বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

হাসিনার রত্নসভার মণিমাণিক্য



আ মী ন কা দী র
এক ক্লিকবাজ এমডির নিচে চাকরি করতে গিয়ে ডিএমডি খুবই পেরেশান। এক সকালে অফিসে বসতে না বসতেই বড়কর্তার পিওন এসে ডিএমডিকে জানাল—সালাম দিয়েছেন বড় সাহেব। ডিএমডি যথারীতি ছুটলেন। আসসালামু আলাইকুম। স্যার কি আমাকে ডেকেছেন? বড়কর্তা চশমার ফাঁক দিয়ে সরু করে তাকালেন। মেঝকর্তাকে দেখলেন। তারপর চুপচাপ। কিছু বলছেন না। নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। বসতেও বললেন না ডিএমডিকে। মেঝ খুবই অপ্রস্তুত। না বললে বসতেও পারেন না তিনি। খুবই মুশকিল। ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকক্ষণ কেটে গেলে তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলেন আবার। সঙ্গে সঙ্গে চশমার ফাঁক দিয়ে বড়’র সেই সরু চোখ। কী ব্যাপার! কী চাই? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাশতেছ কেন! তোমার কাশির ব্যারাম আছে নাকি! ডিএমডি খুবই অবাক। এসব কী বলছেন এমডি!
তিনি কিছু বলার আগেই বড়কর্তার আবার ধমক। আশ্চর্য! নিজের সিটে তোমার কি কোনো কাজকাম নেই?
স্যার, আপনি তো আমাকে ডেকেছিলেন! আমি তো আপনার তলব পেয়েই এসেছি।
এমডি দিব্যি চোখ উল্টে বললেন, না, আমি তো তোমায় ডাকিনি। এই সাতসকালে তোমাকে আমার কী দরকার!
কিন্তু স্যার, আপনার পিওন তো গিয়ে আমাকে ডাকল!
খেঁকিয়ে উঠলেন বড়কর্তা। আশ্চর্য! আপনার কমন সেন্স বলতে কি কিছু নেই! একটা গিয়া আপনাকে ডাকল! আর আপনি আইসা উপস্থিত! আপনি পিওনের চাকরি করেন, না আমার! আরে আমার কাছে ইন্টারকম আছে না! ডাকলে ফোন কইরা তো ডাকতাম। রিমেমবার, ইউ আর নট আন্ডার পিওন।
সেদিন নাকানি-চুবানি খেয়ে ডিএমডি তার সিটে ফিরে গেলেন।
পরদিন এমডির পিওন আবার তার সামনে উপস্থিত। কী ব্যাপার? এমডি স্যার তলব করেছেন অপনাকে। গম্ভীর চোখে তিনি পিওনের দিকে তাকালেন। ইচ্ছে হচ্ছিল কষে একটা ধমক দেন। ব্যাটা ফাজলামি করছে মনে হয়। নিজেকে সামলালেন, কিছু বললেন না। পিওন চলে গেল। ডিএমডি সিট ছেড়ে উঠলেন না। আর যাই হোক তিনি পিওনের আন্ডারে চাকরি তো আর করেন না। দু-চার-পাঁচ মিনিটও যায়নি। ইন্টারকম বেজে উঠল। ফোনটা তুলতেই বাজখাই গলার ধমক। কী ঘটনা আবদুর রহম্মান মিয়া! ডিএমডি হইয়া তো অফিসের সুপার-বস মনে করতেছ নিজেরে। আরে আমি অফিসে এখনও আছি তো। এখনও মরি নাই।
ডিএমডির আক্কেলগুরুম অবস্থা। স্যার, স্যার! আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না, স্যার!
অতো তোতলাইও না মিয়া। আমি যে তোমারে ডাকলাম। আসলা না যে। পায়ে কি চুম্বক বাইন্ধা চেয়ারে বসছো। নাকি তোমার ভাব বাড়ছে। ভাবতেছ তেলবাজি করে আমার চেয়ারে বসবা। ভুইলা যাইও না মিয়া—রাস্তা দিয়া আইনা চাকরি দিছিলাম। আমি যদি না থাকতাম তুমি তো রাস্তায় রাস্তায় ফ্যা ফ্যা কইরে ঘুরতা।
স্যার, আপনি কই আমারে ডাকলেন। আমি তো ডাক পাই নাই।
ক্যান, আমার পিওন কি তোমারে তলব করে নাই।
কিন্তু স্যার, আমি তো পিওনের আন্ডারে চাকরি করি না। আপনার তো আমারে ইন্টারকমে ডাকার কথা।
বেয়াদপ! আমারে সার্ভিস রুল শেখাচ্ছো। ডিএমডি হইয়া তোমার তেল খুব বাড়ছে! তা-ই না। তোমারে পিওন দিয়া ডাকপো, না ফোন করুম—এইটা তোমার কাছে শিকপার লাগবে। আইসো তোমার তেল কমাই। তোমার জন্য চিঠি রেডি।
কিসের চিঠি, স্যার!
আইসা নিয়া যাও। এইবার তো ফোনেই ডাকলাম। নাকি এইবার পালকি পাঠানো লাগবে।
ডিএমডি পড়িমরি ছুটলেন। বড়কর্তার রুমে ঢুকতে না ঢুকতে পিওন তাকে চিঠি ধরিয়ে দিলেন। তাকে আর রুমে ঢুকতে দেয়া হলো না। পিওন বললে, ঢোকা বারণ। ভেতরে মিটিং চলতেছে। বড়কর্তার হুকুম—আপনেরে যেন ঢুকবার না দেই।
অগত্যা কী করা! বিরস মনে ডিএমডি এসে নিজের সিটে বসলেন। হলুদ খামটা খুললেন। আবার তার আক্কেল গুরুম। তাকে শোকজ করেছেন এমডি। অভিযোগ গুরুতর। অফিসিয়াল সার্ভিস রুলের কোড অব কনডাক্ট লঙ্ঘন। বড়কর্তা খুবই স্নেহশীল। তার ডাকে সাড়া না দেয়ায় শাস্তি দিতেও কসুর করেননি। এক মাসের ফোর্স লিভ দেয়া হয়েছে তাকে।

২.
শেখ হাসিনা সরকারের শেষবেলায় যখন বিদায় বিদায় বিউগল বেজে উঠেছে সকরুণ সুরে, তখন মহাজোট মহারত্ন সভায় যোগ না দিয়ে ভালোই করেছেন প্রবীণ প্রাজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ ও রাশেদ খান মেনন; বরিশালের এই দুই ঝানু রাজনীতিবিদ। ক্ষোভ খেদ অভিমান অপ্রাপ্তির চার বছরের বেদনা শেষে ছিবড়ে-খুবলে খাওয়া মাংসের টুকরা ছুড়ে দিতেই, কিংবা তু তু করে ডাকতেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন—এমন ধারণা যে তারা ভেঙে দিলেন, সেটা নিশ্চয়ই অনন্য ঘটনা। তারা বুদ্ধিমান। দুর্নীতির ডুবন্ত টাইটানিকে তারা না চড়ে দূরদর্শিতার পরিচয়ই দিয়েছেন। শেষবেলায় মন্ত্রী হয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে চালাকি করতে গিয়ে কেমন ধরাটাই না খেয়েছেন সততার ব্লাক ক্যাট সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বেচারা! রেলওয়ের কালোবেড়ালের মধুর আলিঙ্গনে নিজেই আপাদমস্তক কালোবেড়াল হয়ে উঠলেন আপন মাধুরিমায়। শেখ হাসিনার ঔদার্য দেখুন—বেড়ালটা কালো দেখে তিনি সুরঞ্জিতকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেননি। মহাজোট মহারত্নসভার খুঁটিতে বেঁধে রেখেছেন আপন খেয়ালে। আহারে সুরঞ্জিত আর বিপ্লবী সাজতে পারে না। সরকারের যুধিষ্ঠির সাজতে পারে না। আগে তার ঠোঁটের আগায় ছিল টিটকিরির মধুর বিষ মেশানো সদুপদেশ। হাসিনা বড়ই পেরেশান ছিলেন। সুরঞ্জিতের গলায় আর সেই সুর নেই। এখন সে যা কিছু বলে, তা কেবলই হাসিনা-বন্দনা ছাড়া কিছু নয়। মন্ত্রিত্বের টোপ গিলে কালোবেড়াল টোপটা আর গিলতেও পারল না, উগরাতেও পারল না। যাতে উগরে দিয়ে সুরঞ্জিত আবার সেই সদুপদেশ-কর্তা না হয়ে ওঠেন, সেজন্যই তো তাকে খুঁটিতে বেঁধে রাখা। এই খুঁটিতে বাঁধা না পড়ে সত্যিই আক্কেলঅলার পরিচয় দিয়েছেন মেনন-তোফায়েল। কী কেন প্রত্যাখ্যান করলেন মন্ত্রীত্ব, তা নিয়ে তোফায়েল বড়ই চুপচাপ। তিনি রাজনীতির কবি। পোড় খাওয়া। ঝানু লোক। তার নীরবতা কবির নীরবতা। তিনি নীরব থেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, কখন নীরব থাকতে হয়, আর কখন মুখ খুলতে হয়। মুখ খুললেই যদি সুরঞ্জিতের মতো দুর্গন্ধ বেরয়, সে মুখ না খোলাই ভালো। মহাজোট টাইটানিকের এই ডুবন্ত বেলায় মুখ খুললেই বিপদ। কোনো সরকার যখন প্রথম প্রথম ক্ষমতার মসনদে বসেন, তখন তারা নানারকম মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করে বসেন। নানা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটান। বেলাশেষে কেবলই দুর্নীতি আর দুর্নীতি। এই সময় যতই মুখ ছোটাবেন গুণ্ডামি-পাণ্ডামি, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির মল-গন্ধ ছাড়া ওমুখে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বেলাশেষে কোনো মাউথওয়াশেই আর কাজ হয় না। মন্ত্রিত্ব নেয়া না নেয়া নিয়ে রাশেদ খান মেনন আর শেখ হাসিনার যে মধুর রাগ-রাগিনী শুনলাম, তার প্যাথলজিকাল ডিসেকশন করতে চাই না আমি। বরং বলব মন্ত্রিত্ব নিয়ে ভালো একটা ক্যারিকেচার হলো বেশ।
মেনন বলেছেন, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যে প্রক্রিয়ায় মন্ত্রিপরিষদের যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সেটি কখনোই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ ছিল না। এই আমন্ত্রণ এলো সচিব হয়ে। এ ধরনের আমন্ত্রণ কোনো সভ্য দেশে হয় কিনা আমার জানা নেই।’
সরকারের ব্যর্থতার দায়ভার না নিতেই মন্ত্রিত্ব বর্জনের সিদ্ধান্ত কিনা—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মেনন বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, সরকারের কোনো ভ্রান্ত পদক্ষেপের দায়িত্ব আমরা নেব না। তার মানে এই না যে, সরকারের ব্যর্থতার বোঝা আমাদের ঘাড়ে পড়বে না। না চাইলেও আমাদের তা নিতে হবে।’ অন্যদিকে তোফায়েল যে একেবারে মুখ খোলেননি, তা নয়। তবে অতি সাবধানে। খুব গা বাঁচিয়ে। তাকে পিওন ডাকল, না পিএম ডাকলেন—এই সব বালখিল্য বাতচিতের মধ্যে তিনি যাননি। কেননা তলব সব সময় তলবই। পিওন ডাকলেও তলব, পিএম স্বয়ং ডাকলেও তলব।
বরং তোফায়েল বলছেন, এই মুহূর্তে আমি রাজনৈতিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত নই। আমি আমার দলকে ভালোবাসি, আমার দলেরই সরকার। আমি মনে করেছি, এ মুহূর্তে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়ে আমি কিছুই করতে পারব না। যারা এখন মন্ত্রী আছেন, বাকি দিনগুলো তারাই ভালো করে কাজ করতে পারবেন এবং নতুন করে যারা যোগ দিয়েছেন, তারাও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আমার মতো একজন তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিসভায় যোগ না দিলে কিছুই যায়-আসে না।
নিজেকে দলের সাধারণ কর্মী পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে জানিয়ে তোফায়েল বলেন, আমি আমার দলকে ভালোবাসি। দলের মাধ্যমেই কিন্তু আমাদের সরকার। মন্ত্রিত্ব থেকে দল অনেক বড়। একজন সাধারণ কর্মী থেকে আমি যদি দলের জন্য কাজ করে যেতে পারি, তবে নিজেকে ধন্য মনে করব।
এইসব তীক্ষষ্ট রাজনৈতিক কথার মধ্য দিয়ে তোফায়েল ধারেও কেটেছেন, ভারেও কেটেছেন। হাসিনা ভুলেও ভাবেননি এভাবে বরফের ছুরিকাঘাতে মহাজোট লাশকে ছিন্নভিন্ন করবেন সিনিয়র এই রাজনীতিক। জব্বর এক চপেটাঘাত করেছেন তিনি। সংসদে তাকে ব্যঙ্গ করে খোদ হাসিনা বলেছিলেন, ভোলার তোফায়েল মিয়া, ভোলার মিয়া সব ভুলে যায়। না প্রধানমন্ত্রী না। ভোলার মিয়া কিছুই ভোলে না। বরং কীভাবে ঔদ্ধত্য, অহংকার, অতি দর্প ও অসম্মানকে ঠাণ্ডা মাথায় পাল্টাঘাত করতে হয়, ভোলার ভোলা মিয়া তারই নজির দেখিয়ে দিলেন আরকি।
তবে মেনন তোফায়েল যাই বলুন—পিওনের ওপর দোষ চাপান আর যত পোলাইট নম্র ভাষায় কথা বলুন না কেন হাসিনা এবং সৈয়দ আশরাফ ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। আশরাফ সাধারণত বলেন কম, কিন্তু যখন বলেন একেবারে পেট খালি করে সব মনের কথা উগরে দেন। যেমন এবার তিনি তোফায়েল আহমেদের ওপর বেশ একহাত নিয়েছেন। বলেছেন, মন্ত্রিত্ব না নেয়া নাকি মারাত্মক এক ষড়যন্ত্র। তোফায়েল এক পত্রিকা সম্পাদকের সঙ্গে মিলে নাকি এই ষড়-সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা ষড়যন্ত্র তো বটেই। আওয়ামী লীগে থাকবেন তোফায়েল, আর আওয়ামী লীগের দুর্নাম-দুর্দিনে থাকবেন না, এটা সত্যিই অন্যায়। আওয়ামী লীগে থাকতে হলে দুর্নাম-দুর্নীতি-দুঃশাসন-অপশাসনের ভাগ অবশ্যই তোফায়েলকে নিতে হবে। দলের করিত্কর্মা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই কথাটা অবশ্যই ঠিকই বলেছেন তিনি।
এবার আসুন পড়ি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কী বলছেন জবাবে।
মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি বলে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মন্ত্রিত্ব গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মাধ্যমে যাদের ডাকা হয়েছিল, সঠিক নিয়মেই সেটি হয়েছে। তবে কারা মন্ত্রিত্ব নেবেন কি নেবেন না, এটা যার যার সিদ্ধান্তের বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দু’জন নেতা মন্ত্রিত্ব নিতে চাননি। এদের একজন অভিযোগ করেছেন, তাকে নাকি সঠিকভাবে ডাকা হয়নি। আওয়ামী লীগ এবার নিয়ে দুই বার মন্ত্রিসভা গঠন করেছে। প্রথম বার যেভাবে মন্ত্রীদের ডাকা হয়েছিল, এবারও সেভাবেই ডাকা হয়েছে। এখানে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরালের ‘ম্যাটারস অব ডিসক্রেশন’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইন্ডিয়া সভ্য দেশ কিনা জানি না, তবে গুজরাল মন্ত্রী হয়েছিলেন ক্যাবিনেট থেকে ফোন পেয়েই। আইকে গুজরাল নিজেই লিখেছেন দুইবার মন্ত্রী হওয়ার সময় তাকে ক্যাবিনেট সেত্রেক্রটারি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এখন তার কাছে (মেনন) প্রশ্ন, ভারত কি সভ্য দেশ নয়? যে নেতা বলছেন কোনো সভ্য দেশে এটা হয় না, তাকে বলব আইকে গুজরালের বইটি পড়ে দেখবেন।
মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবেন কি করবেন না—এটা যার যার সিদ্ধান্তের বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে যখন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, তখন ‘মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন কিনা’—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নেতা নিজেই বলেছিলেন, ‘এখনও ক্যাবিনেট সেত্রেক্রটারির ডাক পাইনি। তাহলে এখন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ডাকা সঠিক না হয় কী করে?
প্রধানমন্ত্রী খুব একটা অন্যায় বলেছেন বলে মনে হয় না। মেনন কি ভেবেছিলেন, তাকে মন্ত্রিত্বের শপথ নেয়ানোর জন্য পালকি পাঠিয়ে বঙ্গভবনে আনা হবে। আমলা দিয়ে হাসিনা যে ডেকে পাঠিয়েছেন, সেই তো ঢের। পিএমের ডাক বলে কথা!
তবে তিনি এই ঘটনায় দিলে যে বড় চোট পেয়েছেন, তা সম্যক বোঝা যায়। কিছু ইচড়েপাকা সাংবাদিক তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন—তোফায়েল না আসায় দলের চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ হয়েছে কিনা। হাসিনা সেদিন কাষ্ঠ হাসি দিয়ে নিজেকে সামলেছেন। বললেন, আমি তো তাদের ফোন করে ডাকি নাই। তারা তো আমার নির্দেশ অমান্য করে নাই। আমি তো তাদের আসতে বলি নাই। তাইলে চেইন অব কমান্ড অমান্য কোথায় হলো।
কথাগুলো একটু গোলমেলে ঠেকছে মনে হয়। আমলা আরদালি দিয়ে ডাকাই সভ্য দুনিয়ার নিয়ম বলে দাবি করছেন; আবার বলছেন—আমি তো তাদের ডাকি নাই। তাই নাকি তার কোনো অসম্মান হয় নাই। ঠিক আছে, তার কথা মানলাম। কিন্তু আশরাফের ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব এবার কোথায় রাখি। তোফায়েল নাকি গভীর ষড়যন্ত্র করছেন। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে—মহাজোট মহারত্নসভার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যে গভীর গোপন তথ্য-তত্ত্ব আশরাফ জানেন—হাসিনা তা ওয়াকিবহাল তো!
আসলে বঙ্গবন্ধুকন্যার মনে বড় কষ্ট। তার টাইটানিক রত্নপুরী দুর্নীতি-চুরিচামারির লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাড়খার হচ্ছে, তখন সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করছে। সত্যি! বিপদের কাল বড়ই বেইমান। এমনকি শেষ পযন্ত মসিউরও। মসিউর তো মহিষাসুর হতে চলেছে। কে ভেবেছিল, মসিউর এভাবে মুখ ছোটাবে। হাসিনার স্নেহ-মমতায় আর ভারতের স্নেহ-আমিষাধিক্যে তেল তেলতেলে হয়ে তিনি উঠেছিলেন। এখন তার সেই তেল গেল কই। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু দুর্নীতির মহা কেলেঙ্কারি ইস্যুতে তার পদত্যাগ চেয়েছিল। অথবা তাকে ফোর্স লিভ দিতে বলেছিল। পদত্যাগ করতে বলা হতে পারে—এমন আশঙ্কায়ই বেচারার কত গোস্বা। তিনি ছুটে গেলেন নয়াদিল্লি। সেখান খুব বলবান হয়ে এলেন। বললেন, পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না। দেশ গোল্লায় যাক। তাতে কি! তিনি শেখ হাসিনাকে সেবা দিয়ে যাবেনই, কিন্তু শেষ রক্ষা তার হলো কি! দিল্লি তো তাকে রক্ষা করতে পারল না। আর এতেই আমরা মসিউরের আসল চেহারাটা দেখলাম। বেচারা হাউমাউ করে উঠলেন। যে সাংবাদিকদের দু’চোখে দেখতে পারেননি কখনও, তাদের কাছেই শেষ আশ্রয়টুকু চাইলেন। সকরুণ কন্ঠে বললেন, আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন। একসময় রাশিয়ায় যারা অবাঞ্ছিত ছিল, তাদের গুলাগে নিয়ে যাওয়া হতো। আমার জীবনটাও গুলাগে প্রবেশ করেছে। উপস্থিত সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, এমন অবস্থায় পড়লে হার্টফেল হতে পারে, ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে। এই অবস্থায় আমি আপনাদের সহানুভূতি চাই। আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করুন।
ভাবুন একবার—এই কি সেই মসিউর! কী দাপট শুনেছি তার কণ্ঠে। কী দর্প। দেশের স্বার্থের কোনো দাম ছিল না তার কাছে। দেশের মানুষের জন্য কোনো দরদ ছিল না তার ক্ষুধিত পাষাণ হৃদয়ে। তিনি বলেছিলেন, ট্রানজিটের জন্য ভারতের কাছে মাশুল চাওয়া চরম অসভ্যতা। ভারতকে ফ্রি টানজিট দিতে কী নির্লজ্জ ওকালতি। এখন সেই ভারতের খবর কী!
শেয়ারবাজার নিয়ে তার মন্তব্য তো সর্বস্বহারা শেয়ারবাজারিরা মরণের শেষ দম তক ভুলবে না। তাদের চোর বাটপাড়, দেশপ্রেমহীন, ফটকাবাজারি বলতে তার হৃদয় কাঁপেনি। অন্য দেশের স্বার্থের কাছে বিবেক-আদব-কায়দা সব বিসর্জন দিয়ে দেশবাসীকে গালাগাল করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা পাননি। এখন সেই লোকই কিনা আত্মরক্ষার শেষ আকুতি জানাচ্ছেন দেশি মিডিয়ার কাছে। এই হচ্ছে ন্যূনতম দেশপ্রেমহীন, মানবিক আবেগহীন অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আসল চেহারা। যখন চেয়ারে থাকে, তখন তাদের দর্পভারে দুনিয়া কাঁপে। আর যেই চেয়ার সরিয়ে নেয়া হয়, তখন তার চেয়ে সর্বহারা আর কেউ নয়। তার নির্লজ্জ ওকালতির জন্য দেশ হারিয়েছে ন্যায্য মাশুল। শেয়ারবাজারে লাখো লাখো মানুষ ভিখিরি বনে গেছে। তাদের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের তপ্ত অভিশাপ তো তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে মহাজোটের মহাপতন অব্দি।
হাসিনা ভুল করেছিলেন এই ধরনের ভুঁইফোঁড় মাটির সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিগুলোকে বিশ্বাস করে। এর মাশুল তাকেও দিতে হবে। এই উপদেষ্টারা তার জন্য কেবলই কলঙ্কের বোঝা। না হয় নানামুখী চাপে বেদিশা হয়ে হাসিনা তাকে ফোর্স লিভই দিয়েছেন, কিন্তু তিনি ঠোঁট উল্টাতে এক মুহূর্তও দেরি করলেন না। বললেন, তাকে নাকি গুলাগে নির্বাসন দেয়া হয়েছে। গুলাগ হচ্ছে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন জমানার নির্মম নিষ্ঠুর নির্বাসন ক্যাম্প। সোভিয়েত মহারথীদের আবিষ্কার। অগণতান্ত্রিক কমিউনিস্টদের কলঙ্ক। মশিউরের মুখে ভদ্রতার পর্দাটুকুও নেই। শেখ হাসিনা গণতান্ত্রিক নেত্রী। তাকে তার ভক্তকুল গণতন্ত্রের মানসপুত্রী বলে। সেই হাসিনাকে কলঙ্কিত অগণতান্ত্রিক নেতাদের অপকর্মের সঙ্গে তুলনা।
মসিউর এসব কী বলছেন এখন! শেখ হাসিনা কি তবে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন নয়, বরং সোভিয়েত স্টাইলে, বাকশাল স্টাইলে অপশাসন-একনায়কত্ব চালাচ্ছেন!
ভুঁইফোঁড়রা ভুঁই হারালে এভাবে নিজের অন্নদাতা-আশ্রয়দাতার সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়। তোফায়েল মন্ত্রী না হয়ে কি আর এমন ক্ষতি করেছেন। হাসিনা সরকারের বারোটা বাজাতে মসিউর তো একাই একশ’।
তার অন্য বাণীগুলো শুনুন।
মসিউর বলেছেন, এই সরকারের মেয়াদে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের একটি স্পাই নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রসঙ্গে মসিউর বলেন, এরা আমাদের দেশের কিছু লোককে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। তারা বিশ্বব্যাংকের হয়ে কাজ করছেন।
এখানে বিশ্বব্যাংকের একটি স্পাই নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এই গুপ্তচরেরা বিশ্বব্যাংকে ভুল তথ্য দিয়েছে। মসিউর বলেন, যারা পয়সা দেবে, তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা কোনো এক সময় আমাদের দেশের কিছু লোককে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ দেয়। যারা গোপনে তাদের তথ্য সরবরাহ করে, যার কোনো ভিত্তি নেই এবং তাদের পরামর্শ দিয়েছে, কী করতে হবে। তিনি বলেন, এই যে গোপন তথ্য এবং পরামর্শদাতা, তাদের নামও সরকারের কাছে প্রকাশ করতে পারবে না। একটা হলো, যারা তাদের সহযোগিতা করেছে তাদের রক্ষা করতে হবে। আর নামগুলো প্রকাশ করলে পরবর্তীকালে তারা গোপন সহযোগিতা আর পাবে না।
এই গুপ্তচরদের কিছু ইমেইলও তার কাছে আছে বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। বলেন, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও এ বিষয়ে অবহিত। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে মসিউর বলেন, মেইলগুলো এসেছে বেনামে।
মসিউরের বোমব্লাস্টিং তথ্যগুলো সত্যিই ইন্টারেস্টিং। তার তথ্য-তত্ত্ব মেনে নিলে এটা পরিষ্কার—সরকারের তো দেখছি লেজেগোবরে অবস্থা। হাসিনা সরকারের মধ্যে তাহলে তলে তলে এই অবস্থা চলছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেকে ফিটফাট দাবি করলেও ভেতরে দেখছি সদরঘাট। সব ফকফকা।
মসিউরকে শেখ হাসিনা গুলাগ মার্কা কোন গোপন নির্যাতনশিবিরে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন, তা জানি না। সেটা তারা দু’জনই খোলাসা করতে পারবেন। তবে মসিউরকে গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। আমরা জানতে চাই, মহাজোট মহারত্নসভার এইসব গুপ্তচর কারা। যেখানে সরকার নাক-কান কেটে নাকে খত দিয়ে বিশ্বব্যাংকের তোয়াজে ব্যস্ত—অন্তত পদ্মাসেতুর দু-একটা ইট পড়ুক, সেখানে অভিশাপবাদী জ্যোতিষী আগামই বলে বিশ্বব্যাংক কখন কী করবে। তার কথায় এটা পরিষ্কার—বিশ্বব্যাংকের গলি-সন্ধি-ঘুপচি এবং আসল গোমর তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।
সত্যি মসিউর! আপনার একই অঙ্গে কত রূপ! কত রহস্য।

৩.
প্রবীণ চিত্রনির্মাতা দেলোয়ার জাহান হেডমাস্টার নামে একটা ছবি বানাচ্ছেন। বেশ লোভনীয় উপভোগ্য ছবি হবে আশা করা যায়। খবরের কাগজে পড়লাম এতে প্রিয় অভিনেত্রী বন্যা মিরজা ওই ছবিতে হেডমাস্টার আলমগীরের বাসার কাজের মেয়ে চরিত্রে অভিনয় করছেন। আনন্দের বিষয় এই কাজের মেয়েটি পরবর্তীকালে দেশের শিক্ষামন্ত্রী হবেন। ব্যাপারটি জেনে চমকিত হয়েছি আমিও। আশঙ্কিত হয়েছি এই ভেবে যে, ছবিটাতে গল্পের গরু গাছে চড়তে যাচ্ছে না তো! দেলোয়ার জাহান সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। গুণহীন এই দেশের চলচ্চিত্রে তিনি অতি গুণী পরিচালক। তিনি সমাজ-বাস্তবতা থেকে মোটেই বে-ওয়াকুফ নন। চারপাশে কী হচ্ছে তা তিনি ভালো করেই জানেন। নিশ্চিত করেই আশা করা যায়—হেডমাস্টার বাড়ির কাজের মেয়ের শিক্ষামন্ত্রী হয়ে ওঠার ব্যাপারটি তিনি লজিকালি বিশ্বাসযোগ্য করেই তুলে ধরতে পারবেন।
আর ব্যাপারটিকে অবাস্তব-ফ্যান্টাসি বলি বা কেমন করে! আমাদের রাজনীতিতে কী দেখছি। খোদ প্রধানমন্ত্রীই তো জোরগলায় বলছেন— রাস্তা থেকে ধরে এনে অনেককে এমপি বানিয়েছেন। মহাজোট নেত্রী যার ব্যাপারে ওই কথা বলেছিলেন, তিনি এখন টিভি টকশোর মুখর মুখ। যে প্রধানমন্ত্রী রাস্তা থেকে তুলে এনে কাউকে এমপি বানাতে পারেন, তিনি চাইলে রাস্তার ওইসব এমপিকে মন্ত্রীও বানাতে পারেন। তার হাতে যে সর্বময় অসীম ক্ষমতা। তিনি মন্ত্রী-এমপি বানাতে তো পারেনই, উপদেষ্টাও বানাতে পারেন। কিছু চমত্কার দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেনও।
আর যদি তাই-ই হয়, তবে একজন সত্ সজ্জন শিক্ষাগুরুর সান্নিধ্যে থেকে একটি কাজের মেয়ে কালক্রমে যদি শিক্ষামন্ত্রী হয়ও বা—সেটাকে অবাস্তব ফ্যান্টাসি বলিই বা কোন মুখে।

লেখক : কপি এডিটর, দৈনিক আমার দেশ; ব্লগার
ই-মেইল : ameenqudir@gmail.com

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads