বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০১৩

স্থানীয় নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের কারচুপি এক নয়


সদ্য সমাপ্ত দেশের অন্যতম ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর চেয়ে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিরোধীদলীয় মেয়র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। নির্বাচনের এ ভরাডুবি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এবং মহাজোটকে কতখানি ভাবিয়ে তুলেছে বা দেশে তাদের জনসমর্থনের ব্যারোমিটার কি পরিমাণ আপ-ডাউন করেছে এ নিয়ে তারা ভাবছেন কিনা তা আমার বোধগম্য নয়। তবে একটি কথা নিয়ে দলের এবং জোটের শরীক বড় ছোট সব নেতারই সুর এই যে আওয়ামী লীগের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া সম্ভব। তাই আবারও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের অধীনে হতে হবে। তাদের এই অসাড় বক্তব্য শুনে এক গেঁয়ো বুড়ির কথা মনে পড়ে গেল। বুড়ি নাড্ডু-পিঠা নিয়ে মেয়ে বাড়ি চলছেন নাতী-নাতনীদের খাওয়াবেন বলে। চলার পথে বুড়ি হঠাৎ পা পিছলে রাস্তার মাঝখানে পড়ে যান। শরম পাবার শঙ্কায় সহসা তিনি বলে উঠলেন বসেছি যখন একটু পান খেয়ে নেই। এই কথা বলে তিনি পানের বাটা থেকে পানের খিলি বের করে মুখে দিয়ে আবার পথ চলা শুরু করলেন। আওয়ামী লীগ এমনিভাবে ৫টি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে হেরে যাবার পর জনগণকে বোকা বানানোর কৌশল হিসেবে এই অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো দেশের তথাকথিত কিছুসংখ্যক বাম বুদ্ধিজীবীসহ একশ্রেণীর মিডিয়া এই একই সুরে পুরাতন ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছেন।
বিরোধীদলের অভিযোগ গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সরকারের নগ্নভাবে প্রশাসন ব্যবহার, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের প্রিসাইডিং অফিসার, পুলিং অফিসার পদে নিয়োগ, ব্যাপকভাবে জালভোট প্রদান, ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাইসহ বিরোধী পক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। সরকারি দলের প্রার্থীরা নির্বাচন আচরণবিধি ভঙ্গসহ এ সংক্রান্ত অনেক অনিয়মের মহড়া দিয়েছেন। তারপরও মহাজোটের প্রার্থীরা নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। নির্বাচনে জনৈক প্রার্থীকে আটক করার নাটক আবার কোন নেতার প্রার্থী সমর্থন ডিগবাজি কোন কিছুই ভোটারদের মাঝে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর কারণ যে, জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচন কখনো এক ক্যাটাগরি হতে পারে না।
জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় নির্বাচন যে এক ক্যাটাগরির নির্বাচন নয় এ কথা সরকার জানেন। তারা জেনে বুঝেও আগামী জাতীয় নির্বাচনের বৈতরণী পার হবার কূটকৌশল হিসেবে এই ইস্যুকে নিয়ে সরকারি দলের ব্যাপক প্রচারের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচন এক ধরনের নয় এবং এর কারচুপির প্রেক্ষাপটও সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এ প্রবন্ধের মাধ্যমে আমি কিছু তথ্য ও যুক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করবো।
জাতীয় নির্র্বাচনে প্রার্থী সংখ্যা দুয়ের অধিক হলেও সাধারণত অধিকাংশ আসনে প্রধান দুই জোটের মধ্যে ভোটের লড়াই সীমাবদ্ধ থাকে। এক্ষেত্রে সরকারি দল নির্বাচনে জয়ের জন্য বিরোধীদলের সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে না আসার জন্য সহজে ভয়ভীতি দেখাতে পারে। অথচ স্থানীয় নির্বাচনে ভয় দেখিয়ে কোন ভোটারকে কেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। কারণ স্থানীয় নির্বাচনে মেয়র পদ ছাড়াও একই নির্বাচনী তফসিলে ওয়ার্ডভিত্তিক কাউন্সিলর এবং তিনটি ওয়ার্ড মিলে ১ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সঙ্গত কারণে মেয়র, কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর কোন সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখা সম্ভব হয় না। জাতীয় নির্বাচনে সরকারি দলের সমর্থকরা প্রভাব খাটিয়ে বিরোধীদলের এজেন্টদের বের করে কেন্দ্র দখল করে ইচ্ছামত ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরে দিতে পারেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে তা একেবারেই অসম্ভব। স্থানীয় নির্বাচনে এমন প্রভাব খাটানো সহজ বিষয় নয়। কারণ প্রতিটি কেন্দ্রে মেয়র পদে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ জন প্রার্থীর এজেন্ট, কাউন্সিলর পদের জন্যও অনুরূপ সংখ্যক প্রার্থী থাকায় ঐ কেন্দ্রে কমপক্ষে অর্ধশতসংখ্যক এজেন্ট থাকেন যাদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া সহজ কাজ নয়। তাছাড়া মেয়র পদে সরকারি ও বিরোধীদলের একক প্রার্থী থাকলেও কাউন্সিলর এবং মহিলা কাউন্সিলরদের একই দলের একাধিক প্রার্থী থাকেন। ফলে কোন কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থীর জন্য ভোট কারচুপি করতে গিয়ে সমপরিমাণ সদস্য পদের ভোট কারচুপি করে অন্য দুই প্রার্থীর পক্ষে প্রদান করা সম্ভব নয়। তাছাড়া শুধু মেয়র পদে ভোট জাল করে বাকি দুই পদে সমপরিমাণ ভোট কাস্ট না হলে এটা একটা সন্দেহের ব্যাপার থেকে যায়। সঙ্গত কারণে স্থানীয় নির্বাচনে এলাকার শক্তিশালী কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রভাবের কারণে শুধুমাত্র মেয়র পদের জন্য ভোট জালিয়াতি করা সম্ভব হয় না।
গাজীপ্রু সিটি নির্বাচনে দেখা যায় বিরোধী দলের মেয়র প্রার্থী সরকারি দলের প্রার্থী থেকে লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে বিজিত হয়েছেন। ভোটের ব্যবধান হিসেবে সেখানকার ৫৭টি ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর জয়ী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সেখানে প্রত্যেক দলের একাধিক প্রার্থী থাকার কারণে ২৭টি কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হতে পেরেছেন। সঙ্গত কারণে বলা যায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার সাফাই গাওয়ার কোন কৃতিত্ব নেই।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীকে জয়ী করার জন্য সকল প্রকার ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করেও জয়ী হওয়া সম্ভব হয়নি। তার কারণ স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পেছনে আরো অনেক ফ্যাক্টর কাজ করেছে। যেমন গত ৫টি সিটি নির্বাচনে দেশীবিদেশী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া তাদের সাধ্যমত জনশক্তি নিয়ে সেখানে যেভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে জাতীয় নির্বাচনে তার শতভাগের একভাগও কভারেজ দেয়া সম্ভব নয়। একই দিনে জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনে নির্বাচন হলেও দেশের হাওর-বাঁওড়, বিল অঞ্চলসহ রাস্তাঘাটে অনুন্নত প্রত্যন্ত এলাকার ভোট কারচুপির সঠিক তথ্য জ্ঞাত হওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া নির্বাচন কমিশনারের এমন জনশক্তি নেই যে, ঘুরে ঘুরে হাজার হাজার কেন্দ্রের সঠিক তথ্য জ্ঞান হয়ে ত্বরিত ব্যবস্থা নিবেন। অনুরূপভাবে প্রশাসন থেকে যে পরিমাণ জনশক্তি দেয়া দরকার তার এক-চতুর্থাংশ জনশক্তি এসব বাহিনীতে মওজুদ নেই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কেন্দ্রে ৪/৫ জন পুলিশ ও ১০/১৫ জন নিরস্ত্র আনসার দেয়া হয় যাদের সম্বল মাত্র ১ খানা লাঠি যা দিয়ে সরকারি দলের অনৈতিক কর্মকা- মোকাবিলা করা একেবারেই অসম্ভব।
জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে আরো অনেক তফাৎ আছে। জাতয়ী সংসদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীরা দেশের পরবর্তী ৫ বছরের জন্য সর্বময় ক্ষমতা দখল করে অথচ স্থানীয় নির্বাচনের জয়ী প্রার্থীদের বেলায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হাতবদল হয় না। ভোট গ্রহণের বা গণনার সময় যদি ক্ষমতাসীন দল মনে করেন যে তারা হেরে যাচ্ছেন তাহলে যেকোন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারেন। অথবা নিজেদের গা বাঁচানোর জন্য তৃতীয় কোন শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর সূত্র খুঁজতে পারেন।
সবশেষে বলতে চাই দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তখন ৩০০ আসনের প্রত্যেকটিতে ভোট জালিয়াতী বা কারচুপির প্রয়োজন হয় না। পরিকল্পনামাফিক ২৫০টি আসনে সুষ্ঠু নির্বাচন দেখিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাত্র ৫০টি টার্গেটকৃত আসনে কারচুপি করলেই নির্বাচনের ফলাফলে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বিভিন্ন সংস্থার জরিপে কোন জোট কতটি আসন পেতে যাচ্ছেন এমন অনেক তথ্য প্রকাশ পায়। সেক্ষেত্রে যদি আন্দাজ করা যায় যে, সরকারি দল ১২৫টি এবং বিরোধী দল ১৭৫টি আসনে বিজয়ী হতে যাচ্ছে তখন সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বিরোধীদলের বিজয়ী হবার সম্ভাবনাময় ৫০টি আসনে কারচুপির মাধ্যমে ৪০টি আসন কেড়ে নিতে পারলেই সহজে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব। রাজধানী ঢাকাসহ বৃহত্তর শহর-নগরীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মহড়া দেখিয়ে ভেতরে ভেতরে সহজে ভোট কারচুপির এই কূটকৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব। সরকার দেশবাসী ও গোটা বিশ্বকে ধোঁকা দিতে যে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চোরাগলি পথে হাঁটতে শুরু করছে এর সর্বনাশা চক্রান্ত থেকে বিরোধী দলসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সক্রিয় থাকতে হবে।
উপসংহারে বলতে চাই, যেদেশে সরকারি দলের প্রতি বিরোধীদলের আস্থা নেই, বিরাধীদলের প্রতি সরকারি দলের একই রকম মনোভাব এমতাবস্থায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিকল্প নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads