগবাটোয়ারার চুক্তির পর পানির ঢেউ পদ্মায় নয়, ঢেউ উঠেছিল স্তাবক পত্রিকা ও মিডিয়ায়। সে সময় রাজশাহীর মানুষের মুখে চুটকি শোনা যেতÑ কী যে পানি চুক্তি করলে মামুজি, পদ্মায় গোসল করতে নামলে ‘কিউসেক’ ভিজে না! এ দিকে একের পর এক নৌকা ভেড়ানোর বন্দর ও ঘাট হাতছাড়া হতে থাকার ঘটনা নাকি চোখের জলে নৌকাডুবির আলামত! প্রধানমন্ত্রী চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিরোধী দল সমর্থিত মেয়রপ্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাকে গণতন্ত্রের বিজয় বলে আখ্যায়িত করেছেন। সংসদে তার বক্তব্যের এই অংশটুকু প্রশংসাযোগ্য হলেও বিরোধী দলকে নসিহত করতে গিয়ে যখন বলেন, ‘আর অসাংবিধানিক কাউকে আনার চেষ্টা করবেন না। তাতে কারো লাভ হবে না, নির্বাচনই হবে না।’ তখন মানুষ তা শুনে আতঙ্কিত হন এবং দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেই প্রশ্নে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। এ দিকে রাজনীতির অভিজ্ঞতার নানান রঙে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাদের শত ছিন্নবস্ত্র দিয়ে জনসমর্থনহীন শরীর ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়ছেন না। তার মতে, চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে অপপ্রচারের বিজয় হয়েছে? আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, দলের নয়, ব্যক্তির পরাজয় হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গীতার একটি বাণীর কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে বলা হয়েছে, ‘বিনাশকালে বুদ্ধি নাশ।’ অর্থাৎ অন্যায় অপকর্ম, অনাচার ও স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যখন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন বুদ্ধিও লোপ পায়। বাংলাদেশে সিলেট বিভাগের একটি জনপদের মানুষই অনাদিকাল থেকে সুনামের সাথে সুপরিচিত হয়ে আসছেন। বাংলাদেশের কোনো জেলা ও জনপদের নামের সাথে ‘সু’ বিশেষণ যুক্ত হওয়ার ভাগ্য হয়নি। সেখানে সুনামগঞ্জ জেলার অনেক মানুষের নাম ‘রঞ্জিত’ থাকলেও আমাদের মনে হয় সুরঞ্জিত বাবু একজন আছেন। রেলওয়ের দুর্নীতির কালো বিড়াল ধরতে গিয়ে যখন ঘুষের বস্তাভরা টাকার সাথে তার জড়িয়ে থাকার কথা প্রকাশ পায় তখন তিনি ‘সুরঞ্জিত’ থাকতে পারেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। তবে সরকার তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রীর পদে রেখে তার সম্মানটা রেখেছেন। তিনি এখন উজিরে খামাখা। সেই সুবাদে তিনি কখন কী বলবেন তা সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কারো জানার কথা নয় বা তারা কেউ তার কথায় বিচলিত বা বিব্রত বোধ করছেন বলে মনে হয় না। তেমনটি হলে তাকে ইতোমধ্যেই সংযত হওয়ার পরামর্শ দেয়া হতো। কেননা এর আগে হেফাজতের কর্মীদের নিয়ে তিনি যে ভাষায় বিদ্রƒপ করে কথা বলেছেন, তখনই সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে তার বাক সংযম করার পরামর্শ দেয়া উচিত ছিল। তা যখন হয়নি তখন তিনি এভাবে বলতেই থাকবেন বলে দেশের মানুষ মনে করেন। তা ছাড়া মানুষ বলে, দফতরবিহীন মন্ত্রী বলে তার দাফতরিক কাজ নেই। এখন যদি তাকে কথাও বলতে না দেয়া হয় তাহলে তার প্রতি চরম অবজ্ঞা ও বৈষম্য করা হবে। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ফলাফলে সরকারের ভেতর যে তোলপাড় চলছে তা গোপন করার বিষয় নয়। তাদের সমর্থক নানা মহলে এখন হতাশা। এরা নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ করে সরকারকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রী সংসদে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য দানের পর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তার অবিশ্বাস, ভয় ও অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। উপমহাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সূত্র ধরে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের দুরবস্থার সাথে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। তখন জরুরি অবস্থা জারি করেও ভারতকে শান্ত করতে ব্যর্থ হন ইন্দিরা। সেই অবনতিশীল পরিস্থিতিতে ইন্দিরা গান্ধী তার আপনজনদের কাছে বলতেন, ‘আমি বাঘের পিঠে চড়ে আছি। বাঘ যদি আমাকে মেরে ফেলে তাতে কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমি জানি না, কী করে বাঘের পিঠ থেকে নামতে হয়।’ সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের বড় অবলম্বন, বলা যায় তার রাজনৈতিক মুরব্বি, সর্বদলীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে বাধ্য হন। অবস্থার অবনতি হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর যুব কংগ্রেসের বাড়াবাড়ির কারণে। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের কোনো মানসম্মান ছিল না। তাদের বুদ্ধি-পরামর্শের তোয়াক্কা করা হতো না। তখন ভারতের সব কয়লা খনি ও ব্যাংকসহ বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান জয় প্রকাশ নারায়ণ। অর্র্থাৎ ভারতের কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি (রুশপন্থী) থাকে ইন্দিরার রাষ্ট্রীয়করণের প,ে আর এর বিরুদ্ধে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক দল। এরা গোটা ভারত তোলপাড় করে তোলে নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে। অথচ সেই জয় প্রকাশ নারায়ণ ১৯৭১ সালের মে মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধীর পে অবস্থান নিয়ে ছদ্মবেশে স্ত্রী প্রভাবতীকে সাথে নিয়ে ভারত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীদের সাথে কথা বলে জেনে নেন পাক সামরিক জান্তার নির্মম নৃশংসতার কথা। তারপর তিনি রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেন বাংলাদেশের মানুষের পে ভারতের ভূমিকা জানাতে। সেই মানুষটিও মাত্র চার বছরের ব্যবধানে ইন্দিরা গান্ধীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। ইন্দিরা গান্ধীর আরেক হিতাকাক্সী, আমেরিকা প্রবাসী আদি জ্ঞানের শিক জে কৃষ্ণমূর্তি ১৯৭৬ সালে ২৪ অক্টোবর দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে একান্ত আলোচনায় বসেন। সে সময় ইন্দিরা তার কাছে পরামর্শ চান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের। জে কৃষ্ণমূর্তির হাত ধরে কেঁদে কেঁদে তার অস্থির অশান্ত মন হালকা করার চেষ্টা করেন। তার সাথে আলাপচারিতার পর ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে ভারতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ইন্দিরা গান্ধীর জীবন দর্শনে বেদান্তের প্রভাব ছিল। তিনি বলতেন, ‘কতগুলো শক্তি ও ঘটনাস্রোতই আমাদের পরিচালিত করে। আমরা তার অংশ মাত্র।’ ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী ও তার দল কংগ্রেসের পরাজয়ের নানা কারণের মধ্যে পুরান দিল্লি থেকে মুসলিম আবাদ এলাকার মুসলিম বসতি উৎখাত অন্যতম। উচ্ছেদের ঘটনার সময় বাধা দিলে হাজার হাজার মুসলমান নরনারী, শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়া হয় নির্বাচনের সময়। তাই সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশের চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগের ভরাডুবির কারণ হিসেবে যখন তাদের ঘরের বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ মানুষ মতিঝিল শাপলা চত্বরে রাতের অন্ধকারে মানবতাবিরোধী অভিযানের দিকে আঙুল দেখিয়ে লেখালেখি করেন, তখন আমাদের কেবলই মনে পড়ে ইতিহাসের ওইসব ঘটনার কথা। সেই দিনের ইন্দিরা গান্ধী অস্থিরতা ও অশান্ত মনে স্বস্তি পেতে নিরাপদে বের হওয়ার পথ খুঁজছিলেন। সেই পথ তিনি নিজেই খুঁজে পেয়ে জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সে দফায় পরিত্রাণ লাভ করেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সামনেও অপো করছে তেমনি এক অবস্থা। সময় এখন আছে তার সিদ্ধান্তের অপোয়। যে সমস্যাটি তিনি আঁচলে গিঁট দিয়ে রেখেছেন তা তিনি নিজেই খুলতে সম। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক বা দলনিরপে সরকারের হাতে মতা দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেই তিনি দেশ, সংবিধান, রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে ঝুঁকিমুক্ত করতে পারেন। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads