মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৩

টিআইবি প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ দুর্নীতি


প্রচণ্ড গরম হাওয়া বইছে জাপানজুড়ে। দিনের বেলায় রাস্তায় বের হলে মনে হয় যেন জ্বলন্ত কোনো চুলার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে সারা বিশ্বের মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস। পবিত্র মাহে রমজান। রাতভর ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভের সর্বোত্তম মাস এটি। ঈমানদারকে চরম ধৈর্যের পরীা দিতে হয় এই মাসে। আর যাই হোক, লেখার ভেতরে যেন অন্যের গীবত করা না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সাবধান থাকতে হবে প্রতিটি শব্দচয়নে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত দুই বছরে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাত্রা সার্বিকভাবে বেড়েছে। টিআইবি জরিপের উত্তরদাতাদের ৯৩ শতাংশের ধারণা, সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে যৌথভাবে দেশটির রাজনৈতিক দল ও পুলিশ। আর উত্তরদাতাদের ৮৯ শতাংশ মনে করেন, রাজনৈতিক দল ও পুলিশের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাতই হলো দেশটির বিচার বিভাগ। স্বভাবতই টিআইবি প্রকাশিত প্রতিবেদনে কারো কারো আঁতে ঘা লেগেছে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। সবার আগে মুখ খুলেছেন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের চরিত্র হনন ও বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করতেই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল এ মুহূর্তে তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তার মতে, দেশের বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। দেশের ক্রান্তিকালে টিআইবির রিপোর্ট এ ষড়যন্ত্রেরই অংশ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, যে রাজনৈতিক দল মতায় থাকে, তাদেরই দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে। আর তাই টিআইবি আওয়ামী লীগ ও মতাসীন জোটকেই চিহ্নিত করেছে। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, আইনজীবীরা বিচার বিভাগের অংশ হলেও তাদের দুর্নীতি করার কোনো সুযোগ নেই। বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার প্রকাশিত জরিপে সাধারণ জনগণ আকাশ থেকে পড়েছে, তা নয়। যতটুকু বুঝতে পারছি, অবাক হয়নি মোটেই। সরকারি খাতের লাগামহীন দুর্নীতি, পুলিশ ও বিচার বিভাগের অনিয়ম এখন আর কারো অজানা নয়। তবে এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে এমন একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রাকারী পুলিশবাহিনী ও সাধারণ জনগণ, যাদের কাছে আইনি আশ্রয় নেবে সেই বিচার বিভাগ এখন প্রায় অফিসিয়ালি শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। টিআইবি জরিপে বলা হয়েছে, এ তিন খাতে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয়। গত বছর আগস্ট মাসে হংকংভিত্তিক বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) স্পষ্ট জানিয়েছিল, বাংলাদেশের নাগরিকেরা আয়কর হিসেবে প্রতি বছর সরকারকে যে পরিমাণ টাকা জমা দেন, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ পুলিশকে ঘুষ দেন। হিউম্যান রাইটস কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, পুলিশ হচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের কারখানা। দুর্নীতিই তাদের চেইন অব কমান্ড। বিভিন্ন অপরাধ দমন ও তদন্তে পুলিশ প্রতিনিয়ত ব্যর্থ। এ ব্যর্থতাই দেশটির ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় বাধা। অথচ ঘুষ, দুর্নীতি ও ব্যর্থতার জন্য কোনো সাজাই পান না পুলিশের সদস্যরা। মতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিপকে শায়েস্তা করার বিনিময়ে সব অপরাধের বিচার থেকে রেহাই পান এরা। আর এ কাজে বাধ্য করার জন্যই সরকারগুলোও পুলিশের বেতনভাতা খুবই কম পরিমাণে নির্ধারণ করে থাকে (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর, ১১ আগস্ট ২০১২)। পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞজনের লেখা পড়েছি। বলতে শুনেছি, আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতা নাকি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি। এখন অবশ্য বাস্তবেই তা দেখতে পাচ্ছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খানও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মতা মোগল সম্রাটের চেয়েও বেশি। রাশিয়ার জারদেরও এত মতা ছিল না। যে দলের যিনিই প্রধানমন্ত্রী হন না কেন, তিনিই এই মতা ভোগ করেন।’ বিশ্বের সবচেয়ে মতাধর রাষ্ট্র আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল কিনটনকে নাকি রাষ্ট্রীয় টেলিফোনে ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলায় সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমাদের সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কপাল অনেক বড়। সামান্য ফোন-ফ্যাক্সের হিসাব দিয়ে তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হয় না। এমনকি নিকটাত্মীয়ের বিয়ে-উত্তর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় খরচে জনের বিশাল বহর নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে গেলেও খুব একটা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় না। হবে কিভাবে? কে করবে সমালোচনা? সমালোচনা যারা করতে পারে, তাদের মুখ তো অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টুঁটি চেপে ধরা হয়েছে তাদের। রাতের অন্ধকারে বাতি নিভিয়ে তাদের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমাদের সংসদ সদস্যদের সরকারি টেলিফোন বিল বকেয়া রাখা, শুল্কমুক্ত গাড়ি-বাড়ি নেয়া, সরকারি কোটায় প্লট-ফ্যাট বরাদ্দ পাওয়া এমনকি দীর্ঘ দিন একনাগাড়ে সংসদ বর্জন করেও নিয়মিত বেতনভাতা নেয়ার সংস্কৃতি আজকাল এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। পত্রিকা মারফতে জানা যায়, চার বছর আগেও সরকারি টেলিফোন বিল বকেয়া রেখে মারা যাওয়া সাবেক সংসদ সদস্যদের মোট এক কোটি এক লাখ চার হাজার ৪৩২ টাকার বকেয়া বিল মওকুফ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের ১৭ আগস্টে মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে এই অনাদায়ী বকেয়া মওকুফ করা হয়েছে। রমজান মাসে তির্যক কথা লিখতে চাই না। একটু বাঁকাভাবে বললে বলা যায়, ঠিক যেন পরের ধনে পোদ্দারি। রাজনীতিক, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা আমাদের অভিভাবক। তারাই রাষ্ট্র্র পরিচালনা করেন। জাতিকে পথ দেখান। নির্বাচনের আগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলেন। নির্বাচনের পর মতায় গিয়ে বাস্তবে তারাই দুর্নীতিকে ছড়িয়ে দেন প্রশাসনের আনাচেকানাচে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সাধারণ জনগণ কখনোই তাদের এই অভিভাবকদের প্রকৃত আয়-ব্যয়ের হিসাব জানতে পারে না। অথচ জনগণের আয়করের টাকায় আমাদের বাপজানেরা আনন্দ ফুর্তি করেন। ছেলেমেয়ে ও আত্মীয়স্বজনের জন্মদিন, বিয়ের উৎসব পালন করেন দেশের বাইরে। জনগণের আয়করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের এই অপব্যবহার বন্ধ হওয়া দরকার। সংসদ সদস্যদের ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের উল্লিখিত অপসংস্কৃতির অবসান হওয়া উচিত। পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে মতাসীন আওয়ামী লীগের শোচনীয় পরাজয়ের পর পত্রপত্রিকায় আলোচনার ঝড় বইছে। খুবই স্বাভাবিক। সর্বশক্তি নিয়োগ করেও শেষ রা হয়নি নিজেদের ঘাঁটি বলে পরিচিত গাজীপুরে। পুরো প্রশাসনকে কাজে লাগানো হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিরোধী প্রার্থী এম এ মান্নানের দুর্নীতির খতিয়ান দিতে এনবিআরকে দিয়ে ট্যাক্সের ফাইল বের করা হয়েছিল। দুর্নীতির অভিযোগে তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করার হুমকি-ধমকিও দেয়া হয়েছিল। জাহাঙ্গীর নাটক, এরশাদ নাটক কত কী করা হয়েছিল। শেষ রা হয়নি। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখিয়েও কোনো লাভ হয় না। এ নির্বাচনের আগেই কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম বলেছিলেন, গাজীপুরের নির্বাচনে শেখ হাসিনার প্রার্থী এক লাখ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হবে। বাস্তবে তার চেয়েও অধিক ভোটে পরাজিত হয়েছেন সরকারদলীয় প্রার্থী। গাজীপুরের নির্বাচনের পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন এই বলে যে, বিভক্ত ঢাকা সিটিকে এক করে প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচন করলেও গাজীপুরের চেয়ে অধিক ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হবেন। তার কথা সত্য না হলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন এবং যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন বিনা বেতনে প্রধানমন্ত্রীর গোলামি করবেন। সম্প্রতি বাংলাভিশনের একটি টকশোতে তিনি আরো বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদের নির্বাচনে মতাসীন আওয়ামী লীগ ৩০টি আসন পেয়ে দেখাতে পারলেও তিনি তাই করবেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়ে দাঁড়ালে ভিন্ন কথা। 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads