রবিবার, ৭ জুলাই, ২০১৩

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সিদ্ধান্তের প্রশ্ন


রাজধানীর সঙ্গে লাগোয়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী মহাজোটের। এটাই অবশ্য প্রথম পরাজয় নয়। এর আগে গত মাসে অনুষ্ঠিত খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বিরাট ব্যবধানেই জয়ী হয়েছিলেন ১৮ দলীয় জোটের মেয়র প্রার্থীরা। তারও আগে, সরকার গঠন করার পর পর ২০১০ সালের জুনে বিএনপি জিতেছিল চট্টগ্রামে। সব মিলিয়ে সাতটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে একমাত্র রংপুর ছাড়া সবগুলোতেই এখন বিএনপির মেয়ররা রয়েছেন। এদিকে গত ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত এবং বহুল আলোচিত গাজীপুরের নির্বাচনে ভোটের ব্যবধান আরো বেড়েছে। ১৮ দল সমর্থিত বিএনপির প্রার্থী অধ্যাপক এম এ মান্নান যেখানে পেয়েছেন তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট সেখানে আওয়ামী মহাজোট সমর্থিত অর্থাৎ আওয়ামী লীগের প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লা খান পেয়েছেন দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। দু’জনের মধ্যে ভোটের ব্যবধান এক লাখ ছয় হাজার ৫৫৭টি। বিরোধী দলের এই বিজয় অবশ্য মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, ক্ষমতাসীনরা গাজীপুরকে গোপালগঞ্জের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ‘ঘাঁটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এই ‘ঘাঁটি’ তারা অবশ্যই হারাতে চাননি। এজন্যই নির্বাচনের ময়দানে নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকেননি তারা। বিপুল টাকা তো ছড়িয়েছেনই, হুমকি দেয়া থেকে প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যবহার করা পর্যন্ত সব বিষয়েই খুবই তৎপর দেখা গেছে তাদের। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েই নাকি নির্বাচনী অফিস বসানো হয়েছিল। তোফায়েল আহমেদের মতো জাঁদরেল নেতারা এর তদারকি করেছেন। ওদিকে নির্বাচনের দিন বিরোধী দলের সমর্থক ভোটারদের বাধা দেয়া, পুলিশের সহযোগিতায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালটপেপারে সিলমারা এবং ব্যালটবাক্স থানায় নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব পন্থাই অবলম্বন করেছেন তারা। পুলিশ ও প্রশাসনের সর্বাত্মক হস্তক্ষেপ তো ছিলই। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় গোপন সভা করে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও যথেষ্টই চালিয়েছেন কর্মকর্তারা। সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পর্যন্ত অনেক রথি-মহারথিকেও ন্যক্কারজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে। কিন্তু সব জেনেও এবং বিরোধী প্রার্থীর পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ জানানোর পরও নির্বাচন কমিশনকে নড়াচড়া করতে দেখা যায়নি। ফলে ভোট ডাকাতি হওয়ার এবং বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার আশংকা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ভোটাররা সব চেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দিয়েছেন। ফলে ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীনদের প্রার্থী। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলেও এ উপলক্ষে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্যে এসে গিয়েছিল। গ্যাস-বিদ্যুৎ থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, শেয়ার বাজারের লক্ষ হাজার কোটি টাকার লুণ্ঠন, হলমার্ক কেলেংকারি, রানা প্লাজার ধস ও ১২ শ মানুষের নির্মম মৃত্যু এবং আওয়ামীকরণের মতো কারণগুলোর পাশাপাশি বিশেষভাবে উঠে এসেছিল সরকারের রাজনৈতিক নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন এবং গুম ও খুন। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর অভিযানের পাশাপাশি একটি প্রধান কারণ হিসেবে গত ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে রাতের অন্ধকারে চালানো গণহত্যার ভয়ংকর অভিযানের প্রতিক্রিয়াও ভোটারদের প্রবলভাবেই আন্দোলিত করেছে। সে কারণে গাজীপুরের ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে মুসলমানের ওপর গুলী ও নির্যাতন চালানোর এবং তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়ার পরিণতি আদৌ শুভ হতে পারে না। অর্থাৎ মূলত জাতীয় বিভিন্ন কারণেই গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে হেরে গেছেন ক্ষমতাসীনরা। একই কারণে আবারও আলোচিত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের আগামী দিনের করণীয় সম্পর্কে। বলা হচ্ছে, তাদের উচিত পরপর সব নির্বাচনে ভরাডুবির প্রকৃত কারণ নিয়ে, বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করার দাবিটি নিয়ে চিন্তা করা। কারণ, সিটি নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় নির্বাচনকালীন সম্ভাব্য পরিস্থিতির সঙ্গে আবারও শক্তিশালী হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিটি। বস্তুত চার সিটি করপোরেশনের পর গাজীপুরের নির্বাচনও সবদিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গুরুত্ব ও প্রয়োজনকে অনস্বীকার্য করে তুলেছে। কারণ, নির্বাচন কমিশনের আদৌ কোনো স্বাধীনতা ও ক্ষমতা রয়েছে কি না, সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনেও এখন আর কোনো সংশয় নেই। তার ওপর রয়েছে আওয়ামী প্রশাসন, যাকে সুচিহ্নিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে পুরো দমে। ওদিকে র‌্যাব ও পুলিশ তো রয়েছেই। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখে যে নামে ও যাদের নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হোক না কেন, সে সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনের মাধ্যমে অন্তত বিরোধী দলের পক্ষে জিতে আসা সম্ভব হবে না। সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষও হতে পারবে না। এজন্যই নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি বিশেষ জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। অন্যদিকে পাঁচ পাঁচটি ভরাডুবির পরও ক্ষমতাসীনরা উল্টো পথেই হাঁটার চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী তো নির্বাচনই হবে না বলে ভয়ও দেখাচ্ছেন। ক্ষমতাসীনরা সেই সঙ্গে বলে বেড়াচ্ছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এবং জনগণ যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে পারে সেটাই নাকি চার সিটি ও গাজীপুরের নির্বাচনে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে! তারা এ কথাও ঘোষণা করে চলেছেন যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে বিরোধী দলের সঙ্গে আমরাও মনে করি, সিটি করপোরেশনের নির্বাচন যেহেতু স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচন সেহেতু এর সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনকে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ থাকতে পারে না। সুতরাং গণতন্ত্রের ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলে ক্ষমতাসীনদের উচিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা। নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা। সে সরকার যে কোনো নামেই হতে পারে বলে বেগম খালেদা জিয়া আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। আমাদের ধারণা, এ বিষয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টার মধ্যেই ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি দেশের জন্যও মঙ্গল নিহিত রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads