বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৩

ক্ষমতার গন্ধ কেমন

রাজনীতি ঈদ ভ্যাকেশনে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব অতিক্রম করছে। এই সময়টিতে রাজপথে উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ কম। একে তো বর্ষাকাল, তার ওপর রোজা। রাজনীতির খিস্তিখেউর যা হওয়ার তা ইফতার সংস্কৃতিকে ঘিরেই হচ্ছে। ঈদ শেষে রাজনীতি যে আবার রাজপথ ধরবে তার আলামত এখন স্পষ্ট। এত দিন সরকারি দল আক্রমণ ভাগে খেলেছে। সামনের দিনগুলোতে সেই খেলা আর একতরফা থাকবে না। ইতোমধ্যে রাজনীতিতে কিছু মাত্রাগত তারতম্য ঘটে গেছে। আওয়ামী লীগ পথ আগলে থাকতে চাইলে বিরোধী দল আর ছাড় দিতে চাইবে না। এর ফলে একটি রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এই দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের পথ ধরলে কেউ হতবাক হবে না। এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাচর্চায় পরিণামদর্শী হয়নি। তারা ভুলের মাশুল বাড়িয়ে তুলতেই যেন বেশি উৎসাহী। প্রতিপক্ষ দমনের ধারাবাহিকতায় কয়েকটি দলকে ইফতার আয়োজনেও বাধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে ভুলের মাত্রা আরো বেশি বাড়ল। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার ভেবেছে ইসলামবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিলে পশ্চিমারা খুশি হবে। ভারত সাহায্য-সহযোগিতা বাড়াবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও বিকশিত হবে। বাস্তবে সরকার যুদ্ধাপরাধের নামে রাজনৈতিক পেন্ডোরার বাক্স খুলে পায়ের তলার মাটি সরিয়ে দিয়েছে। এখন কূটনৈতিক দেউলেপনার কারণে পররাষ্ট্রনীতি মুখথুবড়ে পড়েছে। দীপু মনির অর্ধ হাজারের বেশি হাওয়াই দৌড়ঝাঁপ কোনো সুফল বয়ে আনেনি; বরং বিদেশে বাংলাদেশ বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো শক্তিমান রাষ্ট্র বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে প্রভু সাজতে চাইছে। এখন গুজরাটের মুসলিম ঘাতক হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থী নরেন্দ্র মোদির কাছে ধরনা দিয়েও উপায় মিলছে না। হায়রে ক্ষমতা! বিজেপিও এখন হালাল। দেশে মৌলবাদ ঠেকানো আর ভারতে মৌলবাদ তোষণÑ এ কেমন রাজনীতি? এখন সজীব ওয়াজেদ জয়ের তথ্যতত্ত্বনিয়ে যে আলোচনা চলছে, তা কোনো অসুস্থ রাজনীতির বিষয় নয়; আনকোরা রাজনীতির বিষয়। জয় রাজনৈতিকভাবে পোক্ত কেউ নন। তার বয়স, অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও প্রশ্নাতীত নয়। তার ভেতর দেশজ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকটি এখনো ঠাঁই পায়নি। ফলে মন্তব্য করতে গিয়ে রাজনীতির সীমা ডিঙিয়ে ফাউল করে বসেছেন। বিরোধী দল এমন ফাউল টক হজম করতে যাবে কেন। সঙ্গত কারণেই বিরোধী দল রাজনীতির উল্টো তীরটি যথারীতি ছুড়ে দিয়েছে। এতে হয়তো সজীব তত্ত্বের বধ হয়নি। তবে আওয়ামী লীগকে রক্ষণভাগে ঠেলে দেয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই বিরোধী দলের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ছেলের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে আবার একটি ছোট ফাউল করে বসলেন। তিনি নতুন করে রহস্যময় জরিপ তত্ত্বে ঢুকে পড়লেন। বিগত দুই-আড়াই বছর ধরে প্রায় সব জাতীয় ইস্যুতে জাতীয় দৈনিকগুলোর অন লাইন পাঠকজরিপ প্রকাশিত হচ্ছে। কোনো জরিপেই মহাজোট ও সরকারের পক্ষে সূচক ইতিবাচক নয়। প্রাতিষ্ঠানিক যে কটি ব্যাকরণসিদ্ধ জরিপ হয়েছে, সে গুলোতেও সরকারি দলের ও জোটের অবস্থান তলানির দিকে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলও সরকারি দল ও মহাজোটের পক্ষে যায়নি। তাহলে প্রধানমন্ত্রী কোন জরিপের বরাতে এই মন্তব্য করে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখলেনÑ এ প্রশ্ন ক্ষমতার মালিক জনগণের মনে জাগতেই পারে। সৈয়দ আশরাফ সেই তুলনায় সতর্ক মন্তব্য করলেন। তার পরও গন্ধতত্ত্বের জন্ম দিয়ে মানুষ হাসালেন। এসব শব্দ চয়নের রাজনৈতিক রহস্যের মাত্রাটা বুঝতে চাইলে গণতান্ত্রিক আবহাওয়ায় শব্দগুলোকে ওয়াক থু বলে ছুড়ে ফেলে দেয়া যাবে না। এর ভেতরের একটা না শোনা শব্দ শোনার চেষ্টা করা যেতে পারে। এটা শত ভাগ সত্য, হালে চুপসে যাওয়া কর্মীদের আত্মপ্রত্যয়ী করার কাজটা সহজ নয়। জয়, প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ আশরাফ দলের জনশক্তিকে চাঙ্গা করতে চান। আত্মবিশ্বাসী করতে চান। তাতে এটাও ধরে নেয়া যায়, দলের জনশক্তি আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসী অবস্থায় যে নেই, তা তারাও জানেন। তাদের ভেতর একধরনের হতাশা যে ভর করেছে, তা তো লুকানো যাচ্ছে না। একটি জাতীয় দৈনিক খবর দিয়েছে, বিরোধী দলের রাজনৈতিক কার্যালয় এখন সরগরম হয়ে উঠেছে। রমরমা অবস্থা। ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখছেন অনেকেই। অনেকেই ক্ষমতার স্বপ্নে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও বিদ্রƒপাত্মক মন্তব্য করা হয়েছে। অপর দিকে সরকারি দলের অফিসে আগের অবস্থা নেই, ফাঁকা। কোনো তদ্বিরবাজের ভিড় নেই। নেতারা অফিসে যাচ্ছেন কম, কর্মীরা ছায়া মাড়াচ্ছেন আরো কম। তার ওপর নিজেদের ভেতর খুনোখুনি লেগেই আছে। সর্বশেষ আন্তঃকোন্দলে খুন হলেন যুবলীগ নেতা মিল্কি। এখন যুবলীগ জয়কে ওবামার সাথে তুলনা করলেই কী, আর বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করলেই বা কী। তাকে রংপুর থেকে নির্বাচন করাওয়ার ঘোষণা দিলেও বাড়তি লাভ নেই। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারের একটা গুরুত্ব অবশ্যই আছে। তবে সময়বলে একটা কথা আছে। তা ছাড়া শেখ রেহানা প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে জয়ের জয়কার হওয়ার নয়। এটাও ভাবতে হবে, আজকের সময়টা সেই রক্তধারার কথা বলে কতটা বেগবান করা যাবেÑ তা কোনো ছোট প্রশ্ন নয়। মহাজোট সরকার ধনুকভাঙা পণ করে যদি ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, তা রাজনীতিকে অনিবার্যভাবে সঙ্ঘাতমুখী করবেই। সেই সঙ্ঘাতের সুফল কার ঘরে উঠবে তা বলা কঠিন। তবে মহাজোট সরকার যেভাবে বাস্তবতা আড়ালে ঠেলে দুয়ে দুয়ে চারের মতো অঙ্ক মিলাতে চাচ্ছে, তা হওয়ার নয়। কারণ ভাটার সময় জোয়ারের গল্প জনমনে দাগ কাটে না। বাংলাদেশের মানুষকে অবজ্ঞা করে নরেন্দ্র মোদিদের পদধূলি নিতে দূত পাঠালে জনগণ বাহাবা দেবে কেন? অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করছেন, বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। সরকারি দল ও জোটের জনপ্রিয়তা কমেছে। এ ধরনের রাজনৈতিক মূল্যায়ন হয়তো ঠিক। কিন্তু নেগেটিভ ভোটের কথাও যদি বলা হয়, তাহলে তা কোন দিকে ঝুঁকছে তাও তো দেখার বিষয়। তা ছাড়া বিরোধী জোটের জনপ্রিয়তা বাড়েনি, ভোট বেড়েছেÑ এর অর্থ কী দাঁড়ায়, তা বুঝার মতো রাজনৈতিক জ্ঞান এ দেশের মানুষের রয়েছে। এত কিছুর পরও হাভভাব, আচার-আচরণ ও বক্তব্য-বিবৃতি প্রমাণ করছে, আওয়ামী লীগ নিজের নাক কেটে হলেও পরের যাত্রা ভঙ্গের শেষ চেষ্টা চালাবে। তারা বিরোধী দলকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ না দেয়ার জন্য সংবিধান ও গণতন্ত্র বধ করার ঝুঁকিও নিতে চাইবে। আবার বিরোধী দলও কিছু গণভিত্তি পেয়ে যাওয়ার কারণে প্রবলভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক সমঝোতার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ হলে রাজনীতি ইউটার্ন করে বাঁক ঘুরে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শক্তিমান আম্পায়ার কিংবা রেফারি ছাড়া স্থিতিশীল পরিস্থিতি আশা করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পররাষ্ট্রনীতি সাজানোর চেষ্টা করে যেসব দেশ কলকাঠি নাড়ে তারা এখন সক্রিয়। তারা সক্রিয় হলে সুফল পায় প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি, তারপর বিরোধী দল, নয়তো তৃতীয় শক্তি। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে ভালো, না থাকলে অন্য কারো হাতে যাক তাতে আপত্তি নেই, তবে কোনোভাবেই যাতে বিরোধী দলের হাতে না যায় তা নিশ্চিত করতে মরিয়া। জয়ের নিশ্চিত বিজয়ের তথ্য’, প্রধানমন্ত্রীর জরিপ’, সৈয়দ আশরাফের ক্ষমতার গন্ধ’, যুবলীগের ওবামা দর্শনকে অনেকেই সেভাবে বুঝতে চান। এখন জনগণ জানতে চাইবে ক্ষমতার গন্ধ কেমন। তথ্যের উৎস কী। জরিপটির জন্মবৃত্তান্ত ও কুষ্ঠিনামা কী! এত সব প্রশ্নের জবাব দেয়া যতটা কঠিন, জনগণের মন জয় করে আবার ক্ষমতার বৃত্তে ফিরে আসাটাও ততটা কঠিন। 


0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads