দেশজুড়ে শিক্ষাঙ্গনে অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাস কায়েম করেছে ছাত্রলীগ। নিয়োগবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নারীর শ্লীলতাহানিসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এ সংগঠনটি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে বিরোধী মতের সব ছাত্র সংগঠন এখন ক্যাম্পাসছাড়া। বিরোধীরা ক্যাম্পাসে গেলেই সশস্ত্র হামলা চালাচ্ছে তারা। অন্যদিকে অসত্ পথে আয়ের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। এসব সংঘর্ষ ও হামলায় গত পৌনে চার বছরে প্রাণ হারিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ ছাত্র। আহত হয়েছে ৮ হাজার শিক্ষার্থী।
ছাত্রলীগের হামলা-সংঘর্ষে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ তাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে। খুন, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির ঘটনায় অধিকাংশ সময় মামলাও নেয় না থানা। দু’একটি ঘটনায় মামলা হলেও সহজেই পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। শিক্ষাঙ্গন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ছাত্রলীগের পক্ষেই একাধিকার সাফাই গেয়েছেন। অনেকটা প্রশ্রয়দাতার ভূমিকায় আছেন তিনি। আর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও আছেন অনেকটা পুতুলের ভূমিকায়। বুয়েটে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দু’দিন পর শিক্ষামন্ত্রী বাসায় ডেকে সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সিলেট এমসি কলেজ পুড়িয়ে দেয়ার পর লোক দেখানো চোখের পানি ঝরালেও শিক্ষামন্ত্রী তদন্তে প্রমাণিত দোষী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে গেলে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ ছিল অনেকটা ছাত্রলীগের সহযোগীর ভূমিকায়। কয়েক গাড়ি পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম সামনে উপস্থিত থেকেই হামলা-সন্ত্রাসে মদত দিয়েছে। এর পরদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে গেলে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই হামলার ঘটনায় উল্টো ছাত্রদলের ৬০ নেতাকর্মীকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আরেকটি বড় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। বাণিজ্যে ব্যর্থ হয়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় তারা। অ্যাম্বুলেন্স, বাস এবং ক্লাসরুমে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ক্যাডাররা। সন্ত্রাসীরা ভিসির কার্যালয়, প্রক্টর অফিস, টিএসসি পরিচালকের অফিস, পরিবহন প্রশাসকের অফিস, মেডিকেল সেন্টারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভাঙচুর করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল পুরোপুরি নীরব। ভিসি-প্রোভিসিকেও হামলার হুমকি দিলে তারা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সূত্রে মহাজোট সরকারের পৌনে চার বছরে সারাদেশে ছাত্রলীগ এবং প্রতিপক্ষ সংগঠনের মধ্যে অন্তত ছয় শতাধিক ছোট-বড় সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষের অধিকাংশই হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বার বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ দিতে হয়েছে ২৩ জনকে। বড় আকারের সংঘর্ষ হয়েছে—এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা প্রকৌশল, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল (বুয়েট), শেরে-ই-বাংলা কৃষি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রাজশাহী প্রকৌশল এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজ, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, খুলনা বিএল কলেজ, মেহেরপুর কলেজ, সিলেট এমএম কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল পলিটেকনিক কলেজ, সিলেট মেডিকেল কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ ও সিলেট পলিটেকনিক কলেজ।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তাণ্ডব : তালিকা অনুযায়ী চাকরি না হওয়ায় ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ছাত্রলীগ। এতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে মেডিকেল সেন্টার কিছুই রক্ষা পায়নি ছাত্রলীগ ক্যাডারদের রোষানল থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার মমতাজ ভবনের সামনে থাকা গাড়িস্ট্যান্ডে একটি পেট্রল বোমার বিস্ফোরণ হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জাপানি হিনো বাসে আগুন ধরে যায়। বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ও আগুনের লেলিহান শিখায় শিক্ষকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আরও দুটি বাসের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সকাল ৯টার দিকে সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান তুহিনের নেতৃত্বে তাদের গ্রুপের নেতাকর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগের দলীয় টেন্টে জড়ো হয়। পরে তারা লাঠিসোটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি পরিচালক এবং সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. সেলিম তোহার কার্যালয়, পরিবহন প্রশাসক ড. রেজওয়ানুল ইসলামের কার্যালয়, ভিসি প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিনের কার্যালয়সহ প্রশাসন ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। দিনভর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু’কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চরম আতঙ্কে ভুগছেন। আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে আবাসিক হল ছাড়তে শুরু করেছে।
এদিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন। সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ক্যাডাররা পেট্রলবোমা মেরে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, অ্যাম্বুলেন্স, ভিসির কার্যালয়, প্রক্টর অফিস, টিএসসি পরিচালকের অফিস, পরিবহন প্রশাসকের অফিস, মেডিকেল সেন্টারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভাঙচুর করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল পুরোপুরি অসহায়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১৭তম সিন্ডেকেট সভায় প্রশাসন ৫৪টি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে দলীয় বিবেচনায় ছাত্রলীগের দেয়া তালিকা অনুযায়ী ১১২ জনকে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেয়। কিন্তু ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে পরিস্থিতি সামাল দিতে ভিসি প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিন নিয়ম উপেক্ষা করে ক্ষমতাবলে আরও ৪২ জনকে গণনিয়োগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শামছুজ্জামান তুহিন প্রশাসনকে ২০০ জনের একটি তালিকা দিয়েছিলেন। চাকরি দেয়ার কথা বলে ওই ২০০ জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেটের সভা আগেই ছাত্রলীগের তিনটি গ্রুপ ভিসি প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিনকে বিভিন্ন ধরনের চাপ ও হুমকি, এমনকি বোমাবাজি ও গোলাগুলির ঘটনাও ঘটায়। ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সরবরাহ করা তালিকা অনুযায়ী সবার চাকরি না হওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক হামলা : গত ১০ সেপ্টেম্বর পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে গেলে ছাত্রদলের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আমজাদ আলীর উপস্থিতিতে চাপাতি, রড ও হকিস্টিক দিয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের পাঁচ কর্মীকে আহত করে। ওই হামলায় আব্বাস আলী, সোহাগ, রুহুল আমিন, মিজানুর রহমান ও রাশেদ নামে ছাত্রদলের এ পাঁচ কর্মী আহত হয়। একই সময় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রদলের চার কর্মীকে আটক করে পুলিশ। হামলাকারী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা।
ওইদিন ছাত্রদলের নবনির্বাচিত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। প্রশাসন সূত্রে বিষয়টি জেনে ছাত্রলীগ সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফটকে ছাত্রদলকে হামলার জন্য মহরা দিতে থাকে। বিষয়টি প্রশাসন লক্ষ্য করেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পরে দুপুরে ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মী প্রশাসনিক ভবনের দিকে যেতে চাইলে প্রক্টর তাদের থামিয়ে পরিচয়পত্র দেখাতে বলেন। এ সময় পাশে থাকা ছাত্রলীগ কর্মীরা এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে। ছাত্রদল কর্মীরা জীবন বাচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাদের চাপাতি, রড, স্ট্যাম্প দিয়ে ঘণ্টাব্যাপী পেটাতে থাকে। পরে উপস্থিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা ছাত্রলীগের হাত থেকে ছাত্রদল কর্মীদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। হামলাকারী ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে ছিলেন ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল আমিন, জহুরুল হকের তানভীর, রিফাতসহ ৫০-৬০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : গত ১১ সেপ্টেম্বর পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মিছিলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হক জাকিরের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন ছাত্রলীগ ক্যাডার হাসুয়া, রামদা, হকিস্টিক, চাকু ও লাঠিসোটা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ছাত্রদলের আহ্বায়কসহ অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কমিটির সদস্যদের ওপর ছাত্রলীগের নির্মম হামলার একদিন পর রাজশাহীতে এ সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে।
আহতদের মধ্যে আহ্বায়ক আরাফাত রেজা আশিক ও সদস্য দেলওয়ার হোসেনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়। এছাড়া অন্য আহতদের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক তোজাম্মেল হক তোজা, কর্মী রবিন আহমেদ, মাসুদ, মোস্তফা, পাপন, রাশেদ, রিগান ও আরাফাতকে রাজশাহীর বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিত্সা দেয়া হয়। এ সময় পুলিশকে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়।
এদিকে ছাত্রদল উপর হামলাকারী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নামে হামলা ও বাস ভাংচুরের মামলা হয়েছে। ১১ তারিখ সন্ধ্যায় পদ্মা পরিবহনের বাস চালক আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে আহ্বায়কসহ ছাত্রদলের ৩০ জনের নাম উল্লেখসহ মোট ৬০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মতিহার থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা : গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভিসি ও প্রোভিসির অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। তারা শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষকদের অকথ্য গালাগাল করে। শিক্ষকদের জামায়াত-শিবির বলে আখ্যায়িত করে এবং ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছবি ধারণ করে। তাদের ক্যাম্পাসে একাকী চলাকালে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় এক নেতা। মাইক কেড়ে নিয়ে ভাংচুর চালায়। প্রশাসনিক ভবনের দোতালার তালাবদ্ধ কক্ষের দরজা ভাংচুর করে। শুধু তা-ই নয়, আন্দোলন বন্ধ করে সবাইকে চলে যেতে হুমকি দেয়।
এদিকে হামলার দুই দিন পর বুয়েটের পরিস্থিতি ও নিজেদের অবস্থান তুলে ছাত্রলীগের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়, আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো আবদার যেন মেনে নেয়া না হয়। শিক্ষামন্ত্রীর মিন্টো রোডের বাসায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছাত্রলীগ বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হল প্রশাসনের অপসারণের দাবিও না মানতে অনুরোধ জানায়।
এমসি কলেজকে আগুনে পোড়াল ছাত্রলীগ : গত ৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ছয়টায় এমসি কলেজ মাঠে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে কলেজ ছাত্রাবাসের পাঁচ নম্বর ব্লকের কাছে ছাত্রলীগের কর্মী ও কলেজের অর্থনীতি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ উজ্জ্বল আহত হন। এ খবর শুনে ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথমে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে সারিবদ্ধ থাকা পাঁচটি ব্লকের মধ্যে তিনটিতে আগুন দিয়ে চলে যান।
জানা যায়, তিনটি ব্লকে একসঙ্গে আগুন জ্বলে ওঠায় পুরো ছাত্রাবাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের খবর দেয়া হলেও ছাত্রাবাসের আশপাশ এলাকায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের কর্মীরা বিক্ষোভ করায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। রাত প্রায় সাড়ে নয়টার পর ছাত্রাবাসের পেছন দিক থেকে দমকল বাহিনীর সদস্যরা প্রবেশ করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন। এ ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ২৯ আগস্ট সাংবাদিকদের কাছে এমসি কলেজে গঠিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে কমিটির আহ্বায়ক ওই কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর আল হেলাল ভুঁইয়া বলেন, বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। ছাত্রাবাসে প্রবেশের সময় পুলিশ গেটে অবস্থান করলেও তাদের বাধা না দেয়ায় ওই দলের ক্যাডাররাই ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেয়।
কর্তব্যরত পুলিশকে দায়ী করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বহিরাগতদের বাধা দিলে এ অগ্নিকাণ্ডের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটত না। এ সময় ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক বশির আহমেদের দায়িত্ব পালনে মারাত্মক গাফিলতি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি বলে জানান কলেজের শিক্ষার্থীরা।
পুড়ে যাওয়া সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পরিদর্শনে ১২ জুলাই যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। মন্ত্রী বলেন, ‘এমন ভয়াবহ অবস্থা হবে, তা আমি ভাবতেও পারিনি। প্রথম ব্লকের এ কক্ষেই থাকতাম আমি। আমার পবিত্র একটি আবেগ এখানে জমা আছে। সেই আবেগ পুড়ে গেছে।’ দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেও তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার পর শিক্ষামন্ত্রীর আর কোনো উদ্যোগ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২৩ হত্যাকাণ্ড : বর্তমান সরকারের পৌনে চার বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২৩ মেধাবী ছাত্র ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনায় নিহত হয়েছে। ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগ-প্রতিপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৬০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জানা যায়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুই শিবিরকর্মী প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদ এবং ইংরেজি শেষ বর্ষের ছাত্র মাসুদ নিহত হয়। এছাড়া ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন, ২০১০ সালের ২৮ মার্চ মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশিদ কায়সার, ১৫ এপ্রিল হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আসাদুজ্জামানকে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সবচেয়ে বেশি ছাত্র নিহত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিবিরের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে এ সরকারের মেয়াদে নিহত হয়েছে ৩ ছাত্র। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগের পৈশাচিকতায় নিহত হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী (ছাত্রলীগের দাবি) ফারুক হোসেন। ১৫ আগস্ট নাসিম এবং ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয় ছাত্রলীগ কর্মী সোহেল। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-পুলিশের সংঘর্ষে নির্মমভাবে খুন হয় নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র আবু বকর। ৮ জানুয়ারি নিহত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব, ২০১০ সালের ১২ জুলাই সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগ কর্মী পলাশ, ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রদল নেতা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান, ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজানুল ইসলাম চৌধুরী, ২১ জানুয়ারি পাবনা টেক্সটাইল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্ত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ নিহত হয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাইসুল ইসলাম রাহিদ। সর্বশেষ গত ১২ মার্চ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল আজিজ খান সজীব মারা যায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্রয়দাতা : ছাত্রলীগের হামলায় এভাবে কিছুদিন পরপর এক একটি মেধাবী প্রাণ হারিয়ে গেলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপই নেয়নি সরকার। বরং দেশের এ বিষয়ে বরাবরই গাছাড়া বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে মেধাবী ছাত্র আবুবকর সিদ্দিকের মৃত্যুর ঘটনায় সাহারা খাতুন বলেন, ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এমনটি ঘটতেই পারে—এটা কোনো ব্যাপার না।’ এছাড়া রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস নিয়ে তিনি একই বোল গাইছেন। তার এমন দায়িত্বহীন বক্তব্যের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ছাত্রলীগের হামলা-সংঘর্ষে অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ তাদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করছে। খুন, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির ঘটনায় অধিকাংশ সময় মামলাও নেয় না থানা। দু’একটি ঘটনায় মামলা হলেও সহজেই পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। শিক্ষাঙ্গন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ছাত্রলীগের পক্ষেই একাধিকার সাফাই গেয়েছেন। অনেকটা প্রশ্রয়দাতার ভূমিকায় আছেন তিনি। আর শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও আছেন অনেকটা পুতুলের ভূমিকায়। বুয়েটে আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার দু’দিন পর শিক্ষামন্ত্রী বাসায় ডেকে সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সিলেট এমসি কলেজ পুড়িয়ে দেয়ার পর লোক দেখানো চোখের পানি ঝরালেও শিক্ষামন্ত্রী তদন্তে প্রমাণিত দোষী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে গেলে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ ছিল অনেকটা ছাত্রলীগের সহযোগীর ভূমিকায়। কয়েক গাড়ি পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম সামনে উপস্থিত থেকেই হামলা-সন্ত্রাসে মদত দিয়েছে। এর পরদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে গেলে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই হামলার ঘটনায় উল্টো ছাত্রদলের ৬০ নেতাকর্মীকে আসামি করে থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
গত বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আরেকটি বড় সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। বাণিজ্যে ব্যর্থ হয়ে ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় তারা। অ্যাম্বুলেন্স, বাস এবং ক্লাসরুমে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ক্যাডাররা। সন্ত্রাসীরা ভিসির কার্যালয়, প্রক্টর অফিস, টিএসসি পরিচালকের অফিস, পরিবহন প্রশাসকের অফিস, মেডিকেল সেন্টারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভাঙচুর করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল পুরোপুরি নীরব। ভিসি-প্রোভিসিকেও হামলার হুমকি দিলে তারা নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সূত্রে মহাজোট সরকারের পৌনে চার বছরে সারাদেশে ছাত্রলীগ এবং প্রতিপক্ষ সংগঠনের মধ্যে অন্তত ছয় শতাধিক ছোট-বড় সংঘর্ষ হয়েছে। এসব সংঘর্ষের অধিকাংশই হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বার বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রাণ দিতে হয়েছে ২৩ জনকে। বড় আকারের সংঘর্ষ হয়েছে—এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা প্রকৌশল, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল (বুয়েট), শেরে-ই-বাংলা কৃষি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, রাজশাহী প্রকৌশল এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, তিতুমীর কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজ, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, রংপুর মেডিকেল কলেজ, খুলনা বিএল কলেজ, মেহেরপুর কলেজ, সিলেট এমএম কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজ, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, বরিশাল পলিটেকনিক কলেজ, সিলেট মেডিকেল কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ ও সিলেট পলিটেকনিক কলেজ।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তাণ্ডব : তালিকা অনুযায়ী চাকরি না হওয়ায় ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ছাত্রলীগ। এতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসনিক ভবন থেকে শুরু করে মেডিকেল সেন্টার কিছুই রক্ষা পায়নি ছাত্রলীগ ক্যাডারদের রোষানল থেকে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার মমতাজ ভবনের সামনে থাকা গাড়িস্ট্যান্ডে একটি পেট্রল বোমার বিস্ফোরণ হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জাপানি হিনো বাসে আগুন ধরে যায়। বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ও আগুনের লেলিহান শিখায় শিক্ষকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আরও দুটি বাসের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সকাল ৯টার দিকে সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান তুহিনের নেতৃত্বে তাদের গ্রুপের নেতাকর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগের দলীয় টেন্টে জড়ো হয়। পরে তারা লাঠিসোটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি পরিচালক এবং সিন্ডিকেট সদস্য প্রফেসর ড. সেলিম তোহার কার্যালয়, পরিবহন প্রশাসক ড. রেজওয়ানুল ইসলামের কার্যালয়, ভিসি প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিনের কার্যালয়সহ প্রশাসন ভবনের বিভিন্ন কক্ষে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। দিনভর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু’কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে বলে জানা গেছে। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চরম আতঙ্কে ভুগছেন। আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা এরই মধ্যে আবাসিক হল ছাড়তে শুরু করেছে।
এদিকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন। সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ক্যাডাররা পেট্রলবোমা মেরে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, অ্যাম্বুলেন্স, ভিসির কার্যালয়, প্রক্টর অফিস, টিএসসি পরিচালকের অফিস, পরিবহন প্রশাসকের অফিস, মেডিকেল সেন্টারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিস ভাঙচুর করলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল পুরোপুরি অসহায়।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১৭তম সিন্ডেকেট সভায় প্রশাসন ৫৪টি বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে দলীয় বিবেচনায় ছাত্রলীগের দেয়া তালিকা অনুযায়ী ১১২ জনকে কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিয়োগ দেয়। কিন্তু ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের চাপে পরিস্থিতি সামাল দিতে ভিসি প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিন নিয়ম উপেক্ষা করে ক্ষমতাবলে আরও ৪২ জনকে গণনিয়োগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শামছুজ্জামান তুহিন প্রশাসনকে ২০০ জনের একটি তালিকা দিয়েছিলেন। চাকরি দেয়ার কথা বলে ওই ২০০ জনের প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সিন্ডিকেটের সভা আগেই ছাত্রলীগের তিনটি গ্রুপ ভিসি প্রফেসর ড. এম আলাউদ্দিনকে বিভিন্ন ধরনের চাপ ও হুমকি, এমনকি বোমাবাজি ও গোলাগুলির ঘটনাও ঘটায়। ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সরবরাহ করা তালিকা অনুযায়ী সবার চাকরি না হওয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক হামলা : গত ১০ সেপ্টেম্বর পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে গেলে ছাত্রদলের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আমজাদ আলীর উপস্থিতিতে চাপাতি, রড ও হকিস্টিক দিয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্রদলের পাঁচ কর্মীকে আহত করে। ওই হামলায় আব্বাস আলী, সোহাগ, রুহুল আমিন, মিজানুর রহমান ও রাশেদ নামে ছাত্রদলের এ পাঁচ কর্মী আহত হয়। একই সময় ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রদলের চার কর্মীকে আটক করে পুলিশ। হামলাকারী ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা।
ওইদিন ছাত্রদলের নবনির্বাচিত কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। প্রশাসন সূত্রে বিষয়টি জেনে ছাত্রলীগ সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফটকে ছাত্রদলকে হামলার জন্য মহরা দিতে থাকে। বিষয়টি প্রশাসন লক্ষ্য করেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পরে দুপুরে ছাত্রদলের কিছু নেতাকর্মী প্রশাসনিক ভবনের দিকে যেতে চাইলে প্রক্টর তাদের থামিয়ে পরিচয়পত্র দেখাতে বলেন। এ সময় পাশে থাকা ছাত্রলীগ কর্মীরা এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে। ছাত্রদল কর্মীরা জীবন বাচাতে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা তাদের চাপাতি, রড, স্ট্যাম্প দিয়ে ঘণ্টাব্যাপী পেটাতে থাকে। পরে উপস্থিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা ছাত্রলীগের হাত থেকে ছাত্রদল কর্মীদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। হামলাকারী ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে ছিলেন ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আল আমিন, জহুরুল হকের তানভীর, রিফাতসহ ৫০-৬০ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : গত ১১ সেপ্টেম্বর পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মিছিলে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জহিরুল হক জাকিরের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন ছাত্রলীগ ক্যাডার হাসুয়া, রামদা, হকিস্টিক, চাকু ও লাঠিসোটা নিয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে ছাত্রদলের আহ্বায়কসহ অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কমিটির সদস্যদের ওপর ছাত্রলীগের নির্মম হামলার একদিন পর রাজশাহীতে এ সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে।
আহতদের মধ্যে আহ্বায়ক আরাফাত রেজা আশিক ও সদস্য দেলওয়ার হোসেনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করা হয়। এছাড়া অন্য আহতদের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক তোজাম্মেল হক তোজা, কর্মী রবিন আহমেদ, মাসুদ, মোস্তফা, পাপন, রাশেদ, রিগান ও আরাফাতকে রাজশাহীর বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিত্সা দেয়া হয়। এ সময় পুলিশকে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়।
এদিকে ছাত্রদল উপর হামলাকারী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নামে হামলা ও বাস ভাংচুরের মামলা হয়েছে। ১১ তারিখ সন্ধ্যায় পদ্মা পরিবহনের বাস চালক আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে আহ্বায়কসহ ছাত্রদলের ৩০ জনের নাম উল্লেখসহ মোট ৬০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মতিহার থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
বুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা : গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভিসি ও প্রোভিসির অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায় ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। তারা শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষকদের অকথ্য গালাগাল করে। শিক্ষকদের জামায়াত-শিবির বলে আখ্যায়িত করে এবং ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ছবি ধারণ করে। তাদের ক্যাম্পাসে একাকী চলাকালে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয় এক নেতা। মাইক কেড়ে নিয়ে ভাংচুর চালায়। প্রশাসনিক ভবনের দোতালার তালাবদ্ধ কক্ষের দরজা ভাংচুর করে। শুধু তা-ই নয়, আন্দোলন বন্ধ করে সবাইকে চলে যেতে হুমকি দেয়।
এদিকে হামলার দুই দিন পর বুয়েটের পরিস্থিতি ও নিজেদের অবস্থান তুলে ছাত্রলীগের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই বৈঠকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করা হয়, আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো আবদার যেন মেনে নেয়া না হয়। শিক্ষামন্ত্রীর মিন্টো রোডের বাসায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ছাত্রলীগ বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হল প্রশাসনের অপসারণের দাবিও না মানতে অনুরোধ জানায়।
এমসি কলেজকে আগুনে পোড়াল ছাত্রলীগ : গত ৮ জুলাই বিকাল সাড়ে ছয়টায় এমসি কলেজ মাঠে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে কলেজ ছাত্রাবাসের পাঁচ নম্বর ব্লকের কাছে ছাত্রলীগের কর্মী ও কলেজের অর্থনীতি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মোহাম্মদ উজ্জ্বল আহত হন। এ খবর শুনে ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রথমে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে সারিবদ্ধ থাকা পাঁচটি ব্লকের মধ্যে তিনটিতে আগুন দিয়ে চলে যান।
জানা যায়, তিনটি ব্লকে একসঙ্গে আগুন জ্বলে ওঠায় পুরো ছাত্রাবাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের খবর দেয়া হলেও ছাত্রাবাসের আশপাশ এলাকায় বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের কর্মীরা বিক্ষোভ করায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। রাত প্রায় সাড়ে নয়টার পর ছাত্রাবাসের পেছন দিক থেকে দমকল বাহিনীর সদস্যরা প্রবেশ করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছেন। এ ঘটনায় কলেজ কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ২৯ আগস্ট সাংবাদিকদের কাছে এমসি কলেজে গঠিত অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে কমিটির আহ্বায়ক ওই কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর আল হেলাল ভুঁইয়া বলেন, বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়ে। ছাত্রাবাসে প্রবেশের সময় পুলিশ গেটে অবস্থান করলেও তাদের বাধা না দেয়ায় ওই দলের ক্যাডাররাই ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দেয়।
কর্তব্যরত পুলিশকে দায়ী করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বহিরাগতদের বাধা দিলে এ অগ্নিকাণ্ডের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটত না। এ সময় ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক বশির আহমেদের দায়িত্ব পালনে মারাত্মক গাফিলতি ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি বলে জানান কলেজের শিক্ষার্থীরা।
পুড়ে যাওয়া সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পরিদর্শনে ১২ জুলাই যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। মন্ত্রী বলেন, ‘এমন ভয়াবহ অবস্থা হবে, তা আমি ভাবতেও পারিনি। প্রথম ব্লকের এ কক্ষেই থাকতাম আমি। আমার পবিত্র একটি আবেগ এখানে জমা আছে। সেই আবেগ পুড়ে গেছে।’ দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেও তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার পর শিক্ষামন্ত্রীর আর কোনো উদ্যোগ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২৩ হত্যাকাণ্ড : বর্তমান সরকারের পৌনে চার বছরে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ২৩ মেধাবী ছাত্র ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী ঘটনায় নিহত হয়েছে। ছাত্রলীগ-ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগ-প্রতিপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ৬০টি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্ধারিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। জানা যায়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দুই শিবিরকর্মী প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মুজাহিদ এবং ইংরেজি শেষ বর্ষের ছাত্র মাসুদ নিহত হয়। এছাড়া ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন, ২০১০ সালের ২৮ মার্চ মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র হারুন অর রশিদ কায়সার, ১৫ এপ্রিল হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আসাদুজ্জামানকে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পর সবচেয়ে বেশি ছাত্র নিহত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিবিরের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে এ সরকারের মেয়াদে নিহত হয়েছে ৩ ছাত্র। ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ ছাত্রলীগের পৈশাচিকতায় নিহত হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নিহত হয় ছাত্রলীগ কর্মী (ছাত্রলীগের দাবি) ফারুক হোসেন। ১৫ আগস্ট নাসিম এবং ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয় ছাত্রলীগ কর্মী সোহেল। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-পুলিশের সংঘর্ষে নির্মমভাবে খুন হয় নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র আবু বকর। ৮ জানুয়ারি নিহত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব, ২০১০ সালের ১২ জুলাই সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগ কর্মী পলাশ, ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রদল নেতা চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবিদুর রহমান, ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজানুল ইসলাম চৌধুরী, ২১ জানুয়ারি পাবনা টেক্সটাইল কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্ত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১১ নিহত হয় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাইসুল ইসলাম রাহিদ। সর্বশেষ গত ১২ মার্চ অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবদুল আজিজ খান সজীব মারা যায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্রয়দাতা : ছাত্রলীগের হামলায় এভাবে কিছুদিন পরপর এক একটি মেধাবী প্রাণ হারিয়ে গেলেও কার্যকরী কোনো পদক্ষেপই নেয়নি সরকার। বরং দেশের এ বিষয়ে বরাবরই গাছাড়া বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে মেধাবী ছাত্র আবুবকর সিদ্দিকের মৃত্যুর ঘটনায় সাহারা খাতুন বলেন, ‘এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এমনটি ঘটতেই পারে—এটা কোনো ব্যাপার না।’ এছাড়া রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস নিয়ে তিনি একই বোল গাইছেন। তার এমন দায়িত্বহীন বক্তব্যের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন