শুক্রবার, ১৯ জুলাই, ২০১৩

আওয়ামী লীগ : আবারও স্বরূপে আসার চেষ্টা


আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যারা অনভিজ্ঞ, এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে যাদের স্পষ্ট ধারণা নেই, তারা এরই মধ্যে রীতিমতো দ্বন্দ্বে পড়ে গেছেন। তারা বুঝতেই পারছেন না, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আসলে কোনদিকে পা বাড়াতে বা এগিয়ে যেতে চাচ্ছেন? দেশকেই বা কোথায় নিয়ে যেতে চান তিনি? বলা দরকার, মানুষের মনে এ ধরনের প্রশ্ন অকারণে সৃষ্টি হয়নি। এ সম্পর্কে জানার জন্য প্রথমে বিগত মাসখানেকের মধ্যে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন এবং প্রতিটিতে সরকারি দলের শোচনীয় ভরাডুবির কথা স্মরণ করতেই হবে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে হেরে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত ‘গণতন্ত্রের বিজয় হয়েছে’ এবং ‘প্রমাণিত হয়েছে যে, তার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে’ ধরনের নানা মধুর বাণী শুনিয়েছিলেন। অন্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরাও সে সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, ওই নির্বাচন চারটি থেকে তারা অন্তত এটুকু অনুধাবন করবেন, তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। তারা সেই সাথে পরাজয়ের আসল কারণগুলোও খুঁজে বের করবেন এবং নিজেদের শোধরানোর চেষ্টা করবেন বলেও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ অনেকে আশা করেছিলেন। অন্যদিকে সবকিছু পাল্টে ফেলেছে গাজীপুরের নির্বাচন। বিরাট বপুর অর্থমন্ত্রী থেকে জাঁদরেল নেতা তোফায়েল আহমেদ এবং ইদানীং বেশি কথা বলার জন্য আলোচিত মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত সবার কথাবার্তাতেও আত্মসমালোচনার বিষয়টি প্রাধান্যে এসে গিয়েছিল। অর্থাৎ মনে হচ্ছিল, তারা সম্ভবত নিজেদের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আন্দাজ করতে পেরেছেন এবং পরাজয়ও মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ঝামেলা বাধিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। গাজীপুরের নির্বাচন যখন হয় তখন তিনি বোন রেহানার মেয়ে টিউলিপের বিয়েতে অংশ নেয়ার জন্য ৪৩ জনের বহর নিয়ে লন্ডন সফরে ছিলেন। সেখান থেকে খুবই কম পরিচিত রাষ্ট্র বেলারুশ যাওয়ার কথা ছিল তার। গিয়েছিলেনও। কিন্তু গাজীপুরের দুঃসংবাদ শোনার পর নামকাওয়াস্তে সফর শেষ করেই ঢাকার উদ্দেশে উড়াল দিয়েছিলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শুধু ফিরেই আসেননি, এসেই গভীর উদ্বেগ ও সংশয়ের কারণও তৈরি করেছেন। গত ১১ জুলাই আওয়ামী লীগের নেতা ও এমপিদের সঙ্গে এক ‘অনির্ধারিত বৈঠকে’ শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এবং রীতিমতো ঘোষণার ঢঙে বলেছেন, গাজীপুরসহ সিটি করপোরেশনগুলোতে আমাদের সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হলেও সংসদ নির্বাচনে ‘আমরাই জিতবো’। ‘অনির্ধারিত’ বৈঠকে দেয়া ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুধু নয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমবারের মতো জাতির উদ্দেশে লিখিত একটি বিবৃতি প্রকাশ করার মধ্য দিয়েও প্রধানমন্ত্রী আলোড়ন তুলেছেন। বেলারুশ সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসার পরপর এ ধরনের বিবৃতি ও ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় প্রধান ‘ঘাঁটি’ গাজীপুরও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শান্ত বা ধীরস্থির থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এটা আসলে শেখ হাসিনার মতো এত বড় একজন নেত্রীর পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথাও নয়। কিন্তু উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে তার বিশেষ কিছু কথার পরিপ্রেক্ষিতে। যেমন তিনি বলেছেন, তাদের প্রার্থীরা নাকি ‘অপপ্রচারের কাছে’ হেরে গেছেন। এভাবে ১৯৭৫-পরবর্তীকালেও তারা নাকি একই ‘অপপ্রচারের কাছে’ হেরে এসেছেন! অপপ্রচারকারী সে চক্রই নাকি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে! চক্রটির পরিচিতি সম্পর্কেও বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার ভাষায় এটা ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের চক্র’!
কল্পিত চক্রটিকে পরাস্থ করার এবং নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও অন্তর্কলহ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, সিটি করপোরেশনগুলোতে যা কিছুই ঘটে থাকুক না কেন সংসদ নির্বাচনে তারাই জিতবেন। প্রসঙ্গক্রমে অস্বাভাবিক ওই বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, বিরোধী দলের ভিত্তিহীন অভিযোগ এবং নির্বাচনকে বিতর্কিত করার সব অপচেষ্টা সত্ত্বেও বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় সরকার পর্যায়ের বিভিন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দেশি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল নির্বাচন সুষ্ঠূু হয়েছে মর্মে সংবাদ ও তথ্য দিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী তার বিবৃতিতে সব অপপ্রচার ও মিথ্য অভিযোগ এবং সহিংসতা বন্ধ করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। বলেছেন, বর্তমান সরকারের ওপর নির্বাচনের ব্যাপারে যে আস্থা ফিরে এসেছে সে আস্থা কোনোভাবেই নস্যাত করা যাবে না এবং এ সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে তারা বদ্ধপরিকর।
এ পর্যন্ত এসে থেমে গেলেও হয়তো কথা উঠতো না। কিন্তু আফটার অল, শেখ হাসিনা তার নাম! এজন্যই ১৩ জুলাই ভারতের ঋণে কেনা ভারতেরই কিছু বাসের লাল ফিতে কাটার অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী একেবারে নতুন কিছু কথা শুনিয়েছেন। ভারতীয় কূটনীতিক ও ব্যবসায়ীদের উপস্থিতিতে তিনি বলেছেন, তার দলের যারা দুর্নীতি করেনি, যারা ‘সৎ’ এবং ‘ক্লিন ইমেজের’ তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জিততে পারেননি। কিন্তু জিতেছে দুর্নীতবাজ, সন্ত্রাসী এবং আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি ও খুনের সঙ্গে জড়িতরা। তিনি প্রশ্ন করেছেন, এই জেতার রহস্যটা কি? জনগণের প্রতি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত খেদের সঙ্গে বলেছেন, দুর্নীতবাজরাই যদি জিতে আসে তাহলে এত উন্নয়ন আমরা কার জন্য করেছি, কেন করেছি? পরপর পাঁচ-পাঁচটি সিটি করপোরেশনে হেরে গেছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভবত মনে রাখা সম্ভব হয়নি যে, ১৩ জুলাইয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল একটি সরকারী কর্মসূচি। মনে ছিল না বলেই রীতিমতো দলীয় নেত্রীর সুরে ও ভাষায় কথা বলেছেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি স্বীকারই করতে চাননি যে, ‘জাতীয়’ বিভিন্ন ইস্যুর কারণেই একের পর এক আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে হেরে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী উল্টো জানতে চেয়েছেন, ‘জাতীয় ইস্যু’ আবার কি? উত্তরও নিজেই দিয়েছেন তিনি। খাদ্য শিক্ষা স্বাস্থ্য চাকরি ও ব্যবসা থেকে জিডিপি এবং বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো পর্যন্ত বিভিন্ন প্রসঙ্গে তিনি তার সরকারের অর্জিত সাফল্যের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। জোর গলায় বলেছেন, কিছুই তো কমেনি বরং সবই তো বেড়েছে। তারপরও কেন তার প্রার্থীদের হারতে হয়েছে?
অনুষ্ঠানে আরও কিছু বিষয়ে কঠোর বক্তব্য রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। মনের ঝাল ঝেড়েছেন হেফাজতে ইসলামীর আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফির ওপরও। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে প্রাধান্যে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর হাহাকারÑ এত উন্নয়ন করার পরও ভোটার জনগণ কেন তার দলের ‘সৎ’ এবং ‘ক্লিন ইমেজের’ প্রার্থীদের জেতায়নি! তাহলে উন্নয়ন করে কী ‘লাভ’ হয়েছে তার? উলে¬খ্য, দেশে নির্বাচন ফেলে প্রধানমন্ত্রী যখন অমুসলিম বিদেশি বরের সঙ্গে বোন রেহানার মেয়ে টিউলিপের বিয়ে উপলক্ষে লন্ডন সফরে ছিলেন সে সময় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদও একই সুরে বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘অহেতুক’ কিছু জায়গাকে সিটি করপোরেশন বানিয়ে কী ‘লাভ’ হয়েছে আমার জানা নেই। অর্থাৎ সব কাজের মধ্যে তারা কেবল নিজেদের ‘লাভ’ই খোঁজেন, জনগণের ‘লাভ’ নয়! লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রধানমন্ত্রীও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিয়েছেন। মনের ক্ষোভও তিনি আড়াল করেননি। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের ভোটারদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষও কিন্তু মনে করে না যে, প্রধানমন্ত্রী আদৌ সত্যের কাছাকাছি রয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে শুধু বিদ্যুতের কথা উলে¬¬খ করলেও প্রধানমন্ত্রীকে বরং লা-জবাব হতে হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী যখন হাজার হাজার, সাত-আট হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কেচ্ছা শোনাচ্ছিলেন তখনও দেশের বেশিরভাগ এলাকায় চলছিল লোডশেডিং। বস্তুত এখনও লোডশেডিং হচ্ছে যখন-তখন। কোনো কোনো এলাকায় পাঁচ-সাত ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা অবশ্য এতকিছুর পরও গালগল্পই শুনিয়ে চলেছেন যেমনটি সেদিন শুনিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বাস্তবে কিন্তু বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠার ধারেকাছেও যাননি তারা। সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে কেচ্ছা তারা শোনাচ্ছেন তার জন্য জনগণের ঘাড় কতটা নিষ্ঠুরভাবে মটকানো হচ্ছে সে কথাও বলেননি প্রধানমন্ত্রী।
অথচ সবই করেছেন তারা রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কারখানার মাধ্যমে। এসব কারখানা পেয়েছেনও শুধু আওয়ামী লীগের লোকজন। দলীয় লোকজনের পকেট ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলার জন্য রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের খাতে বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ওদিকে গ্রাহকরা আগে যেখানে মাসে আটশ-এক হাজার টাকা বিল দিতেন সেখানে বর্তমানে দিতে হচ্ছে আড়াই-তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকার যেতেও কাটছে আসতেও কাটছে। কারণ, গ্রাহকরা শুধু বেশি বিলই দিচ্ছেন না, ভর্তুকির ২৪ হাজার কোটি টাকাও জনগণের ট্যাক্সের অর্থ থেকেই দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও বিদ্যুৎ সঙ্কট থেকে রেহাই মেলেনি। সুতরাং লম্বা এবং অসত্য কথা শোনানোর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্তত সংযম দেখানো উচিত ছিল। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী উল্টো ভয় দেখিয়েছেন। বলেছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন তারা বাড়িয়েছেন কি না তা নাকি তিনি রোজার পর বোঝাবেন। পন্থা সম্পর্কেও জানিয়ে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, কয়েকদিন পর্যন্ত সরবরাহ বন্ধ রেখে জনগণকে বুঝিয়ে দেয়া হবে, বিদ্যুতের উৎপাদন সত্যি বেড়েছে কি না!
এভাবে ঘোষণা দিয়ে জনগণকে প্রতিপক্ষ বানানোর মধ্যে লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে কি না এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের ধমক আদৌ শোভা পায় কি না এসব বিষয়ে ক্ষমতাসীনরা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী যে ব্যাখ্যাই হাজির করুন না কেন, প্রমাণিত সত্য হলো, তারা আসলেও ‘জাতীয়’ ইস্যুর কারণে হেরে গেছেন। শেয়ারবাজারের লুণ্ঠন থেকে পদ্মা সেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি, হলমার্ক ও ডেস্টিনি কেলেঙ্কারি এবং সবশেষে জামায়াত-শিবিরের পরপর হেফাজতে ইসলামের ওপর চালানো গণহত্যা পর্যন্ত অসংখ্য ‘জাতীয়’ ইস্যু তো ছিলই, এসবের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবিটি। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী বুঝতেই চাচ্ছেন না যে, জনগণের ওপর মনের ঝাল মিটিয়ে লাভ নেই, ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করতে হলে তাকে তত্ত্বাবধায়ক তথা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে। সে সরকারের নামের ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়া ছাড় দিয়ে রেখেছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর জন্য ব্যবস্থা নেয়াটাও অনেক সহজ হতে পারে। পাঁচ সিটি করপোরেশনে লজ্জাকর পরাজয় থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবশ্যই এটুকু বুঝতে পারা উচিত যে, অন্তত তাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে গঠিত কোনো সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই বিরোধী দল এবং জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর উচিত দ্রুত বয়ে চলা সময়ের সদ্ব্যবহার করা।
লক্ষণীয় যে, কথায় মারপ্যাঁচ খাটালেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ও কর্মকা-ে পরিষ্কার হয়েছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে জনমতের যে প্রতিফলন ঘটেছে, ক্ষমতাসীনরা তার প্রতি সম্মান দেখাতে রাজি নন। শুধু তা-ই নয়, তিনি এমনকি এই সত্য পর্যন্ত স্বীকার করেননি যে, ‘জাতীয়’ বিভিন্ন ‘ইস্যু’র কারণেই গাজীপুরসহ সব নির্বাচনে হেরে গেছেন তারা। উদ্বেগের কারণ হলো, বহুদিন পর প্রধানমন্ত্রীর মুখে আবারও ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’ ও ‘বঙ্গবন্ধুর খুনীদের’ কথিত চক্রের ‘অপপ্রচার’ সম্পর্কে শুনতে হয়েছে। এটা অবশ্যই বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। অথচ স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও এসব নির্বাচন উপলক্ষে জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ই প্রাধান্যে এসেছিল। রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার বিষয়টি তো ছিলই।
সুতরাং প্রধানমন্ত্রী সত্যি যদি নিজেদের ভুলগুলো শোধরাতে চান তাহলে কল্পিত কোনো খুনি বা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ‘অপপ্রচারকে’ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা দরকার। আগেই বলেছি, সে সরকার যে কোনো নামেই হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী চাইলে সুযোগটা নিতে পারেন। কিন্তু এখনও, এতগুলো লজ্জাকর পরাজয়ের পরও তারা গণতন্ত্রসম্মত পথে হাঁটতেই রাজি হচ্ছেন না। তারা এখনও শেখ হাসিনাকেই প্রধানমন্ত্রী রেখে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে এবং সে সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা প্রচার করে চলেছেন। সর্বশেষ উপলক্ষেও প্রধানমন্ত্রী একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন। অন্যদিকে গণতন্ত্রসম্মত সত্য হচ্ছে, সিটি নির্বাচনগুলোর পর এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার মতো অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী আর নেই। তার বরং অনুধাবন করা উচিত যে, অমন কোনো সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সংকটের সমাধান করার মধ্যেই যে তাদের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছেÑ এই সহজ কথাটা ভোটারসহ সাধারণ মানুষ বুঝলেও প্রধানমন্ত্রী বুঝতে চাচ্ছেন না বলেই জনমনে উদ্বেগ বেড়ে চলেছে। সেই সাথে প্রধানমন্ত্রী আবারও ক্ষমতায় আসার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেও নতুন করে ভীতি ও সংশয়ের সৃষ্টি করেছেন। তার নিশ্চয়ই মনে পড়ে গেছে, ২০০৮ সালের ‘ডিজিটাল’ নির্বাচনের মাধ্যমে ঠিক কোন পন্থায় তারা ক্ষমতায় এসেছিলেন। অন্যদিকে তাদের ভোট যে মোটেও বাড়েনি বরং অনেক কমে গেছে সে সত্যেরই প্রমাণ পাওয়া গেছে সিটি নির্বাচনগুলোতে। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত আগেভাগে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করতে চাচ্ছেন। কে জানে, সেটা সম্ভব না হলে দেশে আবারও লগি-বৈঠার হত্যা-সন্ত্রাস চালানো হবে কি না, আবারও নতুন কোনো ‘উদ্দিন’ সাহেবদের নিয়ে আসা হবে কি না! প্রধানমন্ত্রীর ১৬ জুলাইয়ের বক্তব্যের মধ্যে কিন্তু সে ধরনের ইঙ্গিতই রয়েছে!

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads