শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৩

রাজনীতির বলির পাঁঠা গোলাম মাওলা রনি


শেষ পর্যন্ত বেশ নাটকীয়ভাবেই গ্রেফতার করা হলো আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনিকে। গত ২০ জুলাই রনি তোপখানা রোডের নিজ অফিসের সামনে ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের দুই সাংবাদিককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। রনি নিজে ফিল্মি কায়দায় সাংবাদিকদের যে লাথি মেরেছিলেন, তার সচিত্র প্রতিবেদন দেখানো হয় দেশের প্রায় সব ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। সরব হয়ে ওঠে প্রিন্ট মিডিয়াসহ সব গণমাধ্যম। ঘটনার চার দিনের মাথায় ২৪ জুলাই আদালতের নির্দেশে গ্রেফতার করা হলো রনিকে। যদিও এর আগে রনি আগাম জামিন নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সাংবাদিককের আন্দোলনের মুখে এবং মামলার বাদিকে হুমকি দেয়ার দায়ে জামিন বাতিল ও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় রনির বিরুদ্ধে। ঘটনার দিন থেকেই প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই অন্যতম শিরোনাম হয়ে আসছে রনির সাংবাদিক নির্যাতন, এর প্রতিবাদে সাংবাদিক আন্দোলন, রনির সংসদ সদস্য থেকে পদত্যাগের ঘোষণা, স্পিকারের সাথে সাাৎ ও পরে পদত্যাগ থেকে সরে এসে সংবাদ সম্মেলন এবং সবশেষ রনির গ্রেফতারের খবর। হয়তো এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ঘটনা না ঘটলে আরো কয়েক দিন রনির গ্রেফতার-পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো সরব থাকবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে রনিকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আইনের শাসন বাস্তবায়নে যে ত্বরিত পদপে দেশবাসী দেখতে পেলেন, তাতে সরকারকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, রনির ওপর এই দ্রুত আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সরকার মূলত অনেক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করল। আর এ ল্য পূরণে রনিকে হয়তো আরো চড়া মূল্য দিতে হতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। প্রথমত, কিছু দিন ধরেই সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নামার বিষয়টিই ছিল গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় হেভিওয়েট প্রার্থীদের পরাজয়ে রীতিমতো বেসামাল কথাবার্তা বলতে শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মহাজোটের শীর্ষ নেতারা। জনগণকে বিদ্যুৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়াসহ এমনসব বেসামাল কথাবার্তা শীর্ষ নেতাদের মুখ থেকে বের হচ্ছিল যে, মহাজোটের জনপ্রিয়তায় ইতোমধ্যেই যে ধস নেমেছিল, তা আরো তলানিতে গিয়ে ঠেকছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই নিজ দলের একজন জনপ্রিয় প্রতিনিধিকে তার অন্যায় আচরণের জন্য তাৎণিক বিচারের কাঠগড়ায় এনে সরকার কিছুটা হলেও জনগণের মধ্যে তার ইমেজ সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। আমার সাথে নিশ্চয়ই সবাই একমত হবেন, একজন সাংবাদিককে দু-চারটি লাথি মারার চেয়ে বহুগুণে বড় অন্যায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনিকে নৃশংসভাবে খুন করা। ছোট্ট শিশু মেঘকে পাশের রুমে আটকিয়ে রেখে ২০১২ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি রাতে ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের নিজ ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে সাগর-রুনি দম্পতিকে হত্যা করা হয়। সেই পৈশাচিকতা মনে হলে এখনো আঁতকে উঠতে হয়। লাশ উদ্ধারের সময় নিহত সাগরের শরীরে ২৫টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার শরীরে বিদ্ধ অবস্থায় দু’টি বাঁটবিহীন ছুরি পাওয়া যায়, যার একটি ৫-৬ ইঞ্চি, আরেকটি ৮-৯ ইঞ্চি লম্বা। আর রুনির পেটে ও পাঁজরে পাওয়া গেছে দু’টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। সাগরের হাত ও পা পেছন দিক থেকে বাঁধা ছিল। চরম প্রতিহিংসার বশে নিষ্ঠুর এ জোড়া খুনের ঘটনা ঘটিয়েছিল খুনিরা। কিন্তু সেই খুনের কোনো সুরাহা আজ পর্যন্ত করতে পারল না সরকার। চলে গেল প্রায় দেড় বছর। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সেই ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম এখনো কানে বাজে। পরদিনই পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদের ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে’ এমন ঘোষণা এখনো ভুলে যাননি দেশবাসী। এরপর শুধু নাটক আর নাটক। হাইকোর্টের নির্দেশে ঘটনার ৬৮ দিনের মাথায় ১৮ এপ্রিল ২০১২ ডিবি পুলিশ থেকে মামলা র‌্যাবে হস্তান্তর করা হয়। হত্যার ৭৬ দিনের মাথায় ২৬ এপ্রিল ২০১২ আবার তদন্তের নামে লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য পরে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু তারও কোনো ফলোআপ নেই আজ পর্যন্ত। এমনই হাজারো নাটকের দৃশ্যে রীতিমতো তালগোল পাকিয়ে বিষয়টি হয়তো ভুলতে বসেছেন দেশবাসী। এমনকি এই ডিএনএ পরীা নিয়ে র‌্যাব ও ঢাকার ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রফাইলিং ল্যাবরেটরির মতবিরোধের বিষয়ও ওঠে আসে সংবাদ শিরোনামে। তখন র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার সোহায়েল জানিয়েছিলেন, এই ডিএনএ টেস্ট বাংলাদেশে সম্ভব নয়। কিন্তু এ টেস্ট ঢাকার ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রফাইলিং ল্যাবরেটরিতেই সম্ভব এমন দাবি করে ল্যাবের প্রধান অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, র‌্যাবের বক্তব্যে দেশের আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবটির ভাবমর্যাদা ুণœ হয়েছে। সত্যিই নাটকের যেন শেষ নেই। এসব নাটকের পাশাপাশি দেশবাসীকে সহ্য করতে হয়েছে আরো অনেক কিছু। ‘কারো বেড রুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়’Ñ খোদ প্রধানমন্ত্রীর জবানে উচ্চারিত এমন উদ্ভট বক্তব্যও দেশবাসীকে হজম করতে হয়েছে। ‘আমার বাবার খুনিদের বিচারের জন্য আমাকে ৪২ বছর অপো করতে হয়েছে’Ñ এমন কথা বলে এই সাংবাদিক দম্পতির পরিবারকে ধৈর্যের তালিম দিতেও যেন ভুললেন না প্রধানমন্ত্রী। পুলিশের মহাপরিদর্শকের তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতির ঘোষণার পরও আজ পর্যন্ত ওই হত্যার কূলকিনারা না বের হওয়ায় কি এটিই প্রমাণিত হয় না যে, বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশেই ধামাচাপা দেয়া হলো? সাগর-রুনি হত্যার পরপরই সেখানে আসা সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে খুনের গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হয়ে গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে এ হত্যার বিচারে সরকারের চরম অনীহাই কী পরে আরো পরিষ্কার হয়ে যায় না? এত বড় একটি হত্যার গুরুত্বপূর্ণ আলামত যদি কিছু সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে নষ্ট হয়, তা হলে সরকার, সরকারের এত বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দরকার আছে কী? নাটক এখানেই শেষ নয়। স্কলাসটিকা স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা তানভীর আহমেদের গ্রেফতার, রিমান্ড ও জামিনসহ ঢাকায় নির্মমভাবে খুন হওয়া ডাক্তার নিতাইয়ের ড্রাইভার কামরুল হাসান অরুণসহ নিতাই হত্যায় অভিযুক্ত তিন আসামি বকুল, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদকে আটক করে রিমান্ডে নিয়ে চোর-পুলিশ খেলার খবরও বেশ জমে ওঠে মিডিয়াজুড়ে কয়েক দিন ধরে। এরপর বিদেশে বসে সাগর-রুনির চরিত্র নিয়ে যে অশালীন মন্তব্য এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান ড. মাহফুজুর রহমান করেছেন, তা রীতিমতো নজিরবিহীন। সাগর-রুনির বাসায় মদের আসর বসত, সেখানে নানা কিসিমের মানুষের বাজে আড্ডা হতোÑ মাহফুজুর রহমানের এমন হাজারো নোংরা কথায় সাগর-রুনির আত্মাও হয়তোবা হাহাকার করে উঠেছিল। এ ধরনের মন্তব্যে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন সাংবাদিকেরা। মাহফুজুর রহমানকে গ্রেফতারসহ নানা দাবি তোলেন সাংবাদিক নেতারা। কিন্তু সরকারের প থেকে কোনো পদপে দেখতে পাননি দেশবাসী। এতে কী প্রমাণিত হয় সে বিচারের ভার সচেতন পাঠকের ওপরই থাকল। এবার আসা যাক আবারো রনি প্রসঙ্গে। আওয়ামী লীগ দলীয় শীর্ষ ব্যবসায়ী, শেয়ারবাজারের হাজারো কোটি টাকা লুটের অভিযুক্ত খলনায়ক, সালমান এফ রহমানের ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের না হয়ে যদি অন্য কোনো মিডিয়ার সাংবাদিককে গোলাম মাওলা রনি এভাবে লাঞ্ছিত করতেন, তা হলে এমন দ্রুত অ্যাকশন হতো কি না তা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে সালমান এফ রহমান ও সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে টকশোতে রনির কড়া সমালোচনার পরিপ্রেেিত এমন প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক। কিছু দিন আগে একুশে টেলিভিশনের নারী সংবাদকর্মী এবং একই সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য অর্পণা সিংহকে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে লাঞ্ছিত করেন আওয়ামী লীগ দলীয় আরেক সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার। ফুঁসে ওঠে সাংবাদিকসমাজ, দিনের পর দিন চলে প্রতিবাদ। কিন্তু কামাল মজুমদারের টিকিটি কেউ স্পর্শ করতে পারেনি, গ্রেফতার তো দূরের কথা। তা হলে কী দুই সংসদ সদস্যের জন্য দুই আইন? তবে দেশবাসী রনির গ্রেফতারকে সরকারের সাজানো নাটক হিসেবে দেখতে চায় না। কিন্তু মানুষের আস্থা সরকার তখনই পাবে যদি অবিলম্বে সাগর-রুনির প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে সম হয়। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads