বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০১৩

পরিবহনে নৈরাজ্য, সামনে কঠিন সময়


যানজটে নাকাল হচ্ছে জনসাধারণ। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা আতঙ্ক নিয়েই সড়কপথে চলাচল করতে হচ্ছে মানুষকে। সরকারের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের বাধার মুখে পরীক্ষা না দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছেন শ্রমিকরা। ফলে চালকের অদক্ষতায় এবং ট্রাফিক আইন না জানার কারণে প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা।
প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে অথবা দুটি গাড়ির সংঘর্ষে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু মানুষ। আহত হচ্ছেন আরও অনেকে। অনেককে পঙ্গু হয়ে কাটাতে হয় সারাজীবন। দিন দিন সড়কপথগুলো পরিণত হচ্ছে মৃত্যুফাঁদে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে এসব দুর্ঘটনার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। কোনো শাস্তি হয় না চালকের। যথাযথ বিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।
প্রতি বছর বিশ্বে ১১ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হন। প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হন। দুর্ঘটনায় বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৩৬ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। বিগত এক শতাব্দীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৩ কোটি মানুষ মারা  গেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিশ্বের সর্বমোট মোটরযানের সংখ্যা মাত্র ৩২ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৭৫ শতাংশ। বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ মারা যান এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। অথচ বেশিসংখ্যক মোটরযানসমৃদ্ধ দেশগুলোতে এ সংখ্যা মাত্র ১২ শতাংশ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বাড়বে এবং উন্নত দেশগুলোতে ৩০ শতাংশ কমবে।
দেশে প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ৭টি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এসব দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন মারা যায়। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, যা জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয় তা খতিয়ে দেখতে ২০০৩ সালে ট্রান্সপোর্ট রিসার্চ ল্যাবরেটরি একটি গবেষণায় সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবার সম্পত্তি, চিকিৎসা ব্যয় ও আইনি ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে ২০০২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
ক্রমেই বেড়ে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় ঠেকেছে। ঝুঁকির দিক দিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সরকারিভাবে বছরে প্রায় ৪ হাজার দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান থাকলেও প্রকৃত সংখ্যা কমপক্ষে এর পাঁচগুণ বেশি।
রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থার কারণে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। ফুটপাতগুলো সরু হওয়ায় এবং বিভিন্নভাবে রাস্তাঘাট দখল, যেখানে-সেখানে স্তূপিকৃত ময়লা-আবর্জনা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে ঢাকা নগরীর ৫১টি পয়েন্ট দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে যাত্রাবাড়ী, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, বিজয় সরণি, শনিরআখড়া, জসীম উদ্দিন রোড ক্রসিং, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, শেরাটন হোটেল ও জিপিও মোড়।
১৯৭৪ সালে ঢাকায় লোকসংখ্যা ছিল দুই লাখ। বর্তমানে এক কোটি ৪০ লাখ থেকে দেড় কোটি মানুষ বসবাস করছে। আর প্রতিদিন ১০৩টি করে প্রাইভেট কারের অনুমোদন দিচ্ছে বিআরটিএ। এ লোকসংখ্যাও গাড়ি বাড়ার তুলনায় রাস্তা বাড়েনি। ঢাকা শহরের আয়তনের মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ রাস্তা। অথচ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী যে কোন বড় শহরের মোট আয়তনের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ রাস্তা থাকার কথা। এ ছাড়া ঢাকা শহরের রাস্তার একটা বিশাল অংশ দখল করে থাকে হকার, অবৈধ পার্কিং ও অবৈধ স্থাপনা।
বর্ষা মওসুম শুরু হওয়ার আগেই শুরু হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। ভূ-গর্ভস্থ বৈদ্যুতিক লাইন নির্মাণের অজুহাতে খোঁড়াখুঁড়ির ফাঁদে পড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের দুর্ভোগের অন্ত নেই। রাস্তাঘাট দীর্ঘদিন কেটে রাখার দরুন প্রতিনিয়ত কাদা, নোংরা পানি ও ধুলার সাথে বসবাস করতে হচ্ছে।
ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে ট্রাফিক পুলিশের অধীনে দুই হাজার ২৭৪ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এসব সড়কে রয়েছে ৬৫০টি ক্রসিং। এর মধ্যে ৩০০টি গুরুত্বপূর্ণ। এসব ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ৭০টিতে সঙ্কেত বাতি রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা শহরের ওপর দিয়ে রেলপথের রয়েছে ৩৬টি লেভেল ক্রসিং। রাস্তায় গাড়ি রয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ। ঢাকার ভেতরে ১৭০টি রুটে ছয় হাজার ১০০টি বাস চলাচল করছে। বাস কোম্পানি রয়েছে ১৩৭টি। ট্রাফিক বিভাগ কর্মরত রয়েছেন তিন হাজার ৩৫৮ জন। বর্তমানে রাজধানীতে ৩৮টি ফুট ওভারব্রীজ ও তিনটি আন্ডারপাস রয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে আরো ১০টি ওভারব্রিজ।
দয়াগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে সুইপার কলোনী হয়ে রাজধানী মার্কেট পর্যন্ত সড়কে সুয়ারেজ লাইনে স্থাপনসহ মেরামত কাজ শুরু হয়েছে। পাইপ লাইন স্থাপনার পর যেখানে বালি দেয়ার কথা ছিল ঠিকাদার সেখানে রাবিশ দিয়ে গর্ত ভরাট করেছে। সবার চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটলেও প্রতিকারের কেউ নেই।
পুরানো ঢাকার মিরহাজারীবাগ, দীননাথ সেন রোড, তনুগঞ্জ লেন, ইসলামবাগ, চকবাজার, ওয়াটার ওয়ার্কস রোড, লালবাগ কেল্লার মোড়সহ রাজধানীর অধিকাংশ সড়কই ভাঙাচোরা।
ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কুড়িল ও কালাচাঁদপুরের একটি রাস্তাও ভালো নেই। বারিধারা জে-ব্লকের বেশিরভাগ রাস্তা খারাপ। বারিধারা দূতাবাস সড়কসহ কয়েকটি সড়ক কিছুদিন আগে খোঁড়াখুঁড়ি করে পাইপ লাইন স্থাপন করা হলেও মেরামত করা হয়নি। এখানেও রাস্তা খুঁড়ে বালির পরিবর্তে রাবিশ দেয়া হয়েছে। গুলশান দুই নম্বর মার্কেটের ইউনাইটেড হাসপাতালের আশপাশের রাস্তা কেটে পাইপ লাইন স্থাপন করা হলেও সড়কগুলো মেরামত করা হয়নি।
 ঢাকার জনসংখ্যা, এর আয়তন, গাড়ির সংখ্যা, ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা এবং সর্বোপরি গণপরিবহন ব্যবস্থাপনা বর্তমান চিত্র যে কোন বিবেচনায় হতাশাজনক।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে রিকশা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ির পেছনে বাধ্যতামূলক রিফ্লেক্টিভ স্টিকার লাগানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৭ এ বিষয়ে অবগতির জন্য রাজধানী জুড়ে মাইকিং করে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রিকশা-ভ্যান, ঠেলাগাড়ির মালিক ও চালকদের জানানো হয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় রাতে চলাচলকারী রিকশা, রিকশা-ভ্যান ও ঠেলাগাড়ির পেছনের অংশে কোনো আলো প্রতিফলক বা রিফ্লেক্টিভ স্টিকার না থাকায় পেছন থেকে আসা যানবাহন চালকের দৃষ্টি এড়িয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনা এড়াতে রিকশা, রিকশা-ভ্যান ও ঠেলাগাড়ি মালিক ও চালকদের প্রতিটি রিকশা, রিকশা-ভ্যান ও ঠেলাগাড়ির বডির পেছনে মাঝামাঝি স্থানে ৬ ইঞ্চি দের্ঘ্য ও ৩ ইঞ্চি প্রস্থের রিফ্লেক্টিভ স্টিকার লাগানোর নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৭)
দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটছে, এর ৬৪ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে অর্থাৎ মহাসড়কগুলোতে। এর কারণ মহাসড়কের জন্য কতগুলো শর্ত আছে, সেগুলো পূরণ হয়নি বলেই এত দুর্ঘটনা। মহাসড়ক তৈরি করা হচ্ছে; কিন্তু এর নকশা, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। মহাসড়কে ১০০ কিলোমিটার বেগে চলা যানবাহনের সঙ্গে চলছে ধীরগতির নসিমন, করিমন ও ভটভটি। রাস্তার দু’ধারে পথনির্দেশক বোর্ডগুলোর তুলনায় বিলবোর্ডের আধিক্য, হাটবাজার গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে, চালক বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছেনÑএমন অসংখ্য কারণ রয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেয়া রোগীর ৫৬ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার।
এসব চলাচল অযোগ্য যানবাহন মহাসড়কে বন্ধ এবং আটক করতে প্রতি জেলায় ডিসি ও পুলিশ প্রশাসনকে উপ-আনুষ্ঠানিক পত্র দেয়া হয়েছে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি পৃথক তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ তহবিল থেকে সড়কে তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট খানা-খন্দক দূর করা হবে।
সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ স্থাপনা অপসারণে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তও এখনো কার্যকর হয়নি। দেশের মহাসড়কগুলোতে স্থাপিত গতিরোধক অনেক সময় উল্টো বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ। মহাসড়কে গতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। অনেক স্থানেই রয়ে গেছে এসব গতিরোধক।
প্রশিক্ষিত চালকের অভাব, পথচারীদের অসতর্কতা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, গাড়ির বেপরোয়া গতি, সড়ক নির্মাণে ত্রুটি, অতিরিক্ত গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সেতু এবং অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের কারণেই দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছে।
নথিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সরকারের যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্প। যানজট-দুর্ঘটনা রোধে সরকার বিভিন্ন সময়ে নানা প্রকল্প গ্রহণ করলেও সবই রয়ে গেছে কাগজে-কলমে। প্রকল্পের গবেষণাপত্র তৈরি, বাজেট বরাদ্দ, পর্যালোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের মধ্যেই কার্যক্রম রয়েছে সীমাবদ্ধ। লোক দেখানো দু-একটি কাজ হাতে নেয়া হলেও শুরুতেই সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। যানজট নিরসন ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্পের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও সাধারণ মানুষ প্রকল্পের কোনো সুফল ভোগ করেনি।
বিধিমালা-২০০১ সহ বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়ন না হওয়া, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের অকার্যকর অবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং সামাজিক আন্দোলন জোরদার না হওয়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
জাতীয় স্থল পরিবহন ও মহাসড়ক বিধিমালাসহ বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিআরটিএ’র প্রয়োজনীয় জনবল নেই। অন্যসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয়েরও অভাব রয়েছে। এসব কারণেও সড়ক নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
সড়ক দুর্ঘটনার পর সাধারণত বাংলাদেশ দন্ডবিধির ২৭৯ ও ৩০৪ (খ) ধারায় অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাসের কারাদন্ড। যে কারণে দোষী চালক সহজেই পার পেয়ে যান। জামিনযোগ্য অপরাধ হওয়ায় কেউ কেউ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। আইনে সড়ক দুর্ঘটনার মামলা আপসযোগ্য হিসেবে উল্লেখ থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের মাধ্যমেই মীমাংসা করা হয়।
সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনারোধে সরকার কিছু পদক্ষেপ নেয়। দুর্ঘটনারোধে ১ নভেম্বর ২০১১ থেকে গাড়ি চালানোর সময় চালকের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, কিছু কিছু প্রাইভেট গাড়ির চালক গাড়ি চালানোর সময় সিটবেল্ট ব্যবহার করলেও বাসের চালকদের কেউ গাড়ি চালানোর সময় সিটবেল্ট ব্যবহার করেন না। মোটর সাইকেল চালকদের হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে গাড়ি চালানোর সময় চালকদের মোবাইলে কথা বলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নির্দেশনা অমান্য করলে জেল-জরিমানাসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
২১ সেপ্টেম্বর ২০১১ সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভা শেষে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের এসব কথা জানান।
এ নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দিতে প্রয়োজনে আইন সংশোধনের ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি। (সূত্রঃ দৈনিক আমার দেশ ২২ অক্টোবর ২০১১)
শুধু রাজধানী নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিনই এখন ভয়াবহ যানজট দেখা যাচ্ছে। গন্তব্যে পৌঁছতে মহাসড়কে অতিরিক্ত ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। এ ছাড়া কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মহাসড়কেও তীব্র যানজট চলছে বলে যাত্রীদের অভিযোগ। ৬ ঘণ্টার গন্তব্যে পৌঁছতে তাদের ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা সময় লেগে যাচ্ছে। যাত্রীদের অভিযোগ, ঈদের আগে তারা যে যানজট প্রত্যক্ষ করেছেন, একই চিত্র তারা এখনো দেখছেন। এ জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনাই মূল কারণ বলে তারা জানান।
একদিকে সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা, অন্য দিকে অসহনীয় যানজট হলেও নির্বিকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই দেশের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক পরিদর্শন করছেন। তিনি নিজেই প্রত্যক্ষ করছেন যানজট ও খানা-খন্দে ভরা সড়কপথ।
বাস্তবে যানজট নিরসনে কোনো কুল-কুনারা করতে পারেনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। যানজট কমাতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উড়াল সেতু, উড়াল সড়কসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কোনোটি এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। নির্ধারিত সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ, অফিস সময়সূচি পরিবর্তন, ওয়ানওয়েসহ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও এসব মনিটরিংয়ের কোনো উদ্যোগ নেই। মন্ত্রণালয়, দফতর, পরিদপ্তর, পুলিশ, প্রশাসন সবই আছে। তাদের বেতনভাতারও কমতি নেই। প্রজেক্ট প্রোফাইল, গবেষণাপত্র, প্রদর্শনী ইত্যাদির নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় আছে। কিন্তু কোনো সুফল পাচ্ছে না মানুষ। সরকার ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবর্তে বড় অঙ্কের বৃহদায়তন প্রকল্প হাতে নিতেই বেশি ব্যস্ত।
২০০৯ সাল থেকে নতুন অফিস ও স্কুল সময়সূচি ঘোষণা করা হয়। তাতেও যানজটের কোনো প্রভাব পড়েনি। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যানজট নিরসনে লেন পদ্ধতি, অটো সিগন্যাল পদ্ধতি, অঞ্চলভিত্তিক বিপনিবিতান বন্ধ, সিসি ক্যামেরায় ভিডিওচিত্র দেখে গাড়ি আটক, বাধ্যতামূলক ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার এবং পুরনো গাড়ি উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হয়। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে গবেষণা আর প্রকল্প স্থাপনে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও যানজট নিরসনে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহরগুলোতে ফুটপাত খালি করার সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। ফুটপাত জনসাধারণের চলাচলের জন্য। এ সিদ্ধান্ত কি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সরকার? সরকার এ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে পারলে কম করে হলেও ৫০ শতাংশ মানুষ দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যেত। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের কোনো ব্যয় নেই।
দুর্ঘটনা রোধে সরকারের কাছে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের চেয়ারম্যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন। কোনোটিই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। দুর্ঘটনা রোধে আইন থাকলেও সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ড্রাইভারদের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার জন্য, হয়নি। দেশে প্রচুর বেকার যুবক রয়েছে। নতুন ড্রাইভার তৈরিতে ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের প্রণোদনা দেয়ার প্রস্তাব ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-এর ছিল। সেটাও হয়নি। মালিকেরা ব্যাংক ঋণ করে নতুন গাড়ি কেনেন। দ্রুত গাড়ির টাকা তুলতে অদক্ষ ড্রাইভারের হাতে গাড়ি তুলে দেন। দুর্ঘটনা প্রতিরোধের বিষয়টি স্কুলের পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভূক্তির দাবিও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’-ছিল। সেটাও সরকার করেনি।
রাজধানীর চারটি বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি হয় বিভিন্ন পর্যায়ে। মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দিনে বাস প্রতি ৪০ টাকা হারে টার্মিনাল ফি আদায় করে। এই টাকা তারা ইজারাদারের মাধ্যমে দৈনিক চুক্তিতে আদায় করায় ইজারাদাররা টার্মিনালের ফি আদায়ের নামে বিভিন্ন রকম সার্ভিস চার্জও যুক্ত করে কয়েকগুণ বেশি টাকা চাঁদা দেয়। বাস টার্মিনাল থেকে গাড়ি ছাড়ার আগেই পরিবহন মালিকদের জিটির নামে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। সেটা সর্বনিন্ম ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা পর্যন্ত। জিটি ছাড়াও টার্মিনাল থেকে গাড়ি বের হওয়ার সময় যানজট নিয়ন্ত্রণের লোকজনকে দিতে হয় গাড়ি প্রতি ২০ টাকা, লাইনম্যানকে ২০ টাকা, টার্মিনালের গেট পেরুলেই চাঁদার দাবিতে হাত বাড়িয়ে দেয় পুলিশ সার্জেন্ট। তাকে দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা।
রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে চলাচলকারী ঢাকা-কুমিল্লা, ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা-লক্ষ্মীপুর, ঢাকা-চাঁদপুরসহ বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসগুলোকে প্রতি ট্রিপে নিয়মিত চাঁদা দিয়েই গাড়ি চালাতে হয়। একইভাবে গাবতলী থেকে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসগুলোও টার্মিনালের নিত্য চাঁদাবাজির শিকার। এ ছাড়া গুলিস্তান এবং মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলোতে যাত্রার শুরুতে চাঁদার টাকা গুণতে হয়। অন্যদিকে ট্রাক টার্মিনালেও প্রতিটি ট্রাক থেকে চাঁদা তোলা হয়। তবে ট্রাকের চাঁদা বেশি আদায় হয় মহাসড়ক এবং ফেরিঘাটে। সারা দেশে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান থেকে মালিক সমিতি ৪০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ২০ টাকা এবং শ্রমিক ফেডারেশন ১০ টাকাসহ মোট ৭০ টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads