বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০১৩

কিশোরগঞ্জ উপনির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিকতা


গত ৩ জুলাই কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের জাতীয় সংসদ উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার কারণে জাতীয় সংসদের কিশোরগঞ্জের আসনটি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন বয়কট করার কারণে রাষ্ট্রপতির ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ মুহিতুল ইসলাম অসিমের মধ্যে মূলত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। নির্বাচনের ফল ঘোষিত হলে দেখা যায়, বিশাল ব্যবধানে রাষ্ট্রপতির ছেলে বাবার আসনটির জয়ের ধারা অক্ষুণœ রেখেছেন। নির্বাচনের দিন শেষ বিকেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে কিশোরগঞ্জ উপনির্বাচনে কারচুপির বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি বলেন- কিশোরগঞ্জ উপনির্বাচনে সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভোটডাকাতির মহড়া দিয়েছে। গত ৪ জুলাই নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে কিভাবে ভোট লুট করা হবে তার একটি মহড়া গত ৩ জুলাই কিশোরগঞ্জ উপনির্বাচনে তারা দিয়েছে। ভোটডাকাতির ব্যাখ্যা দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘হাওর অধ্যুষিত কিশোরগঞ্জের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যেতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে, সেখানে মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে ফল ঘোষণা করা হয়েছে। ৩০ মিনিটের মধ্যে তিন ধরনের ফল হয়েছে। অথচ কয়েক দিন আগে অনুষ্ঠিত চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রের দূরত্ব ছিল ২০-২৫ মিনিটের। সেখানে ফল পেতে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।’ ৩ জুলাই কিশোরগঞ্জ উপনির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতির সাথে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবের গরমিল পাওয়া গেছে অনেক কেন্দ্রে। কোনো কোনো ভোটকেন্দ্রে কাস্টিং ভোট বিগত মইন-ফখরুদ্দীনের সেনাসমর্থিত নবম জাতীয় সংসদের ভোটকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভোটের হিসাব-নিকাশ, ভোটারদের উপস্থিতি এ দু’টি বিষয় পর্যালোচনা করলে এই গরমিল ধরা পড়বে। ওই নির্বাচন যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন, নির্বাচনপরবর্তী সংবাদপত্রের রিপোর্ট, বিরোধী দলের অভিযোগ এবং সর্বোপরী বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ মহিতুল ইসলাম অসিমের ভাষ্য পর্যালোচনা করলে এই উপনির্বাচনে সরকারি দল পেশিশক্তি প্রয়োগ, অনৈতিক ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে কিভাবে তাদের প্রার্থীকে জিতিয়ে এনেছে সেটি স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। প্রথমত, ভোট গ্রহণের সময় ভোটার ও ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ছয় হাজার সদস্য নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুললেও ভোটকেন্দ্রের ভেতরে তাদের কেনো ধরনের নজরদারি চোখে পড়েনি। নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলা ইটনা, মিঠাইন ও অষ্টগ্রাম। এই তিনটি উপজেলায় ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১১৮টি। উপনির্বাচনের দিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই কেন্দ্রগুলোতে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ভোটার সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটারের সংখ্যা সামান্য বাড়লেও বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি সকালের মতোই ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। একমাত্র ইটনার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের ভূঁইয়ারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ওই কেন্দ্রের ৩০০৪ জন ভোটারের মধ্যে ১৬১০ ভোটার ভোটা দেন, যা ৫৪ ভাগের ওপর নয়। নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী দুই লাখ ৭৭ হাজার ১২৬ জন ভোটারের মধ্যে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের উপনির্বাচনে ১,৬০,৪৩৭ জন ভোটার ভোট দেন। তাদের দেয়া ভোটের হিসাব মতে ৫৮ ভাগ ভোট পড়েছে এই উপনির্বাচনে। উপনির্বাচনের পর্যবেক্ষক, বিদ্রোহী প্রার্থীর ভাষ্য ও সংবাদপত্রের বর্ণনার সাথে নির্বাচন কমিশনের ভোটাধিকার প্রয়োগের এই হিসাবের ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। হাতে গোনা কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি অনুযায়ী ৫৪ ভাগের বেশি ভোট কাস্টিংয়ের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মহিতুল ইসলাম ৪৫টি কেন্দ্রে পেশিশক্তি ও অস্ত্র প্রদর্শন করে তার এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করেছেন। সেসব কেন্দ্রের ভোটের পার্থক্য অনেক। রাষ্ট্রপতির ছেলে তৌফিক ওই কেন্দ্রগুলোর প্রায় সব ক’টিতেই ৭৬ থেকে ৮৩ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। আমার কাছে যেসব তথ্য-উপাত্ত আছে সেগুলো পর্যালোচনা করলে রীতিমতো অবাক হতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে মিঠাইন সদর ইউনিয়নের কেন্দ্রটিতে পুরুষ ও মহিলা ভোটারের ক্ষুদ্র দু’টি লাইন প্রদর্শিত হয়। স্থানীয় ভোটারদের মধ্যে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা পরিলক্ষিত হয়নি। সারা দিনই ভোটকেন্দ্রটি ফাঁকা ছিল অথচ ওই কেন্দ্রে ২২৭০ ভোটের মধ্যে ১৬১২ ভোট বাক্সে কিভাবে জমা পড়লো! সেটি অলৌকিক কোনো হাতের কারসাজি কি না! এই কেন্দ্রে ৭১ ভাগের চেয়ে বেশি ভোট পড়েছে বলে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে। তবে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের ৩ জুলাইয়ের নির্বাচনটি ছিল ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালট বাক্সে সিল মারার মহোৎসব। তবে বিরোধী দল ও গণমাধ্যম এই নির্বাচনের চালচিত্র যতটুকু প্রকাশ করেছে ঘটনা ঘটেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। কয়েকটি কেন্দ্র বাদ দিলে ভোটারবিহীন নির্বাচনে শতকরা সত্তর-আশিভাগ ভোট কাস্টিংয়ের ভৌতিক হিসাব বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে সিল মারার মধ্যযুগীয় চিন্তার এখন অনেক উন্নতি ঘটেছে। কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ভোটারদের ভোট দানে বিরত রাখতে ভয়ভীতি প্রদর্শন, অর্থের বিনিময়ে ভোট ক্রয় ছাড়াও ১০১টি অপকৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে। জনগণের রায় ছিনতাই করার এসব অপকর্ম ছাড়াও শুধু দলীয় সমর্থক সরকারের নির্বাহী প্রধান হিসেবে থাকলে তার আশীর্বাদেই নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যে কোনো কঠিন নয় আমাদের দেশে অতীতে এমন অনেক নজির আছে। উপসংহারে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বর্তমান সরকারের কোনো একজন ব্যক্তির অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা আরো বিপজ্জনক। সেই নির্বাচনে নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচন যে আদৌ সম্ভব নয় সেটি আবারো প্রমাণ করল কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের উপনির্বাচনসহ পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads