গাজীপুর সিটি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা বোধ হয় আরো কিছুদিন চলবে। এ নির্বাচনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে প্রতিদিনই নতুন নতুন বিষয বেরিয়ে আসছে। এই আলোচনায় জড়িয়ে গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির নেতা এইচ, এম এরশাদও। পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছে, ‘দুই নৌকায় পা দিয়ে মহাবেকায়দায় এরশাদ।’ এই শিরোনামের সংবাদে বলা হয়েছে, সদ্য সমাপ্ত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ইস্যুতে মহাবেকায়দায় পড়েছেন মহাজোট সরকারের শরীক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। নির্বাচনে ১৪ দলের মেয়রপ্রার্থী এডভোকেট আজমতউল্লাহ খান ১৮ দলের প্রার্থী এম, এ মান্নানের কাছে বিপুল ভোটে হেরে যাওয়ায় বিপদ বেড়েছে এরশাদের। তিনি নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন ঘোষণা করেন। অথচ তার দলের নেতা-কর্মীরা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থী এম, এ মান্নানের পক্ষে। অভিযোগ উঠেছে, এরশাদ প্রকাশ্যে সরকারি দলের প্রার্থীকে সমর্থন দিলেও গোপনে বিরোধী জোটের প্রার্থীকেই সমর্থন জুগিয়েছেন। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভোট আজমতউল্লাহ পাননি বলেই মনে করছে আওয়ামী লীগ। ফলে এখন কড়া নজরদারিতে রয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ।
আমরা জানি জন্মগতভাবেই মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয়। মানুষ স্বাধীন মত প্রকাশ করতে ভালোবাসে। তাই গণতন্ত্র মানুষকে স্বাধীনভাবে সংগঠন করা ও মত প্রকাশ করার নিশ্চয়তা দেয় কিন্তু গাজীপুর সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এরশাদ যা করলেন বা তাকে দিয়ে যা করানো হলো তাতে গণতন্ত্রের সুবাতাস লক্ষ্য করা যায়নি। বরং বিষয়টি জনমনে বিরক্তির উৎপাদন করেছে। লজ্জায় ও অপমানে সংক্ষুব্ধ হয়েছে জাতীয় পার্টির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও। জাতীয় পার্টি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এরশাদকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ১৪ দলের প্রার্থীর পক্ষে সমর্থন দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয় ফোনে। অন্যথায় জেনারেল মঞ্জু হত্যা মামলার জামিন বাতিল করাসহ পুরানো মামলাগুলোও পুনরুজ্জীবিত করার হুমকি দেয়া হয়। ফলে চাপের মুখে এরশাদকে এমন জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে ১৪ দলের প্রার্থীকে সমর্থন দিতে হয়েছে। বিষয়টি জাতীয় পার্টির জন্য বেশ অপমানকর বলে মনে হয়েছে। জাপার একাধিক সিনিয়র নেতা ক্ষোভের সাথে বলেন, সরকারের বিভিন্ন স্তরে লাগামহীন দুর্নীতি, গুম-হত্যা, নির্যাতন বিরোধী দলকে দমন-পীড়নসহ নানা কারণে সরকারের প্রতি মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সরকারের ওপর থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসলেও সরকারের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে। আগের সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরেছে সরকারি দল। একই ধারাবাহিকতায় তারা হেরেছে গাজীপুরেও। অথচ নিজেদের দুর্বলতা ও ব্যর্থতাকে আড়াল করতেই এখন জাতীয় পার্টি ও এরশাদকে দায়ী করা হচ্ছে। জাপা নেতাদের প্রশ্ন, এরশাদ ও জাতীয় পার্টি যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তাহলে এত অবহেলা কেন? আগে গুরুত্ব দিলে তো আর নতুন করে সমর্থনের প্রশ্ন উঠতো না।
আমরা জানি যে, আর কিছুদিন পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের অবস্থা কেমন হবে তা এখনই উপলব্ধি করা যাচ্ছে। গত ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীদের যে শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে, তাতে জোটের শরিকদের মধ্যে আশঙ্কার সাথে সাথে নতুন ভাবনারও সৃষ্টি হতে পারে। বিগত বছরগুলোতে সরকার এবং সরকারদলীয় লোকজন যে সব কর্মকা- করেছে তাতে শুধু জনগণই নয়, সংক্ষুব্ধ হয়েছে জোটের শরিকরাও। কেউ কেউ সে কথা প্রকাশ্যে বলেছে, আবার অনেকেই প্রকাশ্যে বলার সাহস পায়নি। সরকারদলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক জাতীয় পার্টি মাঝেমাঝেই তাদের অসন্তুষ্টি ও বঞ্চনার কথা প্রকাশ করেছে। আর এখন নির্বাচনের কাছাকাছি সময়ে এসে দুই নৌকায় পা দেয়ার কৌশল অবলম্বন করেছেন জাতীয় পার্টির নেতা এরশাদ। আদর্শবাদী কোনো দলের কোনো শীর্ষ নেতা এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। আর কাউকে বেকায়দায় ফেলে ন্যায়নিষ্ঠার বদলে চাতুর্যের রাজনীতি করাও কোনো দায়িত্ববান ও গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হতে পারে না। গাজীপুর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার ও এরশাদের যে আচরণ আমরা লক্ষ্য করলাম তা গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য লজ্জাকর। গাজীপুর নির্বাচনের উত্তেজনা এখন আর নেই। ফলাফলও হয়ে গেছে। এখন তো তারা ভেবে দেখতে পারেন, কি কি ভুল তারা করেছেন। আত্মসমালোচনায় সমর্থ হলে সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ ভুল উপলব্ধি করতে পারবেন। এখন দেখার বিষয় হলো, ভুলের সংশোধনে তারা এগিয়ে আসেন কিনা।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন