সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতিপর্বের সময়সূচি নির্দেশ করে সরকারপ্রধান ও মতাসীন মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনা ৬ জুন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে ঘোষণা দেন : ‘আগামী ২৫ অক্টোবর নবম জাতীয় সংসদের শেষ কার্যদিবস। এরপরই নির্বাচন আয়োজন করা হবে। নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে।’ ঘোষিত ওই সময়সূচির মাত্র চার মাস ১০ দিন আগে ১৫ জুন দেশের শীর্ষ চার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের। মতাসীন আওয়ামী লীগ এখন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের (জিসিসি) বিজয় নিজের ঘরে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। লুকোচুরির বালাই চুকিয়ে প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রী হস্তপে করে চলেছেন এই নির্বাচন প্রক্রিয়ায়। নির্দলীয় এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মহাজোটের পে একক প্রার্থী দেয়ার ল্েয তিনি তার দলেরই দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছেন। সে সম্পর্কে পত্রিকান্তরে একটি চিত্রলেখ প্রতিবেদন : মনোনয়নপত্র বাতিলের পর আপিল। তারপর আদালতের নির্দেশে প্রতীক পেয়ে বিশাল আয়োজনে প্রচার শুরু। কিন্তু সেদিন রাতেই প্রার্থী ‘গায়েব’। প্রচার করা হলো, প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এরপর কর্মী-সমর্থকদের উৎকণ্ঠা। নানা গুজব। অবশেষে পাঁচ দিন পর হাজির হলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে ঘোষণা দিলেন, তিনি আর ভোটের লড়াইয়ে নেই। প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ২৩ জুন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে এবং দলের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন : ‘আমি চেয়েছিলাম নতুন এ সিটি করপোরেশনকে নতুনভাবে সাজাতে। কিন্তু ভাগ্য আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় চলতে হবে। হাসিনা আমার মায়ের মতো। তার প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে ভিশন-২১ বাস্তবায়নের জন্য আমি ১৪ দল প্রার্থীর প্রতীক দোয়াত-কলমে আপনাদের কাছে ভোট চাই। গাজীপুর সিটিকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। দলের ও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করতে আমি হাসপাতাল থেকে অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খানকে সমর্থন জানাতে গাজীপুর এসেছি।’
এভাবেই গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আলোচিত প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে নাটকের অবসান হলো। কিন্তু নাটক কি আসলেই শেষ হলো? সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরের কান্না গাজীপুর নগরবাসীদের আরও বিমুখ করে তুলেছে সরকারি প্রার্থীর প্রতি। গাজীপুরের সাধারণ ভোটারেরা শাসক দলের এই নাটককে মোটেও ভালোভাবে নেননি।
তাদের প্রশ্ন, কেন সময় থাকতেই জাহাঙ্গীরের সাথে সমঝোতা করা হয়নি। প্রথমে মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশনে বাতিল, আদালতে বহাল, তারপর ডেকে নিয়ে চাপ, হুমকি, তারপর হাসপাতালে ভর্তি, এসব কী? প্রধানমন্ত্রী কেন একটা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এমন অন্যায় প্রভাব খাটালেন? এটা কি নির্বাহী মতার অপব্যবহার নয়? অন্য দিকে গাজীপুরের রিটার্নিং কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান জানিয়েছেন, নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও ব্যালটে প্রার্থী জাহাঙ্গীরের নাম ও আনারস প্রতীক থাকবে। কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি এ ঘোষণা দেননি।
তারপর ২৬ জুন জাহাঙ্গীর নিজেই সরকারি প্রার্থী আজমতের বাসায় যান এবং পরে দোয়াত-কলমের পে কিছু সময় প্রচারণাও চালান। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আজমত উল্লাহ আমার বড় ভাই এবং আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী। দোয়াত-কলম আমার মার্কা, দোয়াত-কলম মার্কায় ভোট দিয়ে আজমত ভাইকে জয়যুক্ত করুন। আমরা একসাথে কাজ করে গাজীপুরকে আধুনিক মডেল নগরী হিসেবে গড়ে তুলব।’
ইতোমধ্যে আজমতকে বিজয়ী করতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামেন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। কিন্তু মাঠপর্যায়ে এসে তারা দেখতে পান ভিন্ন চিত্র। সরেজমিন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড দেখেছেন, আজমতের জনপ্রিয়তা টঙ্গী ছাড়া সিটির অন্য কোনো এলাকায়ই নেই। কিন্তু জাহাঙ্গীরের বিচরণ রয়েছে গাজীপুরের সর্বত্র। কারণ তিনি ভাওয়াল ও টঙ্গী কলেজের ছাত্র, সদরের বাসিন্দা এবং ওই উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়া গাজীপুরের ব্যবসায়ী সমাজের সাথে তার সখ্য। ২০০৯ সালে সদর উপজেলা পরিষদে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রায় তিন লাখ ভোট পেয়ে জয়ী হন জাহাঙ্গীর। এখন জাহাঙ্গীর সরে দাঁড়ালেও তার সমর্থকেরা নিজ খরচেই চালিয়ে যাচ্ছেন আনারসের প্রচারণা। তাদের সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী আবারো ডেকেছেন জাহাঙ্গীর আলমকে; সরকারি প্রার্থীর পে প্রচার জোরদার করতে বলেছেন। সিটি নির্বাচনে মাঠে হাজির হয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
কিন্তু অন্য দিকে মহাজোটেও ফাটল ধরেছে। সেজন্য ২৭ জুন প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদ ভবনের কার্যালয়ে মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন শেখ হাসিনা। তিনি গাজীপুর মেয়র নির্বাচনে সরকারি প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানের প্রতি জাতীয় পার্টির সমর্থন চাইলেন প্রায় ১ ঘণ্টা মিটিং করে। তবুও কাজ হলো না। ২৯ জুন দলীয় এক তৃণমূল কর্মী সম্মেলনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জাঁদরেল এরশাদ প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিলেন : ‘আমাদের অনেক অবহেলা করেছেন। এখন ডাকলে সাড়া পাবেন না। আমরা একলাই থাকব, একলাই জাতীয় নির্বাচন করব। আমরা আর মহাজোটে নেই। আমাদের সাথে আসন বিন্যাসে অবিচার করা হয়েছে। প্রত্যাশিত মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্যপদ দেয়া হয়নি। আমরা বিচারপতি চেয়েছিলাম, দেয়া হয়নি। সরকারি কৌঁসুলি চেয়েছিলাম, দেয়া হয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন নোবেল বিজয়ী। পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষ তাকে সম্মান করে; অথচ আওয়ামী লীগ সরকার তাকে সম্মান করেনি। সরকার নির্বাচনের আগে আগে চট্টগ্রাম ভূমি সংস্কার আইন করেছে। কোনো দরকার ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামে অসংখ্য বাঙালি আছে। তারা আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। কুইক রেন্টালের নামে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দেয়ার পরও দেশে লোডশেডিং কমেনি। জাতীয় পার্টির শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশে মোট ৯ জন মারা গিয়েছিল। আজ প্রতি মিনিটে ৯ জন করে মানুষ মারা যায়। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারির কারণে বিশ্বের দরবারে আমাদের মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। হলমার্ক চার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। এর সাথে সরকারের এক উপদেষ্টা জড়িত ছিলেন, তা সবাই জানে। অথচ তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। উল্টো বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চার হাজার কোটি টাকা কিছু না। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির মূল হোতা আজো প্রধানমন্ত্রীর আশপাশে ঘোরে। তাকে শাস্তি দেয়া হয়নি। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা এক কোটি বিনিয়োগকারী আর আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। আপনারা আজ মতা ছাড়তে ভয় পাচ্ছেন। কারণ মতা ছাড়লে বাড়িতে আগুন লাগতে পারে। গায়ে গুলি লাগতে পারে। মারা যেতে হতে পারে। তাই আপনারা মতা ছাড়তে চান না। কিন্তু সেদিন শেষ হয়েছে। নির্বাচন দিতেই হবে।’
আর সরেজমিনে গাজীপুরে স্থানীয় জাতীয় পার্টি নেতারা বললেন, “আমাদের অধিকাংশ জনবল ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীর পে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে আসছিল। দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও তৃণমূলের এই মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন। তার মনোভাব জেনে আমরা আগেই ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীকে মৌখিক সমর্থন জানিয়েছি। এখন ‘গাজীপুরে আমরা মহাজোটের সাথে নেই’ এরশাদের এই ঘোষণায় টঙ্গী ও গাজীপুরের জাতীয় পার্টি উজ্জীবিত হয়ে সর্বশক্তি নিয়ে ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীর প্রতীক টেলিভিশনের পে প্রচারণায় নেমেছে।”
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টির জেলা সভাপতি কাজী মাহমুদ হাসান প্রথমে মেয়র পদে প্রার্থী হলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে যান। এর পরই জাতীয় পার্টির অনেক নেতাকর্মী বিএনপির প্রার্থীর পে কাজ শুরু করেন। ২৭ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যে বৈঠক করেন, তাতে প্রথমে এরশাদ এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দানের আশ্বাস দিলেও কর্মীদের কথায় মাহমুদ হাসান আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পে মাঠে নামা আত্মঘাতী সাব্যস্ত করেছেন। ২৯ জুন জেলা ও সাবেক গাজীপুর পৌরসভার আটটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে মাহমুদ হাসান তার বাসায় জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে জাপার সব নেতাকর্মী ১৮ দল সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের জন্য কাজ করার পে মত দেন। এই সিদ্ধান্ত ১ জুলাই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়।
এসব প্রতিকূলতায় সরকারপ দমেনি। আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে আর গাজীপুরের পোশাক কারখানার মালিক শ্রমিক ঝুট ব্যবসায়ীদের হাত করে বাজিমাত করার মতলব ফেঁদেছে। সরকারপরে হিসাব : গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় চার শতাধিক পোশাক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার শ্রমিকেরা বেশির ভাগই সিটি নির্বাচনে ভোটার, যা মোট ভোটারের এক-তৃতীয়াংশ। অবশ্যই তাদের রায় প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। সরকার গাজীপুরের আওয়ামী ভাবাপন্ন মালিকানাধীন সব পোশাক কারখানার ব্যাংকিং সমস্যা ইত্যাদি মিটমাট করে দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রভাব খাটিয়ে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে অতিরিক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করেছে। এসব কারখানায় আগাম ঈদ বোনাস, নির্বাচন বোনাস দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে শ্রমিকদের জন্য। আর লাইনম্যান, সুপারভাইজারদের উপরি দিয়ে হাত করেছে সরকারপ। তাদের বলতে শেখানো হয়েছে, সরকার আমাদের জন্য এত কিছু করেছে; এখন এর বদলে সরকারের দাবি শুধু একটাইÑ আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থীকে ভোট দিতে হবে। আরও প্রচার, ১৮ দলের মেয়রপ্রার্থীকে ভোট দিলে মহিলা শ্রমিকদের হেফাজত ঘরে ফিরে যেতে বলবে, চাকরি করতে দেবে না। জিএসপি সুবিধা হারিয়ে কোনো বিপদ হবে না। রিজিকের মালিক আল্লাহ। এক দেশ থেকে কাজের অর্ডার বন্ধ হলে অন্য দেশ থেকে অর্ডার আসবে। তাই স্বাধীনতার পরে শক্তিকে বিজয়ী করতে হবে। এভাবে শ্রমিকদের ভোট বাগাতে আওয়ামী লীগপন্থী গার্মেন্ট মালিক, বাড়িওয়ালা, গার্মেন্টের ঝুট, টিফিনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা একটি বড় ভূমিকা রাখছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী প্রায় দুই লাখ পোশাকশ্রমিকের ৬০ ভাগ ভোট পাবে বলে জানান পোশাকশ্রমিক নেতা একতা শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কফিল উদ্দিন। তার মতে, গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত পোশাকশ্রমিক ভোটারেরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর প্রতীক দোয়াত-কলমে ভোট দেবেন। কারণ ১৮ দলীয় জোটে ভোট দিলে জামায়াত ও হেফাজতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হবে। মহিলা শ্রমিকদের কাজ করতে দেবে না হেফাজত।
স্থানীয় পোশাক কারখানাগুলোর ঝুট ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রলীগ, যুবলীগ মালিকপরে লাঠিয়াল বাহিনীর কাজ করে। আন্দোলনরত নিরীহ শ্রমিকদের মারধর করে। বেতনের পর রাস্তার মোড়ে মোড়ে চাঁদাবাজির হামলা করে শ্রমিকদের টাকা ছিনিয়ে নেয়। তা ছাড়া শ্রমিক নির্যাতন, মৃত্যুপুরী রানা প্লাজা, অগ্নিদগ্ধ তাজরীন ফ্যাশনস এসব ঘটনার সমুচিত জবাব শ্রমিকেরা দিতে পারেন নির্বাচনে। অপর দিকে প্রশাসনকে নেপথ্যে কিংবা প্রকাশ্যে সরকারি মেয়রপ্রার্থীর পে কারসাজি ও প্রচারে লিপ্ত করছে মতাসীন দল। ৩০ জুন রাতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলে সরকারি ও আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা গাজীপুরে চান্দনা হাইস্কুলের হলরুমে গোপন বৈঠক করেছেন। সরকারদলীয় প্রার্থীর পে প্রচারণা ও নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে আলোচনা করেন বৈঠকে অংশ নেয়া কর্মকর্তারা। বৈঠকের খবর পেয়ে গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মী সংবাদ সংগ্রহে ঘটনাস্থলে পৌঁছলে বৈঠককারীরা দ্রুত সরে পড়েন। বৈঠকের অন্যতম উদ্যোক্তা ও গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্য এম এ বারী বলেন, বঙ্গবন্ধু শিা ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা এবং আশপাশ উপজেলার নেতাদের নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে আজমত উল্লাহ খানের পে কী প্রক্রিয়ায় প্রচারণা চালানো যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
অবশ্য ওই বৈঠকের আগেই সরকারি কর্মচারীদের আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পে মাঠে নামানো হয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ (ইফাবা), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ গাজীপুর, কালিগঞ্জ, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর এলাকায় অবস্থিত সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠে প্রচারণায় অংশ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রচারণায় না থাকলে চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। হেফাজতকে ঠেকাতে ইফাবার ইমামদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের কাজের মনিটরিং করছেন ইসলামির ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সমন্বয় বিভাগের পরিচালক হারুন অর রশীদ।
এ ছাড়া মতাসীন দলের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে প্রতিদিনই ডজনখানেক কেন্দ্রীয় নেতা গাজীপুর চষে বেড়িয়েছেন।
গাজীপুরের সব এমপি এলাকা ভাগ করে প্রচারণায় মাঠে আছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দলীয় মনোভাবাপন্ন শিক এবং কর্মকর্তাদের প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য তালিকা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়ে বসিয়ে দেয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে যেমন ােভের সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামতে বাধ্য করায় তারাও মনে মনে ুব্ধ। ইমামদেরও আজমত উল্লাহ খানের প্রচারণায় নামতে বলা হয়েছে। কয়েক হাজার ইমাম, মুয়াজ্জিন, ইফাবা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রকল্পের জনবলকে আওয়ামি লীগ প্রার্থীর পে প্রচারের নির্দেশনা দিয়ে প্রত্যেককে ওয়ার্ড ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এভাবে ঢাকার আশপাশের প্রায় ১০ হাজার সরকারি জনবলকে এ প্রচারণায় নামানো হয়েছে। আর ইফাবার নতুন কিছু উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক নেয়া হয়েছে। তারাও এলাকা ভাগ করে মনিটরিং করছেন। অনিচ্ছুক কর্মচারীদের ধমকানো হচ্ছে, চাকরি নিয়ে সমস্যা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। তাদের হাতে উড়ো চিঠি আর হ্যান্ডবিল ছড়ানো হচ্ছে, যাতে ১৮ দলীয় প্রার্থীর চরিত্রহনন, হেফাজতের বিরুদ্ধে নারী অধিকারের বিরুদ্ধতার অভিযোগ আর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পোশাকশিল্প ধ্বংসের জন্য মার্কিন কর্তৃপরে কাছে জিএসপি প্রত্যাহারের সুপারিশের দোষারোপ করে কুৎসা রটনা চলেছে সমানে।
নির্বাচন কমিশন প্রাক-নির্বাচনী ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে দলমত নির্বিশেষে চিহ্নিত অপরাধী, চাঁদাবাজ, মাস্তান, অস্ত্রবাজ, ডাকাত দল ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছে। কারো বিরুদ্ধে যেন হয়রানিমূলক বা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় সে জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছে। কিন্তু প্রশাসন স্থবির। সরকার নির্বাচনী বিধিমালা অগ্রাহ্য করে নির্বাচন কমিশনকে না জানিয়েই একাধিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে হঠাৎ বদলি করেছে বা দায়িত্বভার বদলে দিয়েছে। কোনো উচ্চবাচ্য করেনি নির্বাচন কমিশন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সংসদীয় মুখপাত্র ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ এজেন্ট। এই কমিশন নখদন্তহীন। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হলে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা মৌখিকভাবে প্রত্যাহার করে অপর প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ার প্রকৃত ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করত।’
এলাকায় অঢেল চকচকে ুদ্র আগ্নেয়াস্ত্রের আমদানি সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়ে সহিংসতার আশঙ্কায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন (জিসিসি) নির্বাচনে সব সরকারদলীয় প্রিজাইডিং অফিসার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এরপরও সরকার আশ্বস্ত হতে পারছে না। তারা এখন নির্বাচনে ভোট ডাকাতির উদ্দেশ্যে গাজীপুরে ব্যাপকহারে অস্ত্র ঢোকাচ্ছে। এ অবস্থায় জিসিসি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সেনা মোতায়েনের ব্যবস্থা নিতে হবে।’
‘গাজীপুর সিটিতে নির্ধারণ হবে দেশে গণতন্ত্র থাকবে কি না। চার সিটির জনগণ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দেয়ার পর সরকার গাজীপুরের জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু সরকারকে বলে দিতে চাই, গাজীপুরে ভোট জালিয়াতি বা ফল নিজেদের পে নেয়ার অপচেষ্টা করলে সে দিন থেকেই সরকারের পতন শুরু হবে।’
ইতঃপূর্বে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম নিখোঁজ থাকায় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছিলেন ১৮ দলীয় প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান। তবে এই দাবি নাকচ করে দেন ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে ২৩ জুন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারের নেতৃত্বে দুই সদস্যের প্রতিনিধিদল কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সাথে সাাৎ করেন। সিইসির সাথে বৈঠক শেষে বিএনপি নেতা এম কে আনোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুরে সেনা মোতায়েন না করলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তাই আমরা সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছি।’
বিএনপির এই দাবি প্রসঙ্গে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সেনা মোতায়েনের দাবির কথা বিবেচনায় থাকবে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তথা, আশ্বাস মিলেছে, কাজ হয়নি। তারপর খোদ সংসদীয় বিরোধী দলনেতা মুখ খুলেছেন। তার গুলশান কার্যালয়ে ২৬ জুন বেগম খালেদা জিয়া প্রকারান্তরে বলেছেন, চার সিটি করপোরেশনে হাসিনা প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে প্রমাণিতÑ এমন দাবি করে প্রধানমন্ত্রী মুখরা করছেন মাত্র। ওই চার সিটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। সুষ্ঠু হলে সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতো। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন নিরপেভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। গাজীপুর নির্বাচনে এখনো তাদের নিরপেতার প্রমাণ দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই আমি আশা করব, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে অবিলম্বে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
বাস্তবিক গাজীপুর সিটি নির্বাচন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের জন্য শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে। হেরেও আর প্রমাণ করা যাবে না, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেভাবে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সুযোগ সমতা দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। জিতলে প্রমাণ হবে, মোটা দাগের কারচুপি হয়েছে; বাকশালী মনোভাবের এই সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একেবারেই সম্ভব নয়।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন