মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই, ২০১৩

শেষ মুহূর্তেও আওয়ামীকরণে তছনছ হচ্ছে জনপ্রশাসন


শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই যে সর্বাত্মক দলবাজি চালানো হচ্ছে এবং আওয়ামীকরণ করতে গিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থও যে লাটে ওঠানো হচ্ছে গুরুতর এ অভিযোগ উঠেছে দেশপ্রেমিক বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে। কথাটা আমরাও বলেছি কিছু উপলক্ষে বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা যখন জনপ্রশাসনের ওপর চড়াও হয়েছেন। আমরা এখনও মনে করি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই জনপ্রশাসনকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখা দরকার। অন্যদিকে মহাজোট সরকার পদোন্নতি ও নিযুক্তির ক্ষেত্রে সব সময় দলীয় বিবেচনায় চালিত হয়েছে। এমন অবস্থায় সরকারের সমর্থক না হওয়ার কারণে অনেককে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে এখনো হতে হচ্ছে। অনেককে নানা পন্থায় বঞ্চিত ও অসম্মানিতও করছে সরকার। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সরকার নিজে থেকে দুটি পক্ষ তৈরি করে নিয়েছে। প্রথম পক্ষে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত অফিসাররা। মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকুক না থাকুক সরকারের সমর্থক অফিসাররা উপ-সচিব থেকে সচিব পর্যন্ত বিভিন্ন পদে পদোন্নতি ও নিযুক্তি পেয়েছেন, এখনো পাচ্ছেন। অনেক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দিয়েছে সরকার। তাদের বিভিন্ন দফতর, অধিদফতরের শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে। ধর্মীয় পরিচিতিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এসেছে সরকার। সচিবসহ একশ’রও বেশি পদে বসানো হয়েছে বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অফিসারদের। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের পাশাপাশি ইউএনও এবং এসি ও ওসিসহ পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদেও বেছে বেছে বিশেষ ধর্মের লোকজনকেই বসিয়েছে সরকার। অথচ জনসংখ্যার অনুপাতে এবং যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসহ চাকরির শর্তপূরণের বিচারে এত বেশিসংখ্যক অমুসলিম অফিসারের এভাবে পদোন্নতি এবং স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তি পাওয়ার কথা নয়। এর ফলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার শিকড়ই শুধু দৃঢ়মূল হচ্ছে না, আওয়ামী লীগ সমর্থক মুসলমান অফিসারদের মধ্যেও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে। এসব বিষয়ে নিন্দা-সমালোচনা কম হয়নি। কিন্তু এখনো সরকারের নীতি ও কার্যক্রমে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এ সম্পর্কিত সর্বশেষ প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ১৮ জুলাই। সরকার সেদিন এক সঙ্গে ৩২৬ জন উপসচিবকে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছে। আপত্তির কারণ হলো, ৩২৬ জনকে পদোন্নতি দেয়া হলেও যুগ্ম-সচিব পদের অনুমোদিত সংখ্যা কিন্তু ৩৬৮টি। ৩২৬ জনকে পদোন্নতি দেয়ার পর এই পদে অতিরিক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৯৫ জনে। এছাড়া ২৫০ জন কর্মকর্তা আগে থেকেই পদের অতিরিক্ত রয়েছেন। অর্থাৎ পদ ৩৬৮টি হলেও বর্তমানে যুগ্ম-সচিবদের সংখ্যা পৌঁছে গেছে ৮৯১ জনে। ওদিকে এবারও বঞ্চিত হয়েছেন ৩৫৪ জন যোগ্য কর্মকর্তা বিভিন্ন মানদ-ে যাদের পদোন্নতি অনেক আগেই প্রাপ্য হয়ে রয়েছে। বাদ পড়ারা লেফট আউট হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে তারা ভবিষ্যতেও পদোন্নতি পাবেন না।
বলা দরকার, যুগ্ম-সচিব পদে শুধু নয়, প্রশাসনের ওপরের দিকে অন্য সব পদেও নির্ধারিত বা বরাদ্দ করা পদের চাইতে কর্মকর্তা অনেক বেশি রয়েছেন। যেমন উপ-সচিবের পদ যেখানে রয়েছে ৮৩০টি সেখানে সরকার দফায় দফায় পদোন্নতি দেয়ায় উপ-সচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭০৯ জনে। ওপরের দিকে এভাবে পদোন্নতি দেয়ার ফলে নিচের তথা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অফিসারের সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে। যেমন  সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ যেখানে ১৮০০ সেখানে আছেন ১৪৩০ জন। সহকারী কমিশনারের অর্ধেকের বেশি পদও বেশ কিছুদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে। আপত্তির অন্য একটি কারণ হলো, বর্তমান সরকারের আমলে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেয়ার কারণে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যখন একজন উপ-সচিব যুগ্ম-সচিব হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু পদ না থাকায় তাকে আগের মতো উপ-সচিবের দায়িত্বই পালন করতে হচ্ছে, না হলে তাকে ওএসডি বানিয়ে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। ওদিকে কাজ উপ-সচিবের করলেও বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার সবই কিন্তু তাকে যুগ্ম-সচিবেরই দিতে হচ্ছে। অথচ ২০০২ সালে সংশোধিত চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী পদ না থাকলে বা পদ সৃষ্টি না করা হলে ওই পদের জন্য পদোন্নতি দেয়া যায় না। কিন্তু  বর্তমান সরকার প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই ন্যক্কারজনক দলবাজি চালিয়ে এসেছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এখন চলছে প্রশাসনকে নিজেদের মতো করে ঢেলে সাজানোর কর্মকা-। সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও নিযুক্তি দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। বিপরীতভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে, এখনো চাকরি হারাচ্ছেন অনেকে। মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকা সত্ত্বেও বহু অফিসারকে পদোন্নতি দেয়া হয়নি। তাদের সংখ্যা দুই হাজারের ওপরে পৌঁছে গেছে। লজ্জা, দুঃখ ও অপমানে  অনেকে চাকরিই ছেড়ে দিয়েছেন।
দলীয়করণ করতে গিয়ে এভাবেই প্রশাসনকে তছনছ করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারের দলবাজিতে অচল হয়ে পড়েছে প্রশাসন। শুধু রাষ্ট্রীয় বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তথা সচিবালয়ে নয়, সরকার জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও প্রতিটি ক্ষেত্রে নগ্নভাবেই দলবাজি চালাচ্ছে। এর পাশাপাশি চাকরিচ্যুত ও ওএসডি করার এবং বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ফলেও প্রশাসনে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে। কোনো পর্যায়ের কোনো অফিসারের পক্ষেই নিশ্চিন্তে ও নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য অবশ্য খুবই স্পষ্ট। তারা এমনভাবেই প্রশাসনকে সাজিয়ে রেখে যেতে চাচ্ছেন যাতে আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলীয় আমলাদের সহযোগিতায় তারা সহজেই জিতে আসতে পারেন। এখানেই জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে আপত্তি উঠেছে। জনপ্রশাসনকে তছনছ ও ল-ভ- করার মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা দেশকেই আসলে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আমরা তাই জনপ্রশাসনে আওয়ামীকরণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানাই এবং মনে করি, পদোন্নতি দিতে হবে মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটির ভিত্তিতে। কোনো দলবিশেষের প্রতি নয়, কর্মকর্তাদের আনুগত্য থাকতে হবে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি।
অভিযোগ উঠেছে, অর্থনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লি¬ষ্ট বিভিন্ন করপোরেশনের শীর্ষ পদে আসীন এসব অমুসলিম অফিসারের অনেকে রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য পাচার করে দিচ্ছেন। তাদের দেশপ্রেমহীন কার্যকলাপে জাতীয় অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটছে, বিঘিœত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads