সোমবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১২

খালেদা জিয়ার চিন্তাভাবনা




মহিউদ্দিন খান মোহন সংকলিত প্রিয় দেশবাসী বইটি বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬ সময়ে প্রদত্ত ভাষণের নির্বাচিত অংশ। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন লিখিতভাবে, সেগুলো থেকে বাছাই করে এটি প্রস্তুত করা হয়েছে। ভাষণগুলো বেশি বড় নয়, ১ থেকে ২ পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর ভূমিকা লিখেছেন সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে। তিনি বেগম জিয়াকে তুলনা করেছেন দীর্ঘ এক তাল গাছের সঙ্গে। এ তুলনা ঠিকই আছে, তবে আমাদের মনে হয় অন্যভাবেও তুলনা করা যায়। আমি তাকে একটি বিশাল বটবৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করতে চাই।
বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৩৮। অনুমান করা যায় প্রায় চারশ’র মতো ভাষণ এর মধ্যে আছে। সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্প—সব বিষয়ে ভাষণ এর মধ্যে আছে। এত বৃহত্ বইয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই। আমরা ৫-৭টি ভাষণ থেকে বেগম জিয়ার চিন্তাভাবনার পরিচয় জানতে চেষ্টা করি। বলা হবে এগুলো বেগম জিয়ার নিজের লেখা নয়, ফলে তা থেকে তার চিন্তাভাবনা খোঁজ করা পণ্ডশ্রম হবে। বক্তব্যটি আংশিক সত্য, পুরোপুরি নয়। সব দেশেই রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, সচিব এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা আনুষ্ঠানিক সভা-সমিতিতে লিখিত যে ভাষণ দেন, তা লেখায় অন্যরা তাকে সাহায্য করে থাকেন। এক সময় বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল সম্পর্কেও এসব কথা উঠেছিল। তার জবাবটি স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, আমার সচিব অবশ্যই আমার লেখার মুসাবিদা করেন। তবে আমার প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি একটি খসড়া তৈরি করেন। আমি আবার দেখে দিলে তিনি পূর্ণাঙ্গ কপি তৈরি করেন। ফলে বক্তব্য আমার, কিন্তু ভাষা সম্পূর্ণ আমার নয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যে ভাষণ দেন সেগুলো সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য।
‘জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার প্রধান মাধ্যম বই’ শিরোনামের একটি ভাষণ বেগম জিয়া দিয়েছেন। ‘সরকারের চিন্তাভাবনা ও আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি নিয়ে’ এটি রচিত। তিনি লিখেছেন, সমাজ উন্নয়নে রিডিং সোসাইটির কোনো বিকল্প নেই। সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের জন্য, সব পেশার জন্য, শিশু-কিশোর-বৃদ্ধের জন্য শুধু অবসরকালে আনন্দ লাভের জন্যই নয়—পেশাগত জীবনে নিজ নিজ প্রয়োজন মেটানোর জন্য উপযুক্ত সব ধরনের, সব বিষয়ের বই দরকার। শুধু ছাপাই নয়, বইয়ের বিষয়বস্তুগত মানও উন্নত হওয়া আবশ্যক। আমাদের শিশুরা এবং স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অনেক ক্ষেত্রে বইপত্র হেলাফেলা করে লেখা ও ছাপা হয় বলেই বই পড়তে আগ্রহবোধ করে না।’
শেষের বাক্যটি পড়ে চমকে উঠতে হয়। শিশু-কিশোরদের বই হওয়া উচিত দৃষ্টিশোভন, যাতে সহজেই শিশুরা আকৃষ্ট হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হয় বিপরীত। মুদ্রণ যেন-তেন ধরনের। বাজে ধরনের নিউজপ্রিন্ট কাগজ। শিশু পাঠকরা বই পড়ে শুধু অভিভাবকদের ধমকানি ও শিক্ষকদের বেতের ভয়ে।
তিনি আরও বলেছেন, ‘সনদ ও ডিগ্রি বিতরণের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মক্ষেত্র সীমিত থাকতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে নতুন নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও গবেষণার পীঠস্থান। দেশের চাহিদা অনুযায়ী আমরা একটি গণতান্ত্রিক ও উত্পাদনমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চাই। আমরা জোর দিতে চাই যুগোপযোগী বিজ্ঞান, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপর। আমাদের এসব লক্ষ্য অর্জনে নবপ্রতিষ্ঠিত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় মূল্যবান অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদী।’
শিক্ষা সম্পর্কে তিনি সুযোগ পেলেই নিজের চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে শিক্ষক, গবেষক ও বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, যার যার অবস্থানে দাঁড়িয়ে দেশবাসীর প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।
বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে রাজনীতি প্রভাবিত আমলারা তাকে অতিষ্ঠ করত বেশি। আমলাদের তিনি ভালোভাবে চিনেছিলেন। নিচের উদ্ধৃতিটি আমলাদের চরিত্র সম্পর্কে তার তিক্ত অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেন—‘কিছুদিন আগে আমি সচিবালয়ে গিয়েছিলম। তখন আপনাদের অনেককেই আমি নিজ নিজ আসনে পাইনি। বৃহস্পতিবার আমি সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। অনেকেই অভিযোগ করেছেন, সরকারি অফিসে গেলে হয়রানি হতে হয়, কাজ হয় না। জনগণকে হয়রানি করবেন না। তাদের সেবক হিসেবে নিজেদের ভাবতে শিখুন। এই গরিব-দুঃখী মানুষের ট্যাক্সেই আপনাদের বেতন দেয়া হয়। তাদের প্রতি আপনারা দায়িত্ব পালন করুন।
আমলা বললে এক সময় একজন দক্ষ এবং ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন কর্মকর্তার ছবি ভেসে উঠত। এখন আমলাতন্ত্র বললে হয়রানি ও দীর্ঘসূত্রতার ছবি ভেসে ওঠে। আমরা দক্ষ আমলা চাই। দীর্ঘসূত্রতা ও জনগণকে হয়রানির আমলাতন্ত্র চাই না। জনগণের উন্নয়নে ও কল্যাণে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে নিজেদের এই অপবাদ ঘুচান। ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করুন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। এই প্রত্যাশা আপনাদের পূরণ করতে হবে। জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থায় সাফল্য ও ব্যর্থতার দায়িত্ব আমাদের এবং আপনাদের সমানভাবে বহন করতে হবে।’
বেগম জিয়ার বক্তব্যগুলো নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, তবে তার প্রয়োজনে সহজ-সরল বাংলায় নাতিহ্রস্ব বাক্যে তিনি তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল, দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সহজ-সরল জীবন দর্শনের অনুরাগী মানুষগুলো। সে জন্য তাদের কথা মনে রেখে তিনি সরল বাগবিন্যাস করেন। এবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে তার ধারণার পরিচয় দিয়ে লেখার সমাপ্তি টানতে চাই—‘বাংলাদেশে এসে নতুন রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল। তা হয়েছিল এখানকার মানুষ আর প্রকৃতির নিবিড় সংস্পর্শে আসার কারণে। তিনি দেখলেন প্রকৃতি ছাড়া মানুষ পূর্ণ নয়। দেখলেন এই প্রকৃতির কত রূপ। সে কখনও শান্ত, কখনও অশান্ত, কখনও স্নিগ্ধ, কখনও ভয়ঙ্কর। এই বিরূপ প্রকৃতিকে জয় করার অদম্য স্পৃহা এবং সাহস দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন। পূর্ববাংলায় এসেই রবীন্দ্র মানুষ সম্পর্কে নতুন ধারণা লাভ করেন। আর তাই তিনি ভালো বেসেছিলেন এখানকার মাটি এবং মানুষকে। রবীন্দ্রনাথ যে মানবতার কবি, বিশ্বমানবের কবি, সেই ধারণা এবং মানুষ সম্পর্কে তার বিশ্বাস তিনি লাভ করেন পূর্ববাংলার সরল কিন্তু পরিশ্রমী মানুষের সংস্পর্শে এসে।’
খালেদা জিয়ার এসব বক্তব্য যে গভীর চিন্তাপ্রসূত ও নিজস্ব উপলব্ধি থেকে প্রাপ্ত, তা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু তার এই চিন্তার উত্স কী? তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ মারাননি, জিয়াউর রহমানের হত্যার আগ পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন তেমন পাথুরে প্রমাণ দুর্লভ। দুর্লভ হলেও ফলাফল হাতের কাছে আছে। আমরা কিছু অনুমান করতে চেষ্টা করব।
বেগম জিয়ার মেধা আছে, মর্মভেদী কৌতূহল আছে, মানুষ ও দেশের প্রতি আছে তার প্রগাঢ় ভালোবাসা। তিনি ছিলেন রাজপথের লড়াকু সৈনিক। মানুষের কাছে যাওয়ার সব পথ ও রাস্তায় তিনি পদচারণা করেছেন। তিনি মিছিল করেছেন এবং মিটিং করেছেন, লংমার্চ করেছেন, মিছিলে অগ্রভাগে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ ধরনের অভিজ্ঞতা তার আগে ছিল না। আন্দোলনের একেকটি পর্যায় পার হয়েছে আর তিনি নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধতর হয়েছেন। একেই তো ছিল তার অন্তর্গত মেধা আর অর্জন করেছেন অভিজ্ঞতালব্ধ প্রজ্ঞা। ব্যক্তিগত শোক-দুঃখকে তিনি রাজনীতিতে পুঁজি করেননি, পাকা অভিনেত্রীর মতো চোখের পানি ফেলে মানুষের মন ভেজাতে চাননি। মন ভেজানোর চেয়ে তাকে উদ্বুদ্ধ করা তার কাছে বেশি প্রয়োজন মনে হয়েছে। তিনি সবার মধ্যে লড়াকু মনোভাব সঞ্চারিত করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের মলিন মুখোচ্ছবি তাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছে, মাটি ও মানুষের ভালোবাসা তার মনোভাবকে দৃঢ়তর করেছে। এ থেকে জন্ম নিয়েছে যে ভাবনাচিন্তা তারই সামান্য অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads