সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০১৩

একেই বলে আইনের শাসন


আমি প্রথমবার যখন সিঙ্গাপুর হয়ে সিডনি ফিরছিলাম, আমার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কৌতূহল কাজ করছিল। কারণ ওই দেশটিতে যাওয়ার আগে দেশটি সম্পর্কে ভালো ছাড়া খারাপ কিছু শুনিনি। কোনো এক সময় শুনেছিলাম, সেখানে কারো ঘরে একটি মশা পাওয়া গেলে ৫০ ডলার জরিমানা করা হবে এবং তা প্রয়োগও হয়েছিল। পাবলিক স্পটে চুইংগাম চিবোতে গিয়ে ধরা পড়লেও জরিমানা দিতে হবে। এ আইন বহু বছর ধরে বলবৎ আছে। বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী গত ২৫ বছরে মাত্র একটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। একই সাথে শুনেছিলাম দেশটির পুলিশ ফোর্সের কথা। ওই দেশের পুলিশেরা নাকি দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেতনভোগী সরকারি কর্মচারী। তাই দেশটির মূল শহরে ঘোরাঘুরি করার সময় সৌন্দর্য দেখার পাশাপাশি মনে মনে দুয়েকজন পুলিশও খোঁজ করছিলাম। ব্যাপারটি আমার কাছে অনেকটাই ছোটবেলায় প্রথম চোর দেখার আগে মনের অবস্থার মতোই মনে হচ্ছিল। শহরের রাস্তায় তাদের কারোই দেখা মিলল না। অবশেষে ফেরার পথে বিমানবন্দরে একজন পুলিশের সাথে দেখা। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের দেশের রাস্তাঘাটে সহজে পুলিশ দেখা যায় না, অথচ দেশের সবাই আইনের প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধাশীল। অর্থাৎ এখানে সবাই আইন বেশ মেনে চলে। এটা কিভাবে সম্ভব? সে উত্তরে বলল, আমরা সব কিছুই অফিসে বসে মনিটর করি। যদি কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেই যায়, আমরা কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছি। কয়েক বছর আগে নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ডের বিভিন্ন শহর ঘুরেও ঠিক একই পরিবেশ দেখতে পেলাম। কোথাও কোনো মারামারি, হানাহানি, দুর্ঘটনা বা কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শুনতে পেলাম না। ট্রাফিক আইন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ছোট-বড় সবাই নিয়মের মধ্যে চলছে। অনেক জায়গায় রাস্তায় অনেক গাড়ি থাকলেও একটি হর্নের শব্দও শুনতে পেলাম না। আজ থেকে এক যুগ আগেও অস্ট্রেলিয়ায় দেখতাম, আইন অমান্য করে অনেক গাড়িচালকই সিটবেল্ট না পরে গাড়ি চালাচ্ছেন। অনেক যাত্রী বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করছেন। অনেকে ভ্রমণের সময় সামনের সিটে পা উঠিয়ে ভ্রমণ করছেন। বদ্ধ ট্রেন-স্টেশনে অন্যান্য মানুষের সামনে বা পাশে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছেন। আইন থাকা সত্ত্বেও একটা বিশাল জনগোষ্ঠী আইন পুরোপুরি মানত না। ফলে অনেককে মোটা অঙ্কের জরিমানা হজম করতে হতো। বার্ষিক জরিপে যখন ক্রমেই এদের সংখ্যা বেশ প্রকট আকার ধারণ করে, তখনই কর্তৃপ শক্ত হাতে এগুলো দমনে কঠোর হয়। আইনের সঠিক, যথাযথ ও যুগোপযোগী প্রয়োগ করা হলো। এতে সরকারের কিছু ব্যয় হলেও পরিশেষে লাভের পাল্লাই ভারী হয়েছে। যারা অনিয়মের মধ্যে ছিল, তারা নিয়মের মধ্যে ফিরে এসেছিল। টিকিটবিহীন যাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় সরকারের আয় বেড়ে গেছে। গত সাত-আট বছরে সিটবেল্ট না পরা কোনো গাড়িচালক বা যাত্রী আমার চোখে পড়েনি। ট্রেনে আগের মতো কাউকে সিটের ওপর পা উঠিয়েও ভ্রমণ করতে দেখি না। কোনো ট্রেন-স্টেশনে কাউকে ধূমপান করতে দেখা যায় না। মানুষ আইন মেনেছে, আবার অনেককে আইন মানতে বাধ্য করা হয়েছে। ছোট-বড়, ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম, দল-বল, মন্ত্রী-এমপিÑ এদের কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। আমার দেখা এ বাস্তব উদাহরণগুলো এটাই প্রমাণ করে, কর্তৃপ যদি সজাগ থাকে এবং মনেপ্রাণে চায়, কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এ বিষয়গুলো শুধু উন্নত বিশ্বেই প্রযোজ্য নয়। দেশের নীতিনির্ধারকেরা মনেপ্রাণে চাইলে এসব কিছু আমাদের বাংলাদেশেও সম্ভব। অনেকেই বাংলাদেশ এবং এর জনসাধারণ নিয়ে দেশ-বিদেশে সবার কাছে কটূক্তি ও মন্তব্য করে থাকেন। তারা তখন ভুলে যান, তারা নিজেরাও এ দেশেরই লোক। বাংলাদেশের মানুষও যে আইন মানতে পারে কিংবা যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে নারাজ তাদেরও আইন মানতে বাধ্য করা যেতে পারে; এর বাস্তব প্রমাণ পেয়েছিলাম বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বছরে। যারা তখন দেশে ছিলেন বা বিদেশ থেকে দুই সপ্তাহের জন্য হলেও দেশে গিয়েছিলেন, অন্তত এ কথাটি বুক উঁচু করে বলতে পারবেন যে, ওই সময় দেশে অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভালো ছিল। হরতাল, চাঁদাবাজি, মামলাবাজি, হামলাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, ইভটিজিং, এসিড নিপে, ধর্ষণ, গুম, অপহরণ প্রভৃতি ঘটনা অনেক কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে consistency-এর, যা মতার বলে এবং সততা, আন্তরিকতা, ধৈর্য ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির অভাবেই হয়ে থাকে। ঢাকা বিমানবন্দরের সামনে থেকে যখন কোনো ভিআইপির ব্যাগ বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিনতাই বা চুরি হয়, তখন ওপর মহলের তাগিদে এক ঘণ্টার মধ্যেই ব্যাগসহ ছিনতাইকারীকে হাতেনাতে ধরা হয়। এর মানে হচ্ছে পুলিশ আগে থেকেই বেশ ভালো করে জানে, কারা এ জাতীয় কাজের সাথে জড়িত। প্রশাসন ও পুলিশ যদি সদিচ্ছায় তাদের দায়িত্ব পালন করত, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটা দূরের কথা, চোর বা ছিনতাইকারীরা বিমানবন্দরের ত্রিসীমানায় আসার সাহস করত না। অন্য দিকে প্রায় এক যুগ পলিথিনের অপব্যবহার না থাকলেও দেশের মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন আগের মতোই বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগুলো ব্যবহার করে যাচ্ছে। যখন কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে পলিথিনের ব্যবহার ১০০% নিষিদ্ধ ছিল, তখন মানুষের জীবনযাত্রা থেমে যায়নি। এক সময় মানুষ পলিথিন ছাড়াই চলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপরে দুর্বল ভূমিকায় পলিথিন উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে ব্যবহারকারী পর্যন্ত আবার আগের মতোই এগুলোর অপব্যবহার করে আসছে। কয়েক বছর আগে যখন আইনশৃঙ্খলার অনেকটা উন্নতি হয়েছিল, তখন শুনতাম ঘরে-বাইরে মানুষ নিজেদের কিভাবে নিরাপদ ভাবত। কারণ যাদের কারণে মানুষ নিরাপত্তার অভাবে ভুগত, তারা গা-ঢাকা দিয়েছিল, কিংবা তাদের একটা বিশাল অংশ শ্রীঘরে ছিল। নিজেও তা দেখেছি; কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা এখন আর কেউ গর্ব করে ওই দিনগুলোর কথা বলতে পারি না। যদি ছয় মাসের জন্য দেশের আইনশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেটা ছয় বছর বা ছয় যুগের জন্য স্থিতিশীল হলে কি জাতির মর্যাদা বাড়বে না? এটা চাইলে যেকোনো সরকারের আমলেই সম্ভব। একটা সময় পর্যন্ত যখন মানুষ নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হবে, তখন দেখা যাবে পরবর্তী প্রজন্ম এগুলো একই নিয়মে অনুসরণ করছে। তখন আর কেউ সুযোগই পাবে না অন্য কারো দোষ দেখিয়ে কোনো ধরনের অজুহাত দাঁড় করানোর। আমাদের দেশের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, নিজে দোষ করে সেটাকে না শুধরিয়ে অন্যের করা দোষের ওপর দিয়ে চালিয়ে বা চাপিয়ে দেয়া। অর্থাৎ নিজে একটা দোষ বা অন্যায় করে বা আইন ভঙ্গ করে হয়তো বললাম, তারা করেছে বা সবাই করে, তাই আমি করলে দোষের কী? অনেক েেত্র এটা সত্যিও বটে। কারণ নিম্নœশ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে যারা ঘুষ খান, তারা সব সময় বলে বেড়ান, মন্ত্রী-মিনিস্টার বা এমপিরা খেলে আমাদের মতো চুনোপুঁটির দোষ কোথায়? তার মানে, সমস্যাটা ওপর থেকে এসেছে। কারণ বড়রা দোষ করলে ছোটরা সাহস পাবে, এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া ছোটরাই তো বড়দের অনুসরণ করবে, বড়রা ছোটদের নয়। মোটকথা, অনিয়ম বা দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হলে ওপরটাই আগে পরিষ্কার করতে হবে। যদি কয়েক বছরের জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যেত, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম এর ফলাফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারত এবং তাদের দিয়ে আর অনিয়ম হতো না। এটা সম্ভব, কারণ দেশ-বিদেশে এখনো অনেক সাহসী ও সৎ লোক আছেন, যারা সত্যিকারভাবেই দেশের মঙ্গল চান এবং দেশকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এ বিশ্বাসের ওপর ভর করেই প্রবাসে থেকেও বাংলাদেশকে এক সুখী ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দেখার আশায় ব্যাকুল হয়ে আছি। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads