বর্তমান আওয়ামী সরকারের শীর্ষ থেকে শুরু করে সর্বত্রই পৃথিবীর নজিরবিহীন অনিয়ম, অব্যবস্থা, অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অসততা, বিশৃঙ্খলা, চুরি, ডাকাতি, সশস্ত্র সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, খুন, গুম, কমিশন ও নিয়োগ বাণিজ্য, লাগামহীন ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট, প্রতারণা, জালিয়াতি ও জবরদখলের অপরাধমূলক ঘটনা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী সরকারের মেয়াদের শেষ পর্যায়ে এসে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই ক্ষমতাসীন দলের সবাই যেন বেপরোয়া হয়ে জবরদখলে নেমে পড়েছে সরকারি অফিস-আদালত থেকে শুরু করে ব্যাংক-বীমা, বড় বড় শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ গ্রামীণ জনপদের স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে একই চিত্র। এই জালিয়াত জবরদখলকারী অপশক্তির হাত থেকে বাড়ি, জমি, খাল, জলাশয় কিছুই রেহাই পায়নি, আজো পাচ্ছে না। রাজধানী ঢাকা মহানগর ও তার চারপাশের বিশাল এরাকার বেশির ভাগ বাড়ি, মার্কেট, জমি ও খাল, মুক্ত জলাশয়ে অনেক দিন ধরেই সরকারদলীয় প্রভাবশালী ও একশ্রেণীর জালিয়াত আবাসন ব্যবসায়ীদের জবরদখল প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যাচ্ছে।
বিচ্ছিন্ন বাড়ি ও জমির অসহায় মারিকরা যেমন এই প্রতারক, জালিয়াত, জবরদখলকারী ও ভূমিদস্যুদের আগ্রাসী থাবার সামনে টিকতে পারছেন না, ঠিক তেমনি সরকার, সরকারি প্রশাসন, সরকারের আজ্ঞাবহ বলে সুপরিচিত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরাও জনস্বার্থে এই গণদুষমনদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন না। যার ফলে এখন সরকারি পতিত জমি, সংরক্ষিত বনভূমি, পুকুর, দীঘি, মৎস্য অভয়াশ্রম, হাওর-বাঁওড়, খেলার মাঠ, পার্ক, খাল, নদী ও জলাশয় সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই একই কারণে সারাদেশের ফসলি জমির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। রাজধানী ঢাকা মহানরগী কিংবা দেশের বড় বড় নগরীর অবস্থার সাথে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা শহর, বন্দর, গঞ্জ, হাটবাজার ও আশপাশ এলাকার গ্রামের পার্থক্য কমই। সারাদেশের গ্রামাঞ্চলেও এখন আওয়ামী জালিয়াতচক্র দরিদ্র-অসহায় মানুষের বসতবাড়ি ও জমি জবরদখল করে নিচ্ছে। দেশজুড়ে দাপটের সাথে চলছে আওয়ামী ভূমিদস্যুদের বেপরোয়া তা-ব। আওয়ামী সরকারের সাড়ে চার বছরে দৈনিক সংগ্রামসহ প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আওয়ামী জালিয়াতি ও ভূমিদস্যুদের তৎপরতার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার চরহরিরামপুর ইউনিয়নের তিন ফসলি জমিতে আশ্রয়ন প্রকল্প নির্মাণের পদক্ষেপ নিয়েছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই পতিত জমি বাদ দিয়ে ফসলি উর্বর জমি বিনষ্ট করে আশ্রয়ণ প্রকল্পের নামে ফায়দা লুটতে মেতে উঠেছে সরকারদলীয় গ্রামীণ প্রভাবশালীরা। এই জালিয়াতি চক্রের বিরুদ্ধে এলাকার কৃষক নারী-পুরুষদের সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়ানোর খবর পাওয়া গেছে। খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি বাজারে কোটি কোটি টাকার সরকারি জমি স্থানীয় আওয়ামী ভূমিদস্যুরা জবরদখল করে নিচ্ছে। ভূমিদস্যুরা প্রথমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইন বোর্ড টানিয়ে দখল নিয়ে পরে ব্যক্তি মালিকানায় ঘর-বাড়ি তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঢাকা মহানগরীর আদাবর থানা এলাকার আওয়ামী নামধারী কুখ্যাত ভূমিদস্যুরা জাল দলিল বানিয়ে শতাধিক প্লট ও বাড়ি সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে জবরদখল করে নিয়েছে। ভুক্তভোগীরা থানা-পুলিশের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও কোনো সহায়তা পায়নি বলে জানা গেছে। উত্তর বাড্ডার আফাজ উদ্দীনের পৈত্রিক এক বিঘা দেয়ালঘেরা জমি জালিয়াত চক্র দখল করে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চরজাজিরা মৌজার আবাদি জমি আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র ড্রেজার দিয়ে বালু ভরাট করে জবরদখল করে নিচ্ছে। ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়া পৌরসভার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি স্থানীয় প্রভাবশালী চক্র সরকারি দলের দাপট দেখিয়ে দখল করতে গেলে আইনের আশ্রয় নিয়েও জীবনের হুমকির মুখে পড়েছেন বৃদ্ধ আবু তাহের।
গত সাড়ে চার বছর ধরেই আওয়ামী সন্ত্রাসী, জালিয়াত ও ভূমি জবরদখলকারীরা এমন অপরাধমূলক ঘটনা রাজধানী ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নির্দ্বিধায় ঘটিয়ে চললেও সরকার, সরকারি প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, পুলিশ-র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীলরা এর দায় এড়িয়ে যেতে পারেন কি?
সরকারি মহলের আশীর্বাদে সরকারি দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী-ক্যাডার ও একশ্রেণীর এনজিও’র মালিকরা দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলে একযোগে ভূমি গ্রাস করে চলেছে। গত সাড়ে চার বছর ধরে সারাদেশের চর ও জলাভূমি এবং খাস জমি দখলের মহোৎসবে কোমর বেধে নেমে পড়েছে তারা। সরকারি দলের লোকজন বিধায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শিথিল তৎপরতা এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির সুযোগে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্যে দিশে হারা হয়ে পড়েছেন ভূমিহীন গরিব মানুষ। এই অবৈধ দখলদারির ইতিহাস এদেশে নতুন নয়। প্রতিবছরই ফসলের মওসুমে কিংবা নতুন চর জেগে উঠলেই সেখানে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের লাঠিয়াল বাহিনী চরবাসী গরিব মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বসতবাড়ি তছনছ করে উচ্ছেদ করে কেটে নেয় জমির ফসল, নতুন চরে নিজেদের দখলদারি বসায় এদেশে খাস জমি গ্রাসের ইতিহাস প্রাচীন। এ ব্যাপারে কোনো সরকারের আমলেই স্থায়ী কোনো সমাধান করার উদ্যোগ, পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান সরকার এই গুরুতর সমস্যার সমাধানে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদীভাঙা ও চর এলাকায় এবং উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় খাস ভূমিতে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের বেপরোয়া তা-ব বাড়ছে। আর নিরুপায় হয়ে পড়েছে হাজার হাজার নিরস্ত্র ভূমিহীন মানুষ।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি খাস জমি নিয়েও চলছে নানা অপতৎপরতা। রাজশাহী বিভাগের ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অধিদফতর সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ১৬ জেলায় মোট ৭৫ হাজার ২৪৫ দশমিক ৪১ একর সরকারি খাস জমি অধিদফতরের রেকর্ডে রয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় ৩৫ হাজার একর জমি লিজ দেয়া হয়েছে। বাকি ৪০ হাজার ২৪৫ দশমিক ৪১ একর খাস জমি বিভিন্ন সময় অবৈধ দখলদাররা নিজেদের দখলে নিয়েছে। দেড় হাজার একর দেবত্তর সম্পত্তি জমি দলিলের মাধ্যমে প্রভাবশালী জোরদার, রাজনৈতিক নেতা ও ভূমি রেকর্ড বিভাগের জালিয়াত চক্র নিজেদের নামে দখল করে নিয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভূমির অবৈধ দখল ও মালিকানার গোলোযোগ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় ধরনের অন্তরায়। এক্ষেত্রে সরকার তথা প্রশাসনের ভূমিকা সৃষ্ট সমস্যার তুলনায় শূন্যের কোঠায় বলা চলে। আমরা মনে করি, দেশের জেগে ওঠা চর কিংবা সরকারি খাস জমি যদি বন্দোবস্ত দিতেই হয়, তাহলে তার একমাত্র দাবিদার ভূমিহীন মানুষ। সবার প্রত্যাশা, প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের অপকর্ম রুখে দিয়ে ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন