বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৩

নিপীড়িত সাংবাদিক ও অস্ত্রবাজ নেতা


আলোচিত এমপি গোলাম মাওলা রনি সাংবাদিক পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন আইনপ্রণেতারা কতটুকু আইনের রক্ষক। ময়মনসিংহ গফরগাঁওয়ের এমপি পিস্তল নিয়ে মানুষকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিলেন। একজন সংসদ সদস্যরাষ্ট্রের সবচেয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তিনি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। আইনপ্রণেতা। সবার উচ্চ ধারণা থাকে এসব সংসদ সদস্য আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। নাগরিকেরা প্রত্যাশা করেন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অন্যায় করলেও ওই সংসদ সদস্য আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন; কোনোভাবে কারো বিরুদ্ধে চড়াও হবেন না। ঘটনার যে ভিডিও কিপ প্রকাশ পেয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, রনি নিজেই মারধর করেছেন সাংবাদিকদের। বেদম মারের চোটে অসহায় আর্তনাদ ভেসেছে বাতাসে। সাংবাদিক নেতারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তাদের উদ্ধার করেছেন। রনি একটি টিভি চ্যানেলের মালিকের নানা দুর্নীতি নিয়ে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন। সাংবাদিক পেটানোর বিষয়টি কিছুটা হালকা হয়েছে এই একটি কারণে। রনির দাবি মতে, ওই নিবন্ধ লেখার পরদিন থেকে ইনডিপেনডেন্ট টিভির সাংবাদিক ও ক্যামেরা তার পেছনে লাগে। সাংবাদিক পেটানোর ঘটনার কঠোরভাবে নিন্দনীয়। বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি সবার দাবি। ফেসবুকে নাগরিক মতামত সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। এই জায়গাতে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। যেকোনো ঘটনার ব্যাপারে নাগরিকেরা মনের ভাব এখানে প্রকাশ করতে পারেন। নিপীড়ক রনির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন স্বাধীন মত প্রকাশকারীরা। তার পক্ষে একচেটিয়া সমর্থন দেখে মনে হতে পারে নাগরিকেরা সবাই অপরাধীর পক্ষ অবলম্বন করেছেন কি না। নিরীহ সাংবাদিক পেটানোর পর কোন যুক্তিতে সাধারণ মানুষ ঘটনাটি পছন্দ করছেন। বিষয়টির মধ্যে সবার জন্য ভাবার আছে। কেন মার খেয়েও সাংবাদিকেরা পাবলিক সেন্টিমেন্ট পাচ্ছেন না। এ বিশাল বিপুল প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার প্রয়োজন রয়েছে। উল্টো রনিকে অনেকে দিয়েছেন ধন্যবাদ। তার পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরে পক্ষে মন্তব্য করছেন। আবার এসব মন্তব্যের ওপর অনেকে লাইক দিয়েছেন। বিশেষ করে এ ঘটনায় সংবাদমাধ্যম কর্মীদের আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন রয়েছে। মার খেয়েও জনগণের সহমর্মিতা না পাওয়ার জন্য মিডিয়া নিজেই কি দায়ী নয়? এখন টকশোগুলোয় রনির সমালোচনা করা আমাদের জন্য সহজ। কারণ এর নিয়ন্ত্রণ রনির হাতে নেই। কিন্তু তাতে করে মিডিয়া ও মিডিয়াকর্মীদের ওপর জনমত সহনশীল হবে না। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, বাংলাদেশের মিডিয়া নিয়ে সাধারণ পাঠক, দর্শকশ্রোতাকে হতাশ হতে হয়েছে। মানুষ হত্যার ঘটনাকে তারা আড়াল করে দিয়েছে নাশকতা জঙ্গি কর্মকাণ্ড বলে প্রচারণার আবরণে। পাঠক দর্শক প্রথম দেখতে পেলেন যাদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ এনেছে, তারাই আবার হত্যার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে মতিঝিলে যে ক্র্যাকডাউন চালানো হয়েছে, তা বাংলাদেশী মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। নাগরিক হত্যার ঘটনাকে আড়াল করে মিডিয়া খবর প্রচার করেছে গাছ কাটা, রোড ডিভাইডার ধ্বংস ও অগ্নিকাণ্ডের। আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এর সমালোচনা করেছে। অপর দিকে শাহবাগে কয়েক শ’ মানুষের জমায়েতকে লাখো মানুষের উপস্থিতি বলে চালিয়ে দিয়েছে। গত পাঁচ মাসে বাংলাদেশী মিডিয়ার চরিত্র নাগরিকদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রতারণা কপটতা ও ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণের শিকার হয়েছেন মানুষ। এর প্রতিফলন সংবাদপত্রের সার্কুলেশনে পড়েছে। দু-একটি সংবাদপত্র যারা ঘটনার সত্য বিবরণ দিয়েছে, তাদের প্রচারসংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল অবিশ্বাস্যভাবে। যদিও এসব পত্রিকার কাগজের মান ছিল খারাপ। পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল অন্য পত্রিকার চেয়ে কম। অন্য দিকে দাম ছিল সবার চেয়ে বেশি। টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা গেছে। যে চ্যানেল দর্শক জরিপে পেছনের সারিতে ছিল, ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ প্রকাশ করে উঠে আসে এক নম্বরে। দিগন্ত টিভি বন্ধ হওয়ার পর দর্শকশ্রোতার বিশাল একটি অংশ দেশীয় টিভি চ্যানেল দেখা বন্ধ করে দেয়। টিভি চ্যানেলের সঞ্চালক-উপস্থাপকদের বিরুদ্ধে অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগ দর্শকদের। আলোচনার মাধ্যমে ঘটনার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়ার চেয়ে নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতে বেশি তৎপরতা দেখিয়েছেন তারা। এ ধরনের অন্যায় পক্ষপাতিত্বের কারণে দর্শকশ্রোতা তাদের ওপর চরম বিরক্ত হয়েছেন। এ ধরনের অন্যায় সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পাঠক-দর্শকের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করার কোনো সুযোগ থাকে না। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, বিরক্ত দর্শকেরা প্রতিশোধ নেন নিরীহ সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে। অন্যায় কর্মটি নিজ হাতে করেও পাবলিক সেন্টিমেন্ট ওই একই কারণে রনির পক্ষে। শেয়ারবাজার লাখ লাখ মানুষকে ফতুর করে দিয়েছে। অল্প কয়েকজন ক্ষমতাসীন প্রভাবশালী ব্যক্তি এ লুটপাটের সাথে জড়িত। রনি এর পালের গোদার বিরুদ্ধে লিখেছেন। বর্তমান সরকার আমলে এসব রাঘব-বোয়ালের বিরুদ্ধে বলার সাহস কারো নেই। রনি গ্রেফতার হওয়ার সময় যে বক্তব্য দিয়েছেন, পাবলিক সেন্টিমেন্ট আরো বেশি করে তার পক্ষে যাবে। তিনি বলেছেন, আমার শাস্তির বিনিময়ে হলেও শেয়ারবাজার চাঙ্গা হোক। এই আওয়ামী লীগ এমপি টিভি টকশোর একজন জনপ্রিয় কথক। তিনি দলের বাইরে গিয়ে অনেক সময় সাধারণ মানুষের ইস্যুগুলোর সাথে সহমত পোষণ করেছেন; যে কারণে তাকে দলীয় সভায় নানা গালাগাল শুনতে হয়েছে। নেত্রীর পক্ষ থেকে উপাধি পেতে হয়েছে ‘উজবুক’। সরকারের অন্যায় অনিয়মের গঠনমূলক সমালোচনা করবে মিডিয়া। যেখানে তা করছেন একজন সরকারদলীয় এমপি। একই কারণে সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় নাগরিকেরা তাকেই সমর্থন করছেন। একজন সম্পাদক অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লেখনীর মাধ্যমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বলে তার চরম পরিণাম নাগরিক সমাজ দেখেছে। সম্পাদক হয়েও রিমান্ডে নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সাংবাদিক কমিউনিটি শক্ত করে তার পক্ষে দাঁড়ায়নি। উল্টো সাংবাদিক নেতাদের একটি অংশ ঘোরতরভাবে তার বিরুদ্ধে নেমেছিল। কেউ কেউ অন্তরালে থেকে তাকে গ্রেফতার করে সরকারি হেফাজতে নেয়ার নানা কৌশল অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে সরকারকে। আমার দেশ পত্রিকাটিও কোনো ধরনের কারণ ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতিতে একজন সরকারদলীয় এমপির ব্যতিক্রমী অবস্থান অনেক পাঠক-দর্শক পছন্দ করেছেন। এখন একটি বড় অন্যায় করার পরও তিনি পাচ্ছেন সমর্থন। একই সময় একটি আলোচিত খবর ‘সেই অস্ত্রধারী’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হলেন। সব পত্রিকা অস্ত্র হাতে নবনিযুক্ত সাধারণ সম্পাদকের বিভিন্ন অ্যাকশনের ছবি দিয়েছে। কোনোটাতে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। কোনোটাতে তাকে দেখা যাচ্ছে রামদা হাতে ছুটছেন। এমনও ছবি পাওয়া গেল আগ্নেয়াস্ত্র ও রামদা দুই হাতে দুটো নিয়ে তিনি ছুটছেন। পত্রিকা খবর দিয়েছে এই সন্ত্রাসী নেতা ডাকাতির অপরাধে জেলও খেটেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম, স্থানীয় নেতা পরাজিত মেয়রপ্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাশীল নির্বাচক কমিটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের জন্য এক অস্ত্রবাজকে নেতা মনোনীত করেছে। এ অস্ত্রবাজকে সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করার কারণ কি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা সে ব্যাপারে মন্তব্য করেননি। তবে ছাত্রলীগের নিচের সারির এক নেতা মন্তব্য করেছেন অন্য ছাত্র সংগঠনকে মোকাবেলা করার জন্য তৌহিদ-আল-তুহিন উপযুক্ত। তাই তাকে নিয়োগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। সোমবার পত্রিকায় রনি ও তুহিন উভয়ের খবর গুরুত্বের সাথে কাভার করা হয়েছে। অস্ত্রসহ তুহিনের অ্যাকশনের ছবিটি পত্রিকার একটু বেশি জায়গা দখল করেছে। মানুষ হত্যা, নির্দয়ভাবে পেটানো এগুলো বড় ধরনের অপরাধ। এসব অপরাধের কোনোটি খাটো করে দেখা যাবে না। সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক। তারা সমাজের অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে মানুষের রক্ষাকবচ। সেখানে একজন সাংবাদিক হত্যা করা কিংবা তাকে পেটানো নিঃসন্দেহে আরো বড় অপরাধ। সাংবাদিকেরা এ কারণে সুবিধাপ্রাপ্ত যে, সমাজের অন্যদের অধিকার রক্ষায় তারা দায়িত্ববান। এ বিশেষ সুবিধা তারা হারিয়ে ফেলেন যখন তারা সাধারণ মানুষের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে বরং এর বিরুদ্ধে চলে যান। বর্তমান সরকারের সময় সংবাদমাধ্যমগুলো জনগণের পক্ষে অবস্থান নিতে পারেনি। তারা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার মানুষকে রক্ষা তো দূরের কথা, নাগরিকদের বিরুদ্ধে নানা সন্ত্রাসী তকমা জুড়িয়ে দিয়ে সরকারের অন্যায় কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করে দিয়েছে। যার একচেটিয়া সুবিধা ভোগ করেছে ক্ষমতাসীনেরা। আখেরে সেটি ক্ষমতাসীনদের জন্য মন্দ পরিণাম বয়ে এনেছে। মিডিয়া সঠিক ভূমিকা পালন করলে ক্ষমতাসীনেরা এতটা বেপরোয়া ও অন্যায় করার সুযোগ পেত না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদেরও বড় পরাজয়ের শিকার হতে হতো না। তা হলে মিডিয়া আওয়ামী লীগের পক্ষ নিতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে বিপক্ষেই কাজ করেছে। সংসদ সদস্য রনি সাংবাদিক পেটানোর পর সেটি আরো স্পষ্ট হলো। এখানে শিক্ষণীয় রয়েছে মিডিয়া ও আওয়ামী লীগ উভয়ের জন্য। একটি ইংরেজি পত্রিকা খবর তৈরি করেছে সাংবাদিক পেটানোয় সরকার বিব্রত। ইতিহাস বলে ক্ষমতাসীনেরা কখনো এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিব্রত হয়নি। তা হলে একজন সন্ত্রাসীকে সাধারণ সম্পাদক করার পরও ক্ষমতাসীনেরা বিব্রত হতেন। মিডিয়া নিরপেক্ষ হতে চাইলে বা ক্ষমতাসীনদের ভালো চাইলে অস্ত্রবাজকে সম্পাদক নিযুক্ত করার বিষয়ে ‘বিব্রত’-বিষয়ক খবর তৈরি করত। অস্ত্র নিয়ে এই সন্ত্রাসী যে মহড়া দিয়েছে, পত্রিকায় তার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর সরকার বিব্রত না হয়ে পারে না। যেমনিভাবে সাংবাদিক পেটানোয় সরকার বিব্রত হয়েছে বলে পত্রিকাটি খবর তৈরি করেছে। লক্ষ্মীপুরের সন্ত্রাসী তাহের এবং পরে তার সন্তানেরা সাংবাদিকদের মেরে হাড়গোড় চূর্ণ করেছে। নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান এ চর্চা করেছেন অনেকবার। ফেনীর সাবেক গডফাদার জয়নাল হাজারী সাংবাদিক পিটিয়ে রেকর্ড গড়েছেন। সরকার যদি এসব কাজে বিব্রত হতো, তা হলে সরকারের বর্তমান করুণ দশা হতো না। মিডিয়াও সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এবং সরকারের নানা অকাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি। বরং দাঁড়িয়েছে এমন সব গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যারা প্রকৃতপক্ষে সরকার ও জনগণের শত্রু ছিল না। সরকার ও মিডিয়ার সমান্তরাল ভূমিকা জনগণ পছন্দ করছে না। যার ফলে মার খেয়েও সাংবাদিকেরা নিজেদের পক্ষে পাবলিক সেন্টিমেন্টকে পাচ্ছেন না। মিডিয়া সময়মতো সঠিক দায়িত্ব পালন করলে জনগণ নির্দ্বিধায় নিপীড়িত সাংবাদিকদের পক্ষে অবস্থান নিত।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads