সরকার আসে সরকার যায়। তবে থেকে যায় তাদের কীর্তি। ভাল কাজের স্বীকৃতি সবাই দেয়। আর মন্দ কাজে বাড়ে দুর্নাম। এই সত্য সরকারও জানে, তবে ক্ষমতায় থাকাকালে বিষয়টা ক্ষমতাসীনরা ভুলে যায় কি না সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। মানুষতো সরকারের সমালোচনা করে, তবে তৃতীয় বিশ্বে সরকারগুলোর সমালোচনা হয় বেশ তীব্র ভাষায়। আর সরকারগুলোর পরিণতিও ভাল হয় না। এরপরও রাজনীতিবিদরা কেন যে সরকার গঠন করতে যায় সেটা এক বিস্ময়ের ব্যাপার! সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়, তবে এই রমযান মাসে অন্য একটা বিষয় বিশেষভাবে উঠে আসে। আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রায় ৯৯ ভাগই তো মুসলমান। পরকালে প্রতিটি কর্মের জন্যই যে জবাবদিহি করতে হবে তেমন বিশ্বাসও তাদের থাকার কথা। তারপরও যে কোন্্ সাহসে তারা নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটির সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তা ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। আমাদের দেশে বিরোধী দলের আচরণকেও অনেক সময় বেশ নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। বিষয়টা আসলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের নয়। বিষয়টা আসলে বাস্তবতা। পরকালকে বিশ্বাস করলে সরকারের তো ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকার কথা। আর সরকারের অবস্থা দেখে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে প্রতিবাদী বিরোধী দলের অবস্থা কি হতে পারে তা ভেবে বিরোধী দলেরও সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করার কথা। কিন্তু এমন চিত্র আমাদের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে নেই। তাই মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আমাদের রাজনীতিবিদরা পরকালের জবাবদিহিতাকে আদৌ ভয় করেন কি?
একটু উপলব্ধির কথা বলছিলাম। জানি না আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে এমন উপলব্ধির কোন গুরুত্ব আছে কি না। তবে আজ একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন যে, দেশের রাজনৈতিক চালচিত্রে জনগণ মোটেও খুশি নয়। শুধু কৌশল দিয়ে কোন সমস্যার সমাধান হয় না। সরকার কৌশলের ওপর কৌশল করে যাবে, আর বিরোধী দল পিছু পিছু দৌড়াবে এমন রাজনীতি জনগণ চায় না। সরকার তো সুশাসনের কথা বলেছিল, বলেছিল দিন বদলের কথাও কিন্তু এসবে জনগণ এখন আর আশাবাদী নয়। বরং সামনে নতুন কোন্্ বিপদ এসে হাজির হয়, সে আশংকায় জনগণ এখন ভীতসন্ত্রস্ত। একের পর এক লক্ষ্য করা যাচ্ছে আশাহত হওয়ার মতো নতুন নতুন ঘটনা। কিন্তু অতীতে ঘটে যাওয়া ইস্যুগুলোর কোন সমাধান হচ্ছে না। শেয়ার কেলেংকারি থেকে শুরু করে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ, রেলের কালো বিড়ালের টাকার বস্তা, হলমার্কের অবৈধ ঋণসহ ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, ইলিয়াস আলী গুম এবং সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকা-ের ব্যাপারে কোন কূলকিনারা করতে পারেনি সরকার। এমনকি এসব বিষয়ে বিরোধী দলও কাঙ্খিত পর্যায়ে তাদের ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়নি। তবে পত্র-পত্রিকার কল্যাণে এখনও ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। জনগণও এই ভেবে কিছুটা আশ্বস্ত যে, একদিন হয়তো ঐসব ইস্যুর একটা সুরাহা হবে। উল্লেখ্য যে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হয় শেয়ার বাজারে। প্রায় ৩৫ লাখ বিনিয়োগকারী সব হারিয়ে রাস্তায় বসে পড়ে। পুঁজি হারিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আত্মহত্যা করেন দুইজন। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র তথ্য অনুযায়ী শেয়ার বাজার থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। দেশের মানুষের দাবি ছিল, শেয়ার কেলেংকারির নায়কদের বিচারের আওতায় আনা। কিন্তু সে দাবি পূরণ হয়নি। ইবরাহিম খালেদের তদন্তে জড়িতদের নাম উঠে এলেও কারও বিচার হয়নি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো, পদ্মা সেতু কেলেংকারি। কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তার ডায়েরি সূত্রে মন্ত্রী-উপদেষ্টাসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘুষ-কমিশনের কথা ফাঁস হয়। বিষয়টি পদ্মা সেতুর মূল অর্থায়নকারী সংস্থা বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে আসার পর তারা ব্যবস্থা নিতে বলে। কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে সরকারের নানা টালবাহানায় বিশ্বব্যাংক কঠোর অবস্থান নেয়। এতে বাড়তে থাকে দূরত্ব। সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর পরিবর্তে পাল্টা চ্যালেঞ্জের পথে হাঁটতে থাকে। একপর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে মন্ত্রীত্ব ছাড়তে বাধ্য হন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। অন্যদিকে বেশ কিছুদিন উপদেষ্টার পদ থেকে দূরে ছিলেন ড. মশিউর রহমান। পরে তার সক্রিয়তা আবার লক্ষ্য করা যায়। সরকারের কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ হয়ে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নেয় বিশ্বব্যাংক। পরে এডিবি, জাইকাসহ অন্য দাতা সংস্থাও সরে দাঁড়ায়। ফলে দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ শুরুই করতে পারেনি সরকার। অথচ নির্বাচনী ইশতহারে প্রতিশ্রুতি ছিল পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন। বর্তমান সরকারের আমলে নজিরবিহীন আরেকটি ঘটনা হলো, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি। দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এমন ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠানকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। শুধু হলমার্ক নয়, সরকারের গত সাড়ে চার বছরে ব্যাংকিং খাতের পুরোটাই ছিল নানা কেলেঙ্কারিতে ভরা। এ প্রসঙ্গে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংকিং খাত থেকে অর্থ লুটে নেয়ার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। এখন পর্যন্ত ইউনিপেটু ও ডেসটিনির গ্রাহকরা তাদের অর্থ ফেরৎ পাননি। এ সরকারের আমলে আরেকটি আলোচিত ঘটনা হলো, রেলমন্ত্রী থাকাকালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ফারুক তালুকদারকে টাকার বস্তাসহ বিজিবির সদর দফতরের গেটে আটক করা। গাড়ির চালক স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন, এই টাকা মন্ত্রীকে ঘুষ দেয়ার জন্য রেলের পূর্বাঞ্চলের জিএম বস্তায় করে নিয়ে আসেন। অনেক জল ঘোলা করার পর রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে সুরঞ্জিত বাবুকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়েছে। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার এখনও তেমন কোনো সুরাহা হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে আরো দু’টি আলোচিত ঘটনা হলোÑ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী গুম এবং সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকা-। এ সব ঘটনারও কোনো সুরাহা হয়নি। সরকার কৌশলে বিব্রতকর ইস্যুগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের ইস্যুর যেন শেষ নেই। একটি ইস্যুর সুরাহা না হতেই এসে যায় আরেকটি ইস্যু। কেউ কেউ বলছেন, নতুন ইস্যু আগের ইস্যুকে চাপা দিয়ে ফেলছে। আসলেই কি কোনো ইস্যুকে চাপা দিয়ে রাখা যায়? জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো তো সব সময় জনমনে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে। শাসক ও প্রশাসকরা ভুলতে চাইলেও জনগণ সব ইস্যুর সমাধান চায়, চায় সুবিচার। সমাধান ও সুবিচারের দায়িত্ব পালন করা না হলে, সময় এলে জনগণ তাদের রায় প্রদান করে। সেই বিষয়টি এবার লক্ষ্য করা গেছে ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার পরেও জনগণ ঐসব নির্বাচনে সরকারের প্রতি তাদের অনাস্থার কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। সরকারের কোনো ভুল হবে না একথা আমরা বলি না। কিন্তু ভুলের মাত্রা যেন সীমা ছাড়িয়ে না যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা সরকারের কর্তব্য। ভুল সংশোধনের মাধ্যমে সরকার সে কর্তব্য সুন্দরভাবে পালন করতে পারে। আর ভুল স্বীকার করে সংশোধিত হলে জনগণের ক্ষোভের মাত্রাও হ্রাস পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এতসব কেলেঙ্কারি এবং পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পরও সরকারি মহলে যেন কোনো বোধোদয় ঘটছে না। জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো এড়িয়ে চাতুর্যের নৌকায় চড়ে যেন তারা আগামীতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চান। কিন্তু ইতিহাসের কঠিন সত্য হলো, যথাকর্ম পরিহার করে শুধু চাতুর্যের গুণে এই পৃথিবীতে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। তাই পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন, সরকারের এখন বোধোদয়ের পথে হাঁটা উচিত। আর বর্তমান সময়ে সে পথটি হলো, ছলচাতুরির পথ পরিহার করে তত্ত্বাবধায়ক কিংবা নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কারণ জনগণ এমনটাই চায়। জন-আকাক্সক্ষার বিপরীতে গেলে কোনো সরকারের পরিণতি ভাল হয় না। এই সরকারের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি সরকার উপলব্ধি করলেই মঙ্গল।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন