শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৩

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনের চেষ্টা অশুভ পরিণতির কারণ হয়ে উঠবে


আহমদ আশিকুল হামিদ : মুলতবি অধিবেশনে প্রমাণ করেছেন, দেশে এখনো একটি সংসদ রয়েছে। সংসদের ব্যাপারে কিছুদিন আগেও যারা প্রশ্ন ও সংশয় প্রকাশ করতেন তাদের ‘শখ’ও মিটিয়ে দিয়েছেন ওই এমপিরা। সেটা অবশ্য ভদ্র ও সংসদীয় আচরণ ও কথাবার্তার মাধ্যমে নয়, ‘শখ’ মিটিয়ে দিয়েছেন তারা অশ্লীল কথাবার্তা আর খিস্তিখেউরের তুমুল প্রতিযোগিতা চালিয়ে। উদাহরণ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অপু উকিলদের প্রসঙ্গ সেরে নেয়া যাক। গত ২০ জুন অপু উকিল নামের আওয়ামী লীগের এক সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি এমন কুৎসিত ভাষায় বেগম খালেদা জিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন ‘তথ্য’ তুলে ধরেছেন, যেগুলো কোনো ভদ্রজনের পক্ষে লেখা বা বলা মোটেও সম্ভব নয়। আপত্তি শুধু তার ভাষার জন্য ওঠেনি। অপু উকিলকে ১০ মিনিটের সময় দেয়া হয়েছিল বাজেট সম্পর্কে কিছু বলার জন্য। কিন্তু বাজেটের ধারেকাছেও যাননি তিনি। বরাদ্দের ১০ মিনিট তো বটেই, মাননীয় স্পিকারের বদান্যতায় আরো দুই দফায় তিনি সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। বড়কথা, পুরো সময়টুকুই তিনি বেগম খালেদা জিয়ার ‘গোষ্ঠী উদ্ধারের’ কাজে ব্যয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য অন্য একটি বিষয় হলো, বিরোধী দলের উপর্যুপরি দাবি ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও স্পিকারের আসনে থাকা ডেপুটি স্পিকার ওই আওয়ামী এমপির মাইক বন্ধ করেননি। তিনি এমনকি তাকে বক্তব্য ও ভাষার ব্যাপারেও সংযত হতে বলেননি। প্রকাশিত খবরে বরং বলা হয়েছে, এ সময় ডেপুটি স্পিকারকে ‘প্রায় নির্লিপ্ত অবস্থায়’ দেখা গেছে!
অপু উকিলকে অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ তার নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যথেষ্টই দেখিয়ে চলেছেন। এর মাত্র দু’দিন আগেও সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনি হঠাৎ খালেদা জিয়ার ওপর চড়াও হয়েছিলেন। অভ্যাসবশত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকেও টেনে এনেছিলেন তিনি। এরপর তিনি ঠিক কোন ধরনের ভাষায় বিএনপিকে তুলোধুনো করেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিস্তারিত উল্লেখ করার দরকার পড়ে না। কারণ, এসব কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এত বেশিবার বলেছেন যে, সেগুলো এতদিনে শিশু-কিশোরদেরও মুখস্থ হয়ে গেছে। সেদিনের বক্তৃতায় মানুষ অবশ্য শেখ হাসিনার নিজের মুখে তার ‘ছেলের বউ’ সম্পর্কে জানতে পেরেছে। তিনি বেশ গর্বের সঙ্গেই ঘোষণা করেছেন, তার ছেলের বউ ইহুদী নয়, খ্রিস্টান। ‘আহলে কিতাব’ অর্থাৎ আল্লাহর নাজিল করা ধর্মগ্রন্থ মেনে চলে বলে খ্রিস্টানদের সঙ্গে মুসলমানদের নাকি বিয়েশাদী চলতে পারে বলেও তত্ত্ব হাজির করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, খ্রিস্টান মেয়েকে বিয়ে করে তার ছেলে কোনো ইসলামবিরোধী কাজ করেননি! প্রধানমন্ত্রী অবশ্য জানাননি, এটা তার ছেলের কত নম্বর বউ এবং এখনো আইনত তিনি তার ছেলের বউ হিসেবেই রয়েছেন কি না। কথাটা বলার কারণ, দুষ্টজনেরা এই মর্মে প্রচারণা চালিয়ে থাকে যে, বর্ণিত খ্রিস্টান বউ-এরও আগে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে নাকি ভারতীয় এক শিখ নারীকে বিয়ে করেছিলেন। ওদিকে লন্ডনে বসবাসরত প্রধানমন্ত্রীর বোনের মেয়েও সম্প্রতি একজন ইংরেজকে বিয়ে করেছেন। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতেই প্রধানমন্ত্রী ৫ জুলাই লন্ডন গেছেন। নতুন ভাগ্নি জামাই ইহুদী না খ্রিস্টান সেটা জানা না গেলেও তিনি যে অন্তত মুসলমান নন সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনাপ্রবাহে অন্য একটি বিষয় নিয়েও জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। সেটা হলো, ৯০ ভাগ মুসলমানের রাষ্ট্র বাংলাদেশ এমন একজন ‘জাতির পিতা’ পেয়েছে, যার পরিবারের উত্তরসুরীরা অমুসলমানদের সঙ্গে বিয়েশাদী করতেই বেশি আগ্রহী! তাদের সংসারে তাই বাঙালী দূরে থাকুক, মুসলমান সন্তানও আসবে না।
তাদের নিজেদের ব্যাপার বলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবারকে ছেড়ে জাতীয় সংসদ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, প্রধানমন্ত্রী ইদানীং সুযোগ পেলেই শিখিয়ে চলেছেন, বাংলাদেশে তারা সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে’ যেভাবে নির্বাচন হয় সেভাবেই তারাও নির্বাচন করবেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, আসলেও কি দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? অমন প্রশ্নের কারণ, বর্তমান নবম সংসদকে তো প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন থেকেই পঙ্গু করা হয়েছে। উস্কানি দেয়ার উদ্দেশ্যে আসন বিন্যাস নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করা এবং অশালীন ও অসংসদীয় ভাষায় আক্রমণ চালানো থেকে বিরোধী দলকে বারবার বাইরে ঠেলে দেয়া পর্যন্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে শুধু নয়, দিনের পর দিন নিজেরা অনুপস্থিত থাকার এবং সাবেক স্পিকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের ভাষায় সংসদকে ‘মাছের বাজার’ বানানোর মাধ্যমেও ক্ষমতাসীনরা সংসদকে অকার্যকর করে ফেলেছেন। এতদিন বিরোধী দলের অনুপস্থিতির দোহাই দেয়া হয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ অধিবেশনে দেখা গেছে, বিরোধী দল যোগ দেয়ার পরও ক্ষমতাসীনদের নীতি-মনোভাব ও কর্মকা-ে সামান্য পরিবর্তন ঘটেনি। বরং তাদের যতো আগ্রহ সব অশ্লীল ও অসংসদীয় ভাষার ব্যবহারে এবং বিরোধী দলকে অসম্মানিত করার ব্যাপারে। এজন্যই সাধারণ মানুষও আজকাল প্রশ্ন তুলছেন, প্রতি মিনিটে ৪২ হাজার টাকা খরচ করে যে সংসদে শুধু অশ্লীল ভাষায় খিস্তিখেউর করা হয়, তেমন কোনো সংসদের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না? একথাও অনেকে না বলে পারছেন না যে, অপু উকিলরা সংসদকে আসলেও ‘মাছের বাজার’ই বানিয়ে ছেড়েছেন!
প্রসঙ্গক্রমে প্রাধান্যে এসেছে প্রধানমন্ত্রী বর্ণিত ‘সংবিধান অনুযায়ী’ এবং ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে’ যেভাবে নির্বাচন হয় সেভাবে নির্বাচন করার কথাটাও। প্রধানমন্ত্রী এমনভাবে বলে চলেছেন যেন বাংলাদেশের সংবিধান এখনও অবিকৃত ও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে! মাঝখানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের নেতৃত্বে সংবিধানের খোলনলচেই যে পাল্টে ফেলা হয়েছে সে কথার ধারেকাছেও যাচ্ছেন না প্রধানমন্ত্রী। তিনি একথারও উল্লেখ করছেন না যে, উচ্চ আদালতের বিতর্কিত যে রায়কে অবলম্বন করে তারা সংবিধানে কাঁচি চালিয়েছেন এবং সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করেছেন সে রায়ের মধ্যেই পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে অভিমত দেয়া হয়েছিল। একজন ছাড়া অ্যামিকাস কিউরি থেকে কথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের প্রত্যেকেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। বলাই বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিত ও নির্দেশ না থাকলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তদের পক্ষে এত বড় একটি অঘটন ঘটানো সম্ভব হতো না।
মাত্র সেদিনের হলেও এখানে ইতিহাসের তথা উচ্চ আদালতকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখ করা দরকার। একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। সে রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ১ মার্চ। সে বছরের ১৬ মে বিদায় নেয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চকে সহায়তা করার জন্য ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ড. এম জহির, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি প্রমুখ শুনানিতে বক্তব্য রেখেছেন। কিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করলেও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া অ্যামিকাস কিউরিদের প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু দিনের পর দিন ধরে সংবিধানসম্মত ব্যাখ্যা ও বক্তব্য শোনার পরও একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরাও আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। অথচ অজুহাত হিসেবে যে রায়কে অবলম্বন করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত সে রায়টি একই সঙ্গে স্ববিরোধিতাপূর্ণ হিসেবেও বিতর্কিত হয়েছে। কারণ, রায়ে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি, একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দু’টি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া এটা ছিল একটি বিভক্ত রায়। বড় কথা, রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা ছিল আসলে ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে পদক্ষেপই নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলে বসেছেন, আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার নাকি ‘আর কোনো সুযোগ নেই’! প্রধানমন্ত্রী সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া অভিমতটুকুর উল্লেখই করেননি এবং এখনো করছেন নাÑ যেখানে বলা হয়েছিল, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দু’টি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
এভাবে আওয়ামী লীগ সরকার রায়ের একটি মাত্র অংশকে অবলম্বন করে দেশের সংবিধানের নাড়ি ধরে টান মেরেছেন এবং খোলনলচে পাল্টে ফেলেছেন। এ উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা এমন এক সাবেক প্রধান বিচারপতির তৈরি করা পথে পা বাড়িয়েছেন, আওয়ামী লীগের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করার অভিনয় করে যিনি দেশের সংবিধানকেই ‘ল-ভ-’ করে ফেলেছেন। ক্ষমতাসীনরা ওই বিচারপতির প্রকৃত উদ্দেশ্যসহ অন্য কোনো সম্ভাবনাকে বিবেচনায় পর্যন্ত নেননি। তারা ভাবতেই চাননি যে, খায়রুল হক আসলে অন্য কোনো গোষ্ঠীর জন্য ‘পথ পরিষ্কার’ করে গেছেন কি না। কারণ, এই বিচারপতির দেয়া রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করার ফলে রাজনৈতিক সংকট তো ঘনীভূত হয়েছেই, বিঘিœত হতে পারে ‘দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা’ও। আর এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগই সাধারণত ‘উদ্দিন’ সাহেবরা নিয়ে থাকেনÑ যাদের ভয় প্রধানমন্ত্রী দেখাচ্ছেন।
এখানে অন্য একটি তথ্যও উল্লেখ করা দরকার। সে তথ্যটি হলো, একই বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পুরোটাই বাতিল ঘোষণা করেছিল। আপিল বিভাগও রায়টিকে বহাল রেখেছে। এর পরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। অথচ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে তখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে শুনানিই শুরু হয়নি। শুনানি শুরু হয়েছিল ১ মার্চ থেকে, ‘সংক্ষিপ্ত আদেশের’ আকারে যার রায় ঘোষিত হয়েছে ১০ মে। তা সত্ত্বেও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। এর একটি মাত্র ব্যাখ্যাই হতে পারেÑ প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করেছিলেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একে গুরুতর বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছিল, সরকার আদালতের রায়ের আলোকে ব্যবস্থা নিয়েছে, নাকি আদালতই সরকারের ইচ্ছার আলোকে রায় ঘোষণা করেছে?
এ ধরনের প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। কারণ, এমন এক প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করেছে যিনি সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ ৩৭ হাজার ২৫০ টাকা ‘ত্রাণ’ নেয়াসহ ব্যক্তিগত কিছু কীর্তির কারণে নিন্দিত হয়েছেন। এই ‘ত্রাণ’ নেয়ার মাস খানেক আগে এক রায়ে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ বানিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন। বিদায় নেয়ার প্রাক্কালে তিনিই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল ঘোষণা করে গেছেন। এ খবরও গোপন থাকেনি যে, পুনর্মুদ্রণের নামে সরকার যেভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে ঠিক সেভাবেই রায় দিয়েছে তার নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। সরকার অবশ্য বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জনগণকে জানতে দেয়নি। এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে রাখা দূরে থাকুক, দল দু’টির বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। অখ্যাত ও প্রত্যাখ্যাত এমন কিছু দল ও সংগঠনকে নিয়ে কমিটি আসর মাতিয়েছিল যারা শুধু জনবিচ্ছিন্ন নয়, যাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগও রয়েছে। ক্ষমতাসীনরা যে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই আদালতের রায়কে অজুহাত বানিয়েছিলেন সে কথাও বুঝতে পেরেছে জনগণ। সংশোধিত এ সংবিধানেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ৫৮ ২-ক পরিচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ও ৫৮ ঙ) বিলুপ্ত করা হয়েছে। যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে।
ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, ক্ষমতাসীনরা সবকিছু করেছেন বিরোধী দলকে বাইরে রেখে। একই কারণে প্রধানমন্ত্রীর ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশের মতো’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণাকেও মেনে নেয়া যায় না। তার বরং বলা উচিত, সংশোধনের আড়ালে যে সংবিধানকে তারা জাতির ঘাড়ে চাপিয়েছেন নির্বাচন হবে সেই সংবিধান অনুযায়ী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কখনোই সেদিকে যান না। তার বর্ণিত অসাংবিধানিক সরকারের বিষয়েও এ পর্যন্ত কম বলা হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক নামের যে সরকারকে উদাহরণ বানিয়ে বিরোধী দলকে তিনি জেলের ভাত খাওয়ানোর এবং রাজনীতি থেকে মাইনাস হওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন সে সরকার ছিল তাদেরই ‘আন্দোলনের ফসল’! কথাটা প্রধানমন্ত্রীও সে সময় জোর গলায় বহুবার বলেছিলেন। প্রশ্ন উঠেছে, নিজেদের আন্দোলনের সে ফসলকে নিয়েই বা তার এত ভীতি ও সংশয় কেন? মাত্র সেদিনের ঘটনা বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করার পরিবর্তে আমরা তো মনে করি, সব পক্ষ যদি সততার সঙ্গে গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত রাখতে পারে এবং কোনো বিশেষ নেতা-নেত্রী যদি ক্ষমতায় আসতে পারবেন না বলে লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাসের মতো ভয়ংকর পথে পা না বাড়ান তাহলে কোনো ‘উদ্দিনদের’ পক্ষেই্ অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হওয়ার কথা নয়। সেটা না করে কেউ বা কোনো দল যদি নিজেই গাছের গোড়া কেটে ওপরে ওপরে পানি ঢালার অভিনয় করে তাহলে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র ও সংবিধানকে সমুন্নত ও বাধাহীন রাখা সম্ভব হবে না। এই সহজ কথাটা না বোঝার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী সহজ ও গণতন্ত্রসম্মত সে পথে আসতেই চাচ্ছেন না।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষও কিন্তু মনে করে, চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরো একবার ক্ষমতাসীনদের জনপ্রিয়তার ধসের দিকটিই পরিষ্কার হয়ে গেছে। মানুষের মনে পড়ে গেছে, ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনে ঠিক কোন পন্থায় এবং কোন ‘উদ্দিনদের’ সাজানো ছক অনুযায়ী আওয়ামী লীগ এত বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিল। আমাদের ধারণা, মানুষকে সেই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর জন্য অন্তত সফলতা অর্জন করার বা লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গণতন্ত্রের ব্যাপারে সত্যি সদিচ্ছা থাকলে তার বরং উচিত সময় থাকতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার ব্যবস্থা নেয়া। নাহলে তার নিজেরই একটি কথা সত্য হয়ে উঠতে পারেÑ যেখানে তিনি বলেছেন, দেশে ‘তাহলে নির্বাচনই হবে না!’ নির্বাচন না হলে তারা নিজেরাও কি নিরাপদে থাকতে পারবেন?

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads