মেয়াদের একেবারে শেষ প্রান্তে বলে এবারের পবিত্র রমযান মাসে সরকার অন্তত দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ দমনে তৎপর হবে- এমন আশা ছিল সাধারণ মানুষের। অন্যদিকে সবই চলছে আগের মতোই। দ্রব্যমূল্য তো আকাশ ছুঁই ছুঁই করছেই, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিও বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না বিশেষ করে চাঁদাবাজির ক্ষেত্র উল্টো সম্প্রসারিত হয়েছে ব্যাপকভাবে। আগে চাঁদাবাজরা প্রধানত বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও ঠিকাদারদের পেছনে লেগে থাকতো, আজকাল তারা পাড়া-মহল্ল¬ার দোকানদার ও ফুটপাথের ক্ষুদে ব্যবসায়ী থেকে চাকরিজীবী পর্যন্ত কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। অবশ্য আওয়ামী লীগের লোকজন পার পেয়ে যচ্ছে! চাঁদা দাবি করেই ওরা থেমে থাকছে না, অস্ত্রের মুখে বা যে কোনো পন্থায় আদায়ও করে ছাড়ছে। যারা দিতে চাচ্ছেন না বা সঙ্গতি না থাকায় দিতে পারছেন না তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা। কারও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বা বাসাবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হচ্ছে, কারও আবার সন্তানকে জিম্মি করে টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। খবরে জানা যাচ্ছে, পাড়া-মহল্ল¬ার উঠতি চাঁদাবাজরা আজকাল বিভিন্ন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ব্যবহার করেও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। চাঁদার অর্থ পাওয়ার জন্য তারা বিশেষ করে ‘বিকাশ’-এর কোনো অ্যাকাউন্ট নাম্বার জানিয়ে দিচ্ছে। ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়া লোকজন ‘বিকাশ’-এর কোনো কেন্দ্রে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে আসছে। মোবাইলের ফ্লেক্সির মতো পানের দোকানে পর্যন্ত বিকাশ-এর এজেন্ট থাকায় কারো পক্ষেই চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নিজের এবং স্ত্রী-সন্তানদের জীবন ও মানসম্মান বাঁচানোর জন্য হলেও মানুষকে চাঁদা দিয়ে রেহাই পেতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলছে সারাদেশেই। সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্যও বহুগুণে বেড়ে গেছে। কিন্তু পুলিশ ও র্যাবসহ কোনো বাহিনী বা সংস্থাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বরং অভিযোগ রয়েছে, থানা-পুলিশ করতে গিয়ে অনেককে আরো বেশি বিপদে পড়তে হচ্ছে। একই কারণে সহজে থানায়ও যাচ্ছেন না কেউ। বলার অপেক্ষা রাখে না, সন্ত্রাসের সঙ্গে চাঁদাবাজি আসলেও সীমা ছাড়িয়ে অত্যন্ত মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর শিকারও হচ্ছে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষÑ অবশ্য আওয়ামী লীগের সৌভাগ্যবান লোকজন ছাড়া! বিষয়টিকে আমরা গুরুতর মনে করি। কারণ, ক্ষমতাসীন দলের প্রশ্রয়ে চলতে থাকা চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের পরিণামে দেশীয় ঠিকাদার-ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা তো বটেই, বিদেশী কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও দেশের কোথাও নিরুপদ্রবে কোনো কাজ করতে পারেনি, এখনও পারছে না। নিজেদের বিনিয়োগ রক্ষার স্বার্থে অনেকে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিয়েছেন সত্য কিন্তু তারা প্রথম সুযোগে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়েও নিয়েছেন। চাঁদার অর্থে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের পকেট এবং অভিযোগ অনুযায়ী আওয়ামী লীগের দলীয় তহবিল ভারী হলেও একদিকে নানামুখী উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদেশে। দুর্নাম রটে যাওয়ায় বিদেশীরা সহজে আর বাংলাদেশে আসার নাম করেননি। এর ফলে আর্থিক সহায়তাই শুধু বন্ধ হয়ে যায়নি, সংশি¬ষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপোড়নেরও সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নতুন ক্ষতির কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। তা সত্ত্বেও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা যেমন থেমে যায়নি, সরকারও তেমনি নেয়নি দমনমূলক ব্যবস্থা।
এখানে ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্যে কোনো রাখ-ঢাক নেই। পাছে দল ছেড়ে দেয় এমন চিন্তায় তারা ‘সোনার ছেলে’ আর পাড়া-মহল্ল¬ার ‘ছোট ভাইদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মোটেই আগ্রহী নন। তাছাড়া প্রায় ক্ষেত্রে অর্থের ভাগ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পকেটেও গিয়ে জমা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। লজ্জার বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে নাম আসছে এমনকি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদেরও। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের তৎপরতা চোখে পড়েনি, এখনও পড়ছে না। এর কারণও সহজবোধ্য। চাঁদার ‘ভাগ’ চলে যাচ্ছে বিশেষ কিছু নেতার পকেটেও। ‘বখড়া’ পাচ্ছে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর কর্মকর্তারাও। অর্থাৎ দেশজুড়ে চাঁদাবাজি চলছে একটা সামগ্রিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হুকুম দিলেও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতারা আর যা-ই হোক, ‘ছোট ভাইদের’ বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করতে পারছেন না। কারণ ছোট ভাইরা একদিকে যখাস্থানগুলোতে ‘ভাগ’ দিচ্ছে, অন্যদিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচনের সময়। তখন তো এ ছোট ভাইয়েরাই উদ্ধার করে দেবে আওয়ামী লীগকে! আর যদি আবারও লগি-বৈঠার মাধ্যমে নতুন কোনো আন্দোলনের ‘ফসল’ ঘরে তোলার প্রশ্ন থেকে থাকে তাহলে তো ‘ছোট ভাইদের’ কোনো বিকল্পই নেই! এজন্যই মাঝে-মধ্যে ‘কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’ এবং ‘কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না’ বলে কলেরগানের ভাঙা রেকর্ড বাজানোর বাইরে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। সবকিছু জানে বলে চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরাও কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না। ফলে পাড়া-মহল¬ার ক্ষুদে দোকানদার থেকে সাধারণ চাকরিজীবী পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রেণী ও পেশার মানুষই অসহায় হয়ে পড়েছেন। আমরা মনে করি, অনেক হয়েছে, মেয়াদের শেষপ্রান্তে এসে অন্তত তাই ক্ষ্যান্ত দেয়া দরকার। সরকারের উচিত চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। এটা সহজেই সম্ভব। কারণ, সবাই তাদের চোখের সামনেই রয়েছে!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন