তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া আদালতের রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, নৈতিকতাবিরোধী, অগ্রহণযোগ্য, পক্ষপাতদুষ্ট ও বাতিলযোগ্য হিসেবে বর্ণনা করে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া।
গতকাল গুলশানে নিজ কার্যালয়ে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া আদালতের রায়ের ব্যাপারে বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের অবস্থান তুলে ধরেন। প্রকাশ্য আদালতে দেয়া সংক্ষিপ্ত ও ষোলো মাস পর দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে অসঙ্গতি তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, এ রায় বিচারিক অসদাচরণ। একজন বিচারক অবসর নিলে তিনি আর আদালতে বসতে পারেন না। একইভাবে রায়ে সই করতে পারেন না। কিন্তু সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তা-ই করেছেন। তাই এ রায় অগ্রহণযোগ্য।
দু’ধরনের রায় দিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, গত ১০ মে আদালতে যে রায় দেয়া হয়েছিল, সেখানে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন বিচারপতিদের বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন নির্দলীয় সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা। এমন গরমিল নজিরবিহীন এবং হীন রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ বি এম খায়রুল হকের রায়ে নির্বাচনের যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি। আদালতের রায়কে রাজনীতিকীকরণের এ এক চরম নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত।
খালেদা জিয়া বলেন, আদালতের রায়ের এক অংশে বলা হয়েছে, অনির্বাচিত ব্যক্তি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন না আবার রায়ের অন্য অংশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। তিনি বলেন, সংসদ বহাল না থাকলে কেউ নির্বাচিত থাকেন না। তাহলে অনির্বাচিতরা কোন আইনে থাকবে? এটি রায়ের অসংখ্য স্ববিরোধিতার একটি বলে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগই শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সংসদ ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা বলে চিহ্নিত করে খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থেকে সাজানো নির্বাচনের অপচেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। খালেদা জিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিচারপতির রায়ে দেশে অনভিপ্রেত অবস্থার সৃষ্টি হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ার পর সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নেরও উত্তর দেন বিরোধীদলীয় নেতা। সংবাদ সম্মেলন চলাকালে আটবার বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করায় তার টানা বক্তব্য বাধাগ্রস্ত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার এমপি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান বিচারপতি টি এইচ খান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বিরোধীদলীয় নেতার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, ব্যক্তিগত সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় নেতা আবুল খায়ের ভূঁইয়া এমপি, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, শামীমুর রহমান শামীম, আবদুল লতিফ জনি, রেহেনা আক্তার রানু এমপি প্রমুখ।
সদ্যঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রসঙ্গে ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি (খায়রুল হক) প্রকাশ্য আদালতে যে সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন, তার সঙ্গে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর, কয়েক দিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব এবং বিচারিক অসদাচারণ। পূর্ণাঙ্গ রায়ের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত রায়ের অমিল রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর বিধান রেখেছে। সদ্যঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ৪২ দিনের উল্লেখ স্পষ্ট সরকারি ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্যই রায়ে এসব পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ওই রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের স্বাক্ষর করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদা জিয়া বলেন, অবসরে যাওয়া কোনো বিচারপতি যেহেতু শপথের অধীনে থাকেন না, তাই কোনো মামলার রায়ও লিখতে পারেন না। একই কারণে কোনো রায়ে দস্তখতও করতে পারেন না। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি তা-ই করেছেন। তাই এ রায় যৌক্তিক কারণেই পক্ষপাতদুষ্ট, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিএনপির সহ-সভাপতি বিচারপতি টি এইচ খান বলেন, অবসর নেয়ার পর তার কোনো শপথ থাকে না। এক্ষেত্রে অবসরের পর প্রধান বিচারপতি যখনই রায় দেন না কেন, ওই রায় দেয়ার ক্ষমতা তার নেই, তার নেই , তার নেই। তাই এ রায় অশুদ্ধ হিসেবে থাকবে। অবসরের পর ওই শপথ কার্যকর থাকে কি না—এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, শপথ না থাকলে তার রায়ের কার্যকারিতা কি থাকতে পারে?
সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট ‘গভীর’ করবে বলে মনে করেন বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি বলেন, এ রায়ের কারণে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং এতে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ হওয়ায় বিধান অনুযায়ী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তবে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন বিএনপি হতে দেবে না বলে দৃপ্ত কণ্ঠে আবারও ঘোষণা দেন বিরোধী দলীয় নেতা।
তিনি বলেন, সরকার যদি সংবিধান সংশোধনের বিল পাস না করে, তাহলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়ের কারণে চলমান আন্দোলনকে কেউ দুর্বল করতে পারবে না। নির্দলীয় সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না; জনগণ তা প্রতিহত করবে।
লিখিত বক্তব্যের পর এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা বলেন, আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। নির্দলীয় সরকারের দাবি এখন জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষ মনে করে, নির্দলীয় সরকার না হলে তারা ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে না।
আগাম নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন কি না—জানতে চাইলে খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনাদের কাছে কোনো সুস্পষ্ট সংবাদ আছে কি? আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, নির্দলীয় সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না। ওই ধরনের নির্বাচন হতেও দেয়া হবে না।
তত্ত্বাবধায় সরকার প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের বিপরীত অবস্থানের কারণে আবার জরুরি অবস্থা জারির পথ তৈরি হচ্ছে কি না—প্রশ্ন করা হলে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। আমরা মনে করি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে না।
আবার এক-এগারোর আশঙ্কা করেন কি না—প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, সবসময় আমরা চেয়েছি গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত থাকুক। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত থাকুক। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুনির্দিষ্ট সুযোগ থাকুক। এজন্য আমাদের লড়াই চলছে, চলবে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে আদালত যখন তত্ত্বাবধায়ক বাতিল সংক্রান্ত রায় দিয়েছিল, তখনই বিরোধীদলীয় নেতা সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আদালতের দেয়া এ রায়ে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হবে এবং ওই রায় বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন তখন বেগম জিয়া। আপনারা দেখছেন, সেই রায় নিয়ে সরকার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে চলেছে। জনগণ এ রায় মানবে না। গণতান্ত্রিক দেশে এ রায় অকার্যকর।
বেগম জিয়া লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৯৯৬ সালের আগে দেশের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল না। ১৯৯৫ সাল থেকে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীসহ কতিপয় রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। তারা দিনের পর দিন হরতাল করেছে, যানবাহন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে, নিরীহ মানুষের জীবন নাশ করেছে, সংসদ বর্জন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এই দাবিতে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছে। তাদের সেই পদত্যাগের ফলে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করি। এই বিধানের অধীনে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো পুনরায় আন্দোলনের নামে সহিংসতা শুরু করে। ক্রমাগত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি, অবরোধ এবং শেষ পর্যন্ত লগি- বৈঠা আন্দোলনে প্রকাশ্য রাজপথে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটিয়ে তারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এরই সুযোগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির আবরণে দেশে চলমান গণতন্ত্র ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মাবরণে সেনা সমর্থিত এক অসাংবিধানিক সরকার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই অসাংবিধানিক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে ঘোষণা দেন এবং তাদের সব অপকর্মকে আগাম বৈধতা প্রদান করেন। দীর্ঘ দু’বছর ধরে সেই সরকার দেশকে রাজনীতিহীন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন করার অপচেষ্টা চালায়। তাদের অপশাসনে অতিষ্ঠ জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা জরুরি অবস্থা বহাল রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। আমরা জরুরি অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তারা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সেই অবৈধ সরকারের সব অপকর্মের বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত করে এবং জরুরি অবস্থার মধ্যেই নির্বাচনে যেতে রাজি হয়। তাদের এই আঁতাত বুঝতে পেরেও জনগণকে তাদের হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া এবং অনির্বাচিত স্বৈরশাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করার জন্য আমরা নির্বাচনে অংশ নেই। নীল নকশার সেই নির্বাচনে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সহায়তায় ব্যাপক কারচুপি সম্পর্কে আপনারা সবাই অবহিত।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কখনও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেনি। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ সম্পর্কে কোনো কথা নেই। এমনকি সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে গঠিত সংসদীয় কমিটিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। একইভাবে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশার সংগঠন, সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এরপর সরকার তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় নির্বাচনে অবধারিত পরাজয়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে মত পাল্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কথা বলা শুরু করে। অন্যদিকে সে সময় নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক হঠাত্ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে বহু আগের এক রিট মামলা হতে উদ্ভূত আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আদালতের বন্ধু হিসেবে যে ৮ জন সিনিয়র আইনজীবীকে মতামত দিতে ডাকা হয়েছিল, তাদের ৭ জনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা এবং এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মত দেন। এতদসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গত বছর ১৭ মে অবসরে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে এক সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। এটি ছিল একটি বিভক্ত রায়। তিনি প্রকাশ্য আদালতে যে সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন, তার সঙ্গে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে গত ক’দিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব এবং বিচারিক অসদাচরণ। আমরা তার এই আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
খালেদা জিয়া বলেন, বিচারকরা পক্ষপাতহীন থেকে সুবিচার করার যে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন—অবসরে যাওয়ার পর তারা সেই শপথের অধীন থাকেন না। আর সে কারণেই অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতি আদালতে বসতে পারেন না, শুনানি করতে পারেন না এবং একই কারণে কোনো মামলার রায়ও লিখতে কিংবা তাতে দস্তখত করতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক তাই-ই করেছেন। ফলে এই রায় যৌক্তিক কারণেই পক্ষপাতদুষ্ট, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।
তিনি বলেন, গত বছরের ১০ মে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ভাবিসাপেক্ষে বাতিল ও ক্ষমতাবহির্ভূত ঘোষণা করে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, জাতীয় সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন অনাদিকাল থেকে চলে আসা নীতির ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানগুলোর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যা অন্যবিধভাবে বৈধ নয়— প্রয়োজনের কারণে বৈধ; জনগণের নিরাপত্তার জন্য—যা সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য—যা সর্বোচ্চ আইন। ওই রায়ে আরও বলা হয়েছিল— যা হোক, এরই মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের কোনো বিচারপতিকে নিয়োগদানের বিধানটি বাদ দেয়ার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। অথচ সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তারই ঘোষিত রায় থেকে সরে গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছেন। প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষিত লিখিত রায়ে এমন গরমিল নজিরবিহীন। এ ঘটনা যে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই ঘটানো হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগই শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, বিচারপতি আ. ওয়াহাব মিয়া সাবেক প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে ১০ মে ২০১১ তারিখে ঘোষিত রায়ের অসঙ্গতির কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আলাদা রায় দিয়েছেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বিচারপতি আ. ওয়াহাব মিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেছেন। একইসঙ্গে তারা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিকভাবে অপরিহার্য এবং সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলেও মত দিয়েছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন—তিনি ২৯ মার্চ, ২০১২ তারিখে তার লেখা রায় সই করে জমা দিয়েছেন। গত রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, জমাকৃত রায়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের জন্য তিনি সেই রায় ফেরত নিয়ে ক’মাস পর আবার জমা দিয়েছেন। অর্থাত্ একই রায় তিনি দু’বার লিখেছেন এবং দু’বারই দস্তখত করেছেন। ক্ষমতাসীন সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী লেখার জন্যই যে তিনি নিজের লেখা রায় ফিরিয়ে এনে পুনরায় লিখেছেন—তা সুস্পষ্ট হয়েছে নতুন রায়ে সরকারি অবস্থানের পক্ষে লেখা বিভিন্ন প্রস্তাবে।
খালেদা জিয়া বলেন, তার এই আচরণ একেবারেই বিচারকসুলভ নয়; বরং নৈতিকতাবিরোধী। ফলে অনিবার্যভাবেই এ রায়ের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—যার জবাব দেয়ার নৈতিক দায়িত্ব সাবেক প্রধান বিচারপতির। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার এই পরিবর্তন-পরিমার্জনের বিষয়টিকে বিশ্রীরকম ভুল ও অসদাচরণ বলে বর্ণনা করেছেন। বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন একে সরাসরি প্রতারণা বলেছেন।
তিনি বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না অথচ ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রস্তাব করা হয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকারই সংক্ষিপ্তাকারে নতুন নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে, যদিও রায়ের অন্য অংশে নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সংসদ বহাল না থাকলে কেউই নির্বাচিত থাকেন না। তাহলে ওই ৪২ দিন অর্থাত্ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালে, নির্বাচনের সময় এবং নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত অনির্বাচিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন কোন যুক্তিতে? এটি বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের স্ববিরোধিতার অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি।
খালেদা জিয়া বলেন, ১০ মে যখন সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়, তখন জাতীয় সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করার বিধান রেখেছে। সদ্য ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ৪২ দিনের উল্লেখ স্পষ্টতই সরকারি ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। আদালতের রায়কে রাজনীতিকরণের এ এক চরম নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত।
তিনি মনে করেন, ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্যই যে এসব পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা মনে করি, নৈতিকতা বিরোধী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই রায় যৌক্তিক কারণেই অকার্যকর। এই রায়ের কারণে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, দেশের জনগণ বিচার বিভাগকে দলীয় প্রভাবমুক্ত এক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সুবিচার থেকে বঞ্চিত ও আশাহত হয়েছে। আমরা ঘোষণা করছি, সাবেক প্রধান বিচারপতির দেয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অযৌক্তিক ও পরস্পরবিরোধী রায় জনগণ কখনও গ্রহণ করবে না এবং তার ভিত্তিতে আয়োজিত কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না।
তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে আবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন চলছে এবং ক্রমেই তা তীব্রতর হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারকে তাদের অনৈতিক ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে নতুন করে লেখা এই রায় উপহার দেয়া হলো। একই সঙ্গে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী অপ্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও এই রায়ে অবৈধ ফখরুদ্দিন সরকারকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, যা এই রায়কে রাজনীতিকরণের আর একটি দৃষ্টান্ত। জাতির দুর্ভাগ্য যে, দলীয় স্বার্থে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তাদের প্রত্যক্ষ করতে হলো।
খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বলেন, সরকার সব ক্ষেত্রেই আজ ব্যর্থ। কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরই আজ আর জনগণের আস্থা নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের জন্যই আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। আর এমন নির্বাচন কেবল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। কাজেই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের গণদাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জনগণের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অবসরপ্রাপ্ত কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতির পক্ষপাতদুষ্ট রায় এই আন্দোলনকে দুর্বল কিংবা ব্যাহত করতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সংসদে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা জনগণকে বিভ্রান্ত করার আর একটি অপচেষ্টা মাত্র। তিনি প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেই একটি সাজানো নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা করছেন। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার।
খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ কোনো অবস্থাতেই দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো নির্বাচন মেনে নেবে না।
আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক বিষয়ে জনগণই সব ক্ষমতার উত্স। জনগণের আন্দোলন কখনও ব্যর্থ হয়নি—এবারও হবে না।
গতকাল গুলশানে নিজ কার্যালয়ে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া আদালতের রায়ের ব্যাপারে বিএনপি ও ১৮ দলের জোটের অবস্থান তুলে ধরেন। প্রকাশ্য আদালতে দেয়া সংক্ষিপ্ত ও ষোলো মাস পর দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে অসঙ্গতি তুলে ধরে খালেদা জিয়া বলেন, এ রায় বিচারিক অসদাচরণ। একজন বিচারক অবসর নিলে তিনি আর আদালতে বসতে পারেন না। একইভাবে রায়ে সই করতে পারেন না। কিন্তু সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তা-ই করেছেন। তাই এ রায় অগ্রহণযোগ্য।
দু’ধরনের রায় দিয়ে বিচারপতি খায়রুল হক বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, গত ১০ মে আদালতে যে রায় দেয়া হয়েছিল, সেখানে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন বিচারপতিদের বাদ দিয়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বি এম খায়রুল হক বলেছেন নির্দলীয় সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা। এমন গরমিল নজিরবিহীন এবং হীন রাজনৈতিক স্বার্থে করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ বি এম খায়রুল হকের রায়ে নির্বাচনের যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি। আদালতের রায়কে রাজনীতিকীকরণের এ এক চরম নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত।
খালেদা জিয়া বলেন, আদালতের রায়ের এক অংশে বলা হয়েছে, অনির্বাচিত ব্যক্তি রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন না আবার রায়ের অন্য অংশে বলা হয়েছে, নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। তিনি বলেন, সংসদ বহাল না থাকলে কেউ নির্বাচিত থাকেন না। তাহলে অনির্বাচিতরা কোন আইনে থাকবে? এটি রায়ের অসংখ্য স্ববিরোধিতার একটি বলে উল্লেখ করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগই শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সংসদ ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটি জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা বলে চিহ্নিত করে খালেদা জিয়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থেকে সাজানো নির্বাচনের অপচেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। খালেদা জিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বিচারপতির রায়ে দেশে অনভিপ্রেত অবস্থার সৃষ্টি হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ার পর সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নেরও উত্তর দেন বিরোধীদলীয় নেতা। সংবাদ সম্মেলন চলাকালে আটবার বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করায় তার টানা বক্তব্য বাধাগ্রস্ত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার এমপি, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান বিচারপতি টি এইচ খান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বিরোধীদলীয় নেতার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, ব্যক্তিগত সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় নেতা আবুল খায়ের ভূঁইয়া এমপি, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এমপি, অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, শামীমুর রহমান শামীম, আবদুল লতিফ জনি, রেহেনা আক্তার রানু এমপি প্রমুখ।
সদ্যঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রসঙ্গে ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি (খায়রুল হক) প্রকাশ্য আদালতে যে সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন, তার সঙ্গে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর, কয়েক দিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব এবং বিচারিক অসদাচারণ। পূর্ণাঙ্গ রায়ের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত রায়ের অমিল রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর বিধান রেখেছে। সদ্যঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ৪২ দিনের উল্লেখ স্পষ্ট সরকারি ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্যই রায়ে এসব পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ওই রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের স্বাক্ষর করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদা জিয়া বলেন, অবসরে যাওয়া কোনো বিচারপতি যেহেতু শপথের অধীনে থাকেন না, তাই কোনো মামলার রায়ও লিখতে পারেন না। একই কারণে কোনো রায়ে দস্তখতও করতে পারেন না। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি তা-ই করেছেন। তাই এ রায় যৌক্তিক কারণেই পক্ষপাতদুষ্ট, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিএনপির সহ-সভাপতি বিচারপতি টি এইচ খান বলেন, অবসর নেয়ার পর তার কোনো শপথ থাকে না। এক্ষেত্রে অবসরের পর প্রধান বিচারপতি যখনই রায় দেন না কেন, ওই রায় দেয়ার ক্ষমতা তার নেই, তার নেই , তার নেই। তাই এ রায় অশুদ্ধ হিসেবে থাকবে। অবসরের পর ওই শপথ কার্যকর থাকে কি না—এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, শপথ না থাকলে তার রায়ের কার্যকারিতা কি থাকতে পারে?
সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট ‘গভীর’ করবে বলে মনে করেন বিরোধীদলীয় নেতা। তিনি বলেন, এ রায়ের কারণে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং এতে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ হওয়ায় বিধান অনুযায়ী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। তবে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন বিএনপি হতে দেবে না বলে দৃপ্ত কণ্ঠে আবারও ঘোষণা দেন বিরোধী দলীয় নেতা।
তিনি বলেন, সরকার যদি সংবিধান সংশোধনের বিল পাস না করে, তাহলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়ের কারণে চলমান আন্দোলনকে কেউ দুর্বল করতে পারবে না। নির্দলীয় সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না; জনগণ তা প্রতিহত করবে।
লিখিত বক্তব্যের পর এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা বলেন, আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। নির্দলীয় সরকারের দাবি এখন জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশের মানুষ মনে করে, নির্দলীয় সরকার না হলে তারা ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে না।
আগাম নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন কি না—জানতে চাইলে খালেদা জিয়া সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন, আপনাদের কাছে কোনো সুস্পষ্ট সংবাদ আছে কি? আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, নির্দলীয় সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না। ওই ধরনের নির্বাচন হতেও দেয়া হবে না।
তত্ত্বাবধায় সরকার প্রশ্নে সরকার ও বিরোধী দলের বিপরীত অবস্থানের কারণে আবার জরুরি অবস্থা জারির পথ তৈরি হচ্ছে কি না—প্রশ্ন করা হলে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই। আমরা মনে করি, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পাবে না।
আবার এক-এগারোর আশঙ্কা করেন কি না—প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, সবসময় আমরা চেয়েছি গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত থাকুক। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত থাকুক। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুনির্দিষ্ট সুযোগ থাকুক। এজন্য আমাদের লড়াই চলছে, চলবে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২০১১ সালের ১০ মে আদালত যখন তত্ত্বাবধায়ক বাতিল সংক্রান্ত রায় দিয়েছিল, তখনই বিরোধীদলীয় নেতা সংবাদ সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আদালতের দেয়া এ রায়ে রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হবে এবং ওই রায় বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন তখন বেগম জিয়া। আপনারা দেখছেন, সেই রায় নিয়ে সরকার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে চলেছে। জনগণ এ রায় মানবে না। গণতান্ত্রিক দেশে এ রায় অকার্যকর।
বেগম জিয়া লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৯৯৬ সালের আগে দেশের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল না। ১৯৯৫ সাল থেকে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীসহ কতিপয় রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। তারা দিনের পর দিন হরতাল করেছে, যানবাহন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে, নিরীহ মানুষের জীবন নাশ করেছে, সংসদ বর্জন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এই দাবিতে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছে। তাদের সেই পদত্যাগের ফলে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করি। এই বিধানের অধীনে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তিনি বলেন, ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো পুনরায় আন্দোলনের নামে সহিংসতা শুরু করে। ক্রমাগত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি, অবরোধ এবং শেষ পর্যন্ত লগি- বৈঠা আন্দোলনে প্রকাশ্য রাজপথে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটিয়ে তারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এরই সুযোগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির আবরণে দেশে চলমান গণতন্ত্র ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মাবরণে সেনা সমর্থিত এক অসাংবিধানিক সরকার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই অসাংবিধানিক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে ঘোষণা দেন এবং তাদের সব অপকর্মকে আগাম বৈধতা প্রদান করেন। দীর্ঘ দু’বছর ধরে সেই সরকার দেশকে রাজনীতিহীন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন করার অপচেষ্টা চালায়। তাদের অপশাসনে অতিষ্ঠ জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা জরুরি অবস্থা বহাল রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। আমরা জরুরি অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তারা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সেই অবৈধ সরকারের সব অপকর্মের বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত করে এবং জরুরি অবস্থার মধ্যেই নির্বাচনে যেতে রাজি হয়। তাদের এই আঁতাত বুঝতে পেরেও জনগণকে তাদের হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া এবং অনির্বাচিত স্বৈরশাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করার জন্য আমরা নির্বাচনে অংশ নেই। নীল নকশার সেই নির্বাচনে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সহায়তায় ব্যাপক কারচুপি সম্পর্কে আপনারা সবাই অবহিত।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কখনও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেনি। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ সম্পর্কে কোনো কথা নেই। এমনকি সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে গঠিত সংসদীয় কমিটিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। একইভাবে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশার সংগঠন, সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। এরপর সরকার তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় নির্বাচনে অবধারিত পরাজয়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে মত পাল্টে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের কথা বলা শুরু করে। অন্যদিকে সে সময় নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক হঠাত্ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে বহু আগের এক রিট মামলা হতে উদ্ভূত আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আদালতের বন্ধু হিসেবে যে ৮ জন সিনিয়র আইনজীবীকে মতামত দিতে ডাকা হয়েছিল, তাদের ৭ জনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখা এবং এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে মত দেন। এতদসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক গত বছর ১৭ মে অবসরে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে এক সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন। এটি ছিল একটি বিভক্ত রায়। তিনি প্রকাশ্য আদালতে যে সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন, তার সঙ্গে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে গত ক’দিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব এবং বিচারিক অসদাচরণ। আমরা তার এই আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
খালেদা জিয়া বলেন, বিচারকরা পক্ষপাতহীন থেকে সুবিচার করার যে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে বিচারক হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন—অবসরে যাওয়ার পর তারা সেই শপথের অধীন থাকেন না। আর সে কারণেই অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতি আদালতে বসতে পারেন না, শুনানি করতে পারেন না এবং একই কারণে কোনো মামলার রায়ও লিখতে কিংবা তাতে দস্তখত করতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক তাই-ই করেছেন। ফলে এই রায় যৌক্তিক কারণেই পক্ষপাতদুষ্ট, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।
তিনি বলেন, গত বছরের ১০ মে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ভাবিসাপেক্ষে বাতিল ও ক্ষমতাবহির্ভূত ঘোষণা করে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, জাতীয় সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন অনাদিকাল থেকে চলে আসা নীতির ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানগুলোর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যা অন্যবিধভাবে বৈধ নয়— প্রয়োজনের কারণে বৈধ; জনগণের নিরাপত্তার জন্য—যা সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য—যা সর্বোচ্চ আইন। ওই রায়ে আরও বলা হয়েছিল— যা হোক, এরই মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের কোনো বিচারপতিকে নিয়োগদানের বিধানটি বাদ দেয়ার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। অথচ সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তারই ঘোষিত রায় থেকে সরে গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছেন। প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংক্ষিপ্ত রায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষিত লিখিত রায়ে এমন গরমিল নজিরবিহীন। এ ঘটনা যে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই ঘটানো হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগই শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, বিচারপতি আ. ওয়াহাব মিয়া সাবেক প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সঙ্গে ১০ মে ২০১১ তারিখে ঘোষিত রায়ের অসঙ্গতির কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আলাদা রায় দিয়েছেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বিচারপতি আ. ওয়াহাব মিয়ার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেছেন। একইসঙ্গে তারা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিকভাবে অপরিহার্য এবং সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলেও মত দিয়েছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন—তিনি ২৯ মার্চ, ২০১২ তারিখে তার লেখা রায় সই করে জমা দিয়েছেন। গত রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, জমাকৃত রায়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের জন্য তিনি সেই রায় ফেরত নিয়ে ক’মাস পর আবার জমা দিয়েছেন। অর্থাত্ একই রায় তিনি দু’বার লিখেছেন এবং দু’বারই দস্তখত করেছেন। ক্ষমতাসীন সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী লেখার জন্যই যে তিনি নিজের লেখা রায় ফিরিয়ে এনে পুনরায় লিখেছেন—তা সুস্পষ্ট হয়েছে নতুন রায়ে সরকারি অবস্থানের পক্ষে লেখা বিভিন্ন প্রস্তাবে।
খালেদা জিয়া বলেন, তার এই আচরণ একেবারেই বিচারকসুলভ নয়; বরং নৈতিকতাবিরোধী। ফলে অনিবার্যভাবেই এ রায়ের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—যার জবাব দেয়ার নৈতিক দায়িত্ব সাবেক প্রধান বিচারপতির। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার এই পরিবর্তন-পরিমার্জনের বিষয়টিকে বিশ্রীরকম ভুল ও অসদাচরণ বলে বর্ণনা করেছেন। বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন একে সরাসরি প্রতারণা বলেছেন।
তিনি বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না অথচ ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রস্তাব করা হয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকারই সংক্ষিপ্তাকারে নতুন নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে, যদিও রায়ের অন্য অংশে নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সংসদ বহাল না থাকলে কেউই নির্বাচিত থাকেন না। তাহলে ওই ৪২ দিন অর্থাত্ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালে, নির্বাচনের সময় এবং নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত অনির্বাচিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন কোন যুক্তিতে? এটি বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের স্ববিরোধিতার অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি।
খালেদা জিয়া বলেন, ১০ মে যখন সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়, তখন জাতীয় সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করার বিধান রেখেছে। সদ্য ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ৪২ দিনের উল্লেখ স্পষ্টতই সরকারি ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। আদালতের রায়কে রাজনীতিকরণের এ এক চরম নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত।
তিনি মনে করেন, ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্যই যে এসব পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমরা মনে করি, নৈতিকতা বিরোধী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই রায় যৌক্তিক কারণেই অকার্যকর। এই রায়ের কারণে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং রাজনৈতিক সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, দেশের জনগণ বিচার বিভাগকে দলীয় প্রভাবমুক্ত এক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সুবিচার থেকে বঞ্চিত ও আশাহত হয়েছে। আমরা ঘোষণা করছি, সাবেক প্রধান বিচারপতির দেয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অযৌক্তিক ও পরস্পরবিরোধী রায় জনগণ কখনও গ্রহণ করবে না এবং তার ভিত্তিতে আয়োজিত কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না।
তিনি বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে আবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন চলছে এবং ক্রমেই তা তীব্রতর হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারকে তাদের অনৈতিক ইচ্ছা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে নতুন করে লেখা এই রায় উপহার দেয়া হলো। একই সঙ্গে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী অপ্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও এই রায়ে অবৈধ ফখরুদ্দিন সরকারকে বৈধতা দেয়া হয়েছে, যা এই রায়কে রাজনীতিকরণের আর একটি দৃষ্টান্ত। জাতির দুর্ভাগ্য যে, দলীয় স্বার্থে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তাদের প্রত্যক্ষ করতে হলো।
খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত তাদের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বলেন, সরকার সব ক্ষেত্রেই আজ ব্যর্থ। কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপরই আজ আর জনগণের আস্থা নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের জন্যই আমরা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। আর এমন নির্বাচন কেবল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। কাজেই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের গণদাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জনগণের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অবসরপ্রাপ্ত কোনো সাবেক প্রধান বিচারপতির পক্ষপাতদুষ্ট রায় এই আন্দোলনকে দুর্বল কিংবা ব্যাহত করতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সংসদে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা জনগণকে বিভ্রান্ত করার আর একটি অপচেষ্টা মাত্র। তিনি প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেই একটি সাজানো নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা করছেন। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার।
খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ কোনো অবস্থাতেই দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো নির্বাচন মেনে নেবে না।
আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক বিষয়ে জনগণই সব ক্ষমতার উত্স। জনগণের আন্দোলন কখনও ব্যর্থ হয়নি—এবারও হবে না।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন