কাজী জহিরুল ইসলাম
উত্সব আমেজে মুখর এখন ম্যানহাটন। ২৫ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে জাতিসংঘের ৬৭তম সাধারণ অধিবেশন। জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে থেকে ম্যানহাটনের প্রধান পাঁচটি পশ্চিমমুখী সড়কের শুরু। ৪২ থেকে ৪৭ এভিনিউ। সবক’টি সড়ক এখন এনওয়াইপিডির নিরাপত্তা বেষ্টনীর দখলে। যথাযথ আইডি ছাড়া ঢুকতে পারছে না কেউ। ৪৭তম সড়কটি এর ব্যতিক্রম। প্রায় পাঁচশ’ ফুট প্রশস্ত এই সড়কটির আশি শতাংশজুড়ে ফুটপাত। যার এক পাশে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। বলা যায় পুরো সড়কটিই একটি পার্ক। আর এটি এখন পরিণত হয়েছে ম্যানহাটনের ট্রাফেলগার স্কয়ারে। বছরজুড়েই এখানে পৃথিবীর নানা জাতি-গোত্রের লোকেরা জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, বিশ্বের সর্বোচ্চ ফোরামের কাছে তুলে ধরে তাদের পাওয়া-না পাওয়ার দাবি-দাওয়া। প্রায়ই দেখি অসহায় তিব্বতিয়ানরা পথচারীদের হাতে তুলে দিচ্ছে এক পাতার একটি লিফলেট, আর ‘ওয়েক আপ ইউএন, ওয়েক আপ ইউএন’ স্লোগানে কাঁপিয়ে তুলছে ম্যানহাটনের আকাশ-বাতাস। তুর্কি এবং ইরাকি শাসককুলের বিরুদ্ধেও ঘৃণার তীর ছুড়তে দেখি স্বাধীনতাকামী কুর্দিদের। ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমদিনেজাদের পক্ষে-বিপক্ষে দুই দল মুখোমুখি। নির্যাতিত তিব্বতিয়ানদের নিঃশ্বাসে ম্যানহাটনের বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও ভেটো ক্ষমতায় বলীয়ান চীনা শাসকদের মন গলে না। জাতিসংঘের প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্রকে জাগাতে পারে না অসহায় তিব্বতিয়ানরা, পারে না স্বাধীন কুর্দিস্তানের স্বপ্নে বিভোর স্বপ্নচারী কুর্দি সম্প্রদায়। জাতিসংঘ জেগে ওঠে না রক্তাক্ত ফিলিস্তিনি শিশুর আর্তচিত্কারে। এই কুম্ভকর্ণের ঘুম কি ভাঙবে কখনও?
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যায় ভাষণ দেবেন জাতিসংঘের ৬৭তম সাধারণ অধিবেশনে। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। টাইমস স্কয়ারের নিচে হেলে পড়েছে বিকালের সূর্য। ৪৭ নম্বর সড়কের দখল এখন দক্ষিণ এশিয়ার একদল প্রবাসীর পদতলে। গায়ে তাদের শোকের কালো পোশাক। বুকে সাদা কাগজে লেখা—‘তুই চোর’। আমাদের বুঝতে আর বাকি থাকে না এরা কারা, কার দিকে ছোড়া হচ্ছে এই তীক্ষষ্ট ঘৃণার তীর। বিষয়টি আমাকে আহত করে। এটা না করলেই কি হতো না? আমরা কি দেশের বাইরে এসে সব বিভক্তির খানাখন্দ পেরিয়ে এক অভিন্ন বাংলাদেশের মানুষ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলতে পারি না, ‘আমরা সবাই বাংলাদেশী?’
২০০৪ সালে আমি যখন প্রথমবার নিউইয়র্কে আসি তখন একদল প্রবাসী বাংলাদেশী আমাকে জেএফকে থেকে তুলে সোজা নিয়ে যায় একটি গোপন সভায়। মুজিব বাহিনী দৈনিক গণকণ্ঠের অফিস পুড়িয়ে দেয়ার পর সত্তরের দশকে কিছু জাসদ নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরাই আবার পরে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে জড়ো হয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সেই গোপন সভায় আমি এরকম কয়েকজনকে দেখি। তারা সিদ্ধান্ত নেন, তত্কালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, বোমা সন্ত্রাসের মদতদাতা—এসব অভিযোগ তুলে একটি লিফলেট তৈরি করা হবে এবং তা আমেরিকায় অবস্থিত সব কূটনৈতিক মিশনে প্রদান করা হবে। বাইরে থেকে চাপ দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আমি সদ্য বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমার কাছে ওরা কিছু তাজা খবর শুনতে চায়। ওদের আত্মঘাতী কথাবার্তা শুনে আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে। আমি দেশের কোনো খবর না শুনিয়ে বরং অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলি, এই কাজটি আপনারা কিছুতেই করবেন না। নিজের হাঁড়ির খবর বাইরের মানুষকে জানালে জাতি হিসেবে আমরাই ছোট হয়ে যাব।
এখন আমি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কক্ষে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, ৬৭তম অধিবেশনে আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনার জন্য। সাধারণ পরিষদের সভাপতির আসনে তখন আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলায় ভাষণ দেয়া শুরু করলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, বিগত সরকার বাংলাদেশকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে বিভিন্ন ইসলামী উগ্রপন্থীরা পরিচালনা করত, সেটাও তাদের নাম-ধাম উল্লেখ করে বলে দিলেন। বিশ্ববাসীকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইলেন, বাংলাদেশ মুসলিম জঙ্গিবাদের একটি আখড়া। ঠিক এই কথাই তো আজ থেকে ৮ বছর আগে নিউইয়র্কের এক গোপন সভায় শুনেছিলাম। ওরা যে লিফলেট বিলি করতে চেয়েছিল, সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী করে দিলেন।
গত দুই দশক ধরে ভারতীয় ইন্টেলেকচুয়ালরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। ভারতীয়দের দৃষ্টিতে রোহিঙ্গা সমস্যা, আসাম সমস্যা, উগ্রপন্থী-জঙ্গিবাদ সমস্যাসহ সব সমস্যার সূতিকাগার হলো বাংলাদেশ। কাজেই বাংলাদেশ দখল করে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে সেই কাজটিই করছে ভারত। আজকের বাংলাদেশ যে ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখি আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সর্বোচ্চ ফোরামে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের অভিযোগগুলোকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
আফসোস, বিরোধী দল এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো গঠনমূলক সমালোচনা করে না।
নিউইয়র্ক
২৭/০৯/২০১২
লেখক : কবি, কলাম লেখক
আজ ২৭ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যায় ভাষণ দেবেন জাতিসংঘের ৬৭তম সাধারণ অধিবেশনে। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। টাইমস স্কয়ারের নিচে হেলে পড়েছে বিকালের সূর্য। ৪৭ নম্বর সড়কের দখল এখন দক্ষিণ এশিয়ার একদল প্রবাসীর পদতলে। গায়ে তাদের শোকের কালো পোশাক। বুকে সাদা কাগজে লেখা—‘তুই চোর’। আমাদের বুঝতে আর বাকি থাকে না এরা কারা, কার দিকে ছোড়া হচ্ছে এই তীক্ষষ্ট ঘৃণার তীর। বিষয়টি আমাকে আহত করে। এটা না করলেই কি হতো না? আমরা কি দেশের বাইরে এসে সব বিভক্তির খানাখন্দ পেরিয়ে এক অভিন্ন বাংলাদেশের মানুষ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলতে পারি না, ‘আমরা সবাই বাংলাদেশী?’
২০০৪ সালে আমি যখন প্রথমবার নিউইয়র্কে আসি তখন একদল প্রবাসী বাংলাদেশী আমাকে জেএফকে থেকে তুলে সোজা নিয়ে যায় একটি গোপন সভায়। মুজিব বাহিনী দৈনিক গণকণ্ঠের অফিস পুড়িয়ে দেয়ার পর সত্তরের দশকে কিছু জাসদ নেতা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরাই আবার পরে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে জড়ো হয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সেই গোপন সভায় আমি এরকম কয়েকজনকে দেখি। তারা সিদ্ধান্ত নেন, তত্কালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, বোমা সন্ত্রাসের মদতদাতা—এসব অভিযোগ তুলে একটি লিফলেট তৈরি করা হবে এবং তা আমেরিকায় অবস্থিত সব কূটনৈতিক মিশনে প্রদান করা হবে। বাইরে থেকে চাপ দিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আমি সদ্য বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমার কাছে ওরা কিছু তাজা খবর শুনতে চায়। ওদের আত্মঘাতী কথাবার্তা শুনে আমার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে। আমি দেশের কোনো খবর না শুনিয়ে বরং অত্যন্ত দৃঢ়কণ্ঠে বলি, এই কাজটি আপনারা কিছুতেই করবেন না। নিজের হাঁড়ির খবর বাইরের মানুষকে জানালে জাতি হিসেবে আমরাই ছোট হয়ে যাব।
এখন আমি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কক্ষে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, ৬৭তম অধিবেশনে আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনার জন্য। সাধারণ পরিষদের সভাপতির আসনে তখন আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলায় ভাষণ দেয়া শুরু করলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলতে শুরু করলেন, বিগত সরকার বাংলাদেশকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল। এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যে বিভিন্ন ইসলামী উগ্রপন্থীরা পরিচালনা করত, সেটাও তাদের নাম-ধাম উল্লেখ করে বলে দিলেন। বিশ্ববাসীকে তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইলেন, বাংলাদেশ মুসলিম জঙ্গিবাদের একটি আখড়া। ঠিক এই কথাই তো আজ থেকে ৮ বছর আগে নিউইয়র্কের এক গোপন সভায় শুনেছিলাম। ওরা যে লিফলেট বিলি করতে চেয়েছিল, সেটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী করে দিলেন।
গত দুই দশক ধরে ভারতীয় ইন্টেলেকচুয়ালরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সব সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। ভারতীয়দের দৃষ্টিতে রোহিঙ্গা সমস্যা, আসাম সমস্যা, উগ্রপন্থী-জঙ্গিবাদ সমস্যাসহ সব সমস্যার সূতিকাগার হলো বাংলাদেশ। কাজেই বাংলাদেশ দখল করে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে সেই কাজটিই করছে ভারত। আজকের বাংলাদেশ যে ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখি আমার দেশের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সর্বোচ্চ ফোরামে দাঁড়িয়ে ভারতীয়দের অভিযোগগুলোকে স্বীকৃতি প্রদান করেন।
আফসোস, বিরোধী দল এই বিষয়গুলো নিয়ে কোনো গঠনমূলক সমালোচনা করে না।
নিউইয়র্ক
২৭/০৯/২০১২
লেখক : কবি, কলাম লেখক
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন